শুক্রবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

শরম (২৬তম পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (২৬তম পর্ব)

'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

বুকের ভেতরটা কাঁপে। আমি ঠিক বুঝিনা সুরঞ্জনের প্রতি আমার এই আকর্ষণ যেটিকে নিরস্ত্র করা যায় না, সেটি কেন? আমি নিঃসঙ্গ বলে? নাকি তার ক্রোধ নিয়ে ঘৃণা নিয়ে প্রচণ্ড আশা আর হতাশা নিয়ে বিভ্রান্তি আর ভ্রান্তি নিয়ে সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে নিস্পৃহতা নিয়েও মানুষটা ভেতরে খুব সৎ বলে?

আমার জীবন নিয়ে আমি কী করবো, সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। আমার আর জুলেখার। এগুলো নিয়ে প্লিজ কিছু লিখবেন না। কী লিখতে গিয়ে কী লিখবেন। পরে কী না কী ঝামেলা হয়।

আমার লেখার জন্য ঝামেলা? ঝামেলাই তো। ঝামেলাকে ভয় পাও বুঝি? আমার সবিস্ময় প্রশ্ন। কী ভেবেছেন আমাকে? মহামানব? মোটেই কিন্তু তা নই। ভয় না থাকলে দেশ ছেড়েছি নাকি? এখানে ভয় করি না? এখানেও মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্টদের ভয় করি। অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ হিন্দু ফান্ডামেন্টালিস্টদের। যে কটা দিন বাঁচি, নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। কিরণময়ীর হাতটি ধরে বুকের কাছে একটু টেনে নিল। এই আদরটুকু, এই ভালোবাসাটুকু, হৃদয়ের উত্তাপটুকু প্রকাশ করতে সবাই জানে না। দেখে কী যে ভালো লাগে।

বললাম, গাড়ি নিয়ে যাও।

তরুণকে বলেও দিয়েছিলাম ওদের পৌঁছে দিতে। সুরঞ্জন কিছুতে গাড়ি নিল না। বললো রাস্তায় ট্যাক্সি ধরে নেবে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। হু হু হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমি কে ওদের কাছে? কেউ নই। শুধু একজন লেখক। কিরণময়ী সাধারণ অসাধারণের কথা বলছিলেন। ওঁরা নাকি সাধারণ আর আমি নাকি অসাধারণ। অসাধারণ একবার যদি কেউ কাউকে ভেবে ফেলে, তাকে কেবল দূরেই ঠেলে। অসাধারণদের দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে। নাগালে এসেও দূর থেকে দেখার মতোই তাদের তারা দেখে। জাতপাত না মানলে হিন্দু মুসলমানে প্রেমের সম্পর্কও হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাকে একবার অসাধারণ ভাবে, তাকে সত্যিকার আপন কোনওদিনই করতে পারে না। তাদের সঙ্গে আসলে কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। কিরণময়ী আর সুরঞ্জন যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল, দুজনের চোখেই আমি কৃতজ্ঞতা দেখেছি, ভালোবাসা দেখিনি। খুব ব্রাত্য বোধ করি। খুব নিঃসঙ্গ।

কিরণময়ী বিধবা হয়েছেন। শুধু শাঁখা সিঁদুর খুলেছেন। সাদা শাড়িও পরেন না, মাছ মাংসও বাদ দেননি। সুধাময় বলতেন, আমি মারা গেলে তোমাকে অনুরোধ করে বলছি ভুলেও যেন বিধবার সাজ সেজো না। যেমন আছো এখন, তেমনই থেকো। যা ইচ্ছে করে, কোরো। স্বামীর অনুরোধ তিনি রাখেননি, গায়ে সাদা থান জড়ালেন, হবিষ্যি খাওয়া শুরু করলেন, কিন্তু বাদ সাধলো সুরঞ্জন, বললো, তুমি যদি এইসব বন্ধ না কর, আমি সোজা বাড়ি থেকে চলে যাবো। এর চেয়ে বড় হুমকি জীবনে আর কীইবা থাকতে পারে কিরণময়ীর। স্বামী চলে গেছে, মায়া চলে গেছে, এখন সবেধন নীলমণি সুরঞ্জনও যদি চলে যায়, তবে আত্দহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না তার। আর সুরঞ্জন মাথা খারাপ ছেলে, সে যদি সত্যিই চলে যেতে চায়, তাকে বাধা দেবার সাধ্য যে কিরণময়ীরও নেই, তা তিনি জানেন। কিরণময়ী রঙিন কাপড় পরছেন, সবই খাচ্ছেন। কিন্তু সাধ মিটিয়ে পুজো করার স্বাধীনতা তিনি বলে দিয়েছেন, যেন কেউ কেড়ে না নেয়। এত লোক পুজো করছে, এত লোক ধর্ম মানে, নিশ্চয়ই ভগবান বলে কেউ আছে কোথাও, কিরণময়ী ভাবেন। আর আজকাল সময় নিয়ে হয়েছে মুশকিল, এত সময় দিয়ে করবেন কী তিনি জানেন না। সংসারের সব কাজ শেষ হওয়ার পর ভয়াবহ এক একাকিত্ব তাঁকে জাপটে ধরে। যত বয়স বাড়ছে, তত তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সময় দেওয়ার সময় কারও নেই। সুরঞ্জন যখন ঘরে থাকে, একা একাই থাকে, তার নিজের ঘরে, হয় কিছু পড়ে, নয় ছাত্রছাত্রী পড়ায়, নয় বন্ধু বা জুলেখা এলে তাদের নিয়ে কাটায়। খুব কম হঠাৎ হঠাৎ কিরণময়ীর বিছানায় এসে সে উপুড় হয়ে শোয়। মা হয়তো ছেলের মাথায় পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন, ওই আদরটুকু শরীর পেতে ছেলে গ্রহণ করে। কিরণময়ী পান ধরেছেন, মায়ের কাছে পান খাবার আবদার ছেলের। পান চিবুতে চিবুতে জাবর কাটার মতো ফেলে আসা সুখের দিনগুলোর কথা বলেন কিরণময়ী। দিন তো সবই ফেলে আসা। কিরণময়ীর মনে হয়, এই জীবনটা অর্থহীন এবং অতিরিক্ত একটা জীবন। অন্ধকার গলির মধ্যে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বাস করে জগতের সমাজের পরিবারের নিজের কীইবা লাভ করছে কে। না সুরঞ্জন। না তিনি। ব্যক্তিজীবন যাপন করার যে আনন্দ, দুজনের কারওরই নেই। কিরণময়ী বোঝেন, জুলেখার জায়গায় যে কোনও হিন্দু মেয়ে যদি হত, সুরঞ্জন হয়তো বিয়ে করে ঘরে তুলতো। তাঁর এও মনে হয়, তার পক্ষে যদি সম্ভব হত জুলেখাকে ত্যাগ করা, করতো সে। কিন্তু ওকে ঠিক কেন ত্যাগ করা যায় না, তার তিনি কিছু জানেন না। সম্ভবত এই কারণে যে মেয়েটার মধ্যে যা আছে, তা আর কারও কাছে সে পাবে বলে মনে করে না। অথবা এই বাজারে খুব সুলভ নয় বান্ধবী পাওয়া, বিশেষ করে হাতে যখন টাকা কড়ি অত থাকে না। প্রেমও, অপ্রিয় সত্য, যে, বেচাকেনার ব্যাপার হয়ে উঠেছে। গরিবের প্রেম গরিবের সঙ্গে আর বড়লোকের প্রেম বড়লোকের সঙ্গেই হচ্ছে। প্রেম তো আগে এমন শ্রেণী মেনে চলতো না। কিরণময়ী তার শৈশব কৈশোরে দেখেছে বড়লোক মেয়ে গরিব ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। বিরাট ধনী ছেলে এক অন্ধ-অনাথ মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোথায় সেসব এখন! সিনেমা থিয়েটারেও সমাজের সেসব উঁচু নিচু শ্রেণীর প্রেম অহরহ দেখাতো। এখন সেসব প্রাচীন ব্যাপার। প্রেম এখন হিসেব করে হয়। বাবা মা যেরকম মানানসই পাত্র পাত্রী খোঁজেন, ছেলে মেয়েরাও প্রেম করার জন্য তেমনই মানানসই কাউকে খুঁজে নেয়। ধর্ম গোত্র সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা সব দেখে নিয়ে তবে প্রেম। কিরণময়ী চেষ্টা করেও অনুমান করতে পারেন না সুরঞ্জন কেন জুলেখাকে বা জুলেখা কেন সুরঞ্জনকে পছন্দ করলো। বেলঘরিয়ায় থাকা হিন্দু ছেলে পার্ক সার্কাসের মুসলমান মেয়ের দেখা কী করে পায় তার রহস্য আজও তিনি জানেন না। ছেলেকে জিজ্ঞেস করে কোনওদিন উত্তর মেলেনি। জুলেখার কাছেও জানতে চেয়েছিলেন, এড়িয়ে গেছে মেয়ে। মেয়েটা মনে হয় না সুরঞ্জনের কোনও ক্ষতি করার জন্য এসেছে। তবে খুব ঘরোয়া, ঘর সংসারের জন্য উদগ্রীব বলে তাকে মনে হয়নি তাঁর। সুরঞ্জনের এলোমেলো ঘরে যখন মেয়ে ঢোকে, ঝুলে থাকা মশারি, চায়ের কাপ, ছাইএ ঠাসা ছাইদানি, খাটের রেলিংএ টেবিলে চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শার্ট প্যান্ট তোয়ালে এসব নিজ হাতে গোছায়নি বা পরিষ্কার করেনি কোনওদিন। সুরঞ্জনকে শুনিয়ে শুনিয়ে কিরণময়ী বলেছেন, কী মেয়ে বাবা, এত অগোছালো থাকে, কোনওদিন তো ঘরটা একটু গোছালো না! সুরঞ্জন একদিন শুধু বলেছে, ও আমার চাকর নাকি? কথাটা কিরণময়ীর খুব লেগেছিল, তাহলে তিনি যে গোছান, তিনি কি চাকর? একবার মুখ ফসকে বেরিয়েও যাচ্ছিল, আমি কি চাকর নাকি? সুরঞ্জনের এই মন্তব্য শুনে কষ্ট হবে ভেবে প্রায় বেরিয়ে আসা কথাকে তিনি আটকে দিলেন। কিরণময়ী এই অভিযোগ কেন করতে যাবেন, ছেলের ঘরটা গুছিয়ে তিনি যে স্বস্তি পান, তা তো অন্য কিছুতে পান না। ছেলে অপদার্থ হোক, রোজগার না করুক, সংসারী না হোক, তবু সে তো ছেলে, মাকে তো ভালোবাসে। বুকে জড়িয়ে ধরে হৃদয়ের উত্তাপ তো মাঝে মাঝে দেয়। নিজের সুখ-দুঃখগুলো মাঝে মাঝে তো ভাগ করে নেয়। একবার মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদলো বাবার জন্য, বইপত্র, ঘাঁটতে গিয়ে একটা ছবি বেরিয়ে এসেছিল সেটি নিয়ে, সুধাময়, মায়া আর সুরঞ্জন, ঢাকার বাড়িতে। এত জীবন্ত সেই ছবি যেন সেদিনের। সুরঞ্জনকে এমনিতে আবেগাপ্লুত হতে কোনওদিন দেখেননি কিরণময়ী। পাথর পাথর একটা মুখ। আগে ঢাকায় এমন ছিল না। রাগ হলে ভাঙতো, তছনছ করতো। এখন কী রকম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিরণময়ীর মনে হয় না জুলেখাও খুব খুশি ওকে নিয়ে। আশংকা হয় কবে না জানি মেয়েটি ওকে ছেড়ে চলে যায়। এমনিতে কারও সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশে না, কিন্তু মিশলে তাকে ভালোবেসেই মেশে। তারপর ভালোবাসার মানুষ যখন ঠকিয়ে চলে যায়, সেটা বুকে খুব বাজে। তাছাড়া যাকে সে আপন বন্ধু বলে বরণ করেনি ভেতরে, সে ঠকাতে চাইলে বা ঠকালে গা করে না সুরঞ্জন।

তসলিমা, কিরণময়ীর বিশ্বাস, সুরঞ্জনের জন্য চাইলে কিছু করতে পারে। ওর প্রতি আগ্রহ তার প্রচণ্ড। ছেলেটি, চায়, দায়িত্ববান হোক, সচ্ছল হোক, সুখী হোক। ওর মতো উদাসীন ছেলেকে কারও সাধ্য নেই মানুষ করে। বয়স হয়েছে, কে বুঝবে। এখনও কেমন বাইশ তেইশ বছর বয়সীদের মতো জীবন নিয়ে রোমান্টিকতা। এঁদো গলিতে এনে তুলেছিস তুই, বলে যতবার কিরণময়ী অভিযোগ করেছেন, ততবারই সুরঞ্জন হেসে বলেছে, এঁদো গলিতে কোনওদিন থেকেছো বাপের জন্মে? কী রকম লাগে এরকম জীবন, চল না একবার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। না। রোমান্টিকতা অবশ্য বলা যেত, যদি লাখপতি বা কোটিপতির এমন আহলাদ হত। কিন্তু এঁদো গলি ছাড়া কি সুরঞ্জন আর কিরণময়ীর দুজনের উপার্জন জোড়া দিয়ে ত্রিগুণ করলেও কোনও রাজপথ জুটবে? তসলিমা ধনী। বেহিসেবির মতো টাকা ওড়ায়। সে তো পারে সুরঞ্জনকে কোনও একটা ব্যবসা করার জন্য টাকা দিতে? কোথাও একটা ফার্মেসি করতে পারে। ওষুধ পত্রের সঙ্গে তো যোগ জন্ম থেকে। আর তা যদি নাই হয়, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে তার পরিচয়। ছেলেটাকে ঢুকিয়ে তো দিতে পারে কোনও কোম্পানিতে বা কোনও কলেজে। কিরণময়ী ভাবেন ঢুকিয়ে দেওয়া না হয় সহজই হল, কিন্তু সুরঞ্জন কি ঢুকবে, কোনও নিয়ম মানবে? অদ্ভুত একটা পুরুষ। স্বাধীনতা একবার পেয়ে গেলে তা ছাড়া মুশকিল হয়। কিছু না করার স্বাধীনতা। ঘর সংসার না করার স্বাধীনতা। কিরণময়ীর ইচ্ছে তসলিমাকে একবার তিনি অনুরোধ করবেন তার ছেলেটাকে একটু মানুষ করার জন্য। জুলেখাই বা কেন সুরঞ্জনের সঙ্গে জড়াবে! অল্প বয়স মেয়ের। লেখাপড়া শিখেছে। এখন যেমন হোক একটা চাকরি করছে, চার পাঁচ হাজার টাকা মাইনে পায়। কী আছে সুরঞ্জনের যে চাইবে বিয়ে করতে। নিজের গোত্রের লোকেরা ওকে ত্যাগ করবে। সে কী সুখী হতে পারবে আত্দীয়স্বজনদের অসুখী করে? সুরঞ্জন কি পারবে সুখী হতে মায়াকে কাঁদিয়ে? নিজের বোনকে? নিজের মাকে? সেই বন্ধনে তার চেয়ে না জড়ানোই ভালো, যে বন্ধন স্বস্তি দেয় না। সুদেষ্ণার সঙ্গে যে জীবন ছিল সুরঞ্জনের সেখানেও কোনও সুখ ছিল না। সুদেষ্ণা যত নিজের করে পেতে চাইতো সুরঞ্জনকে, সে তত বাঁধন আলগা করে বেরিয়ে যেত। ছেলে তো বাঁধন মানার নয়! কিরণময়ী চেয়েছিলেন যেমনই হোক সম্পর্কটা টিকে থাকুক। কিন্তু সুদেষ্ণা কিছুতেই রাজি হল না। বিয়ে ভাঙলোই। সুধাময়ের সঙ্গে যে দাম্পত্য জীবনযাপন করেছেন কিরণময়ী, স্বস্তি ছিল। সুখ ছিল। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু দুজনের দুই সন্তানের জীবনে কোনও সুখ হল না। মাঝে মাঝে সংসারহীনতাও বুঝি ভালো। মায়ার সংসারের চেয়ে কি সুরঞ্জনের সংসারহীনতা ভালো নয়! ভালো। প্রতিদিন মায়াকে যন্ত্রণা পোহাতে হয়। সুরঞ্জনকে নয়। সে দিব্যি দায়িত্ব কর্তব্যবিহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়া এমন যে ওই সম্পর্কের সুতোটা ছিঁড়তে পারে না। ছিঁড়তে চেয়েও যারা না পারে, তাদের কষ্ট অনেক, যারা অত কিছু না ভেবে ছিঁড়ে ফেলে, তারাই হয়তো ভালো থাকে।

কিরণময়ীর মনে হয়, শুধু মনেই হয় না, তিনি বিশ্বাসও করেন, যে, সংসারে পুরুষের চেয়ে নারীর কষ্ট অনেক বেশি। তসলিমা ভালো আছে, কোনও ঝুটঝামেলা নেই, একা থাকে। একা থাকতে যদি মায়াও পারতো। একা একা কিরণময়ী এসব ভাবেন। ভাবনাগুলো ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দেন ঘরের হাওয়ায়। ঘর ছেড়ে ভাবনাগুলোয় বাইরেও বেরোয়, তাঁর সঙ্গে। বাইরে স্যাঁতসেঁতে একটি উঠোন। উঠোনে ন্যাংটো বাচ্চা, নেড়ি কুকুর। এদের পেরিয়ে তিনি চটের ব্যাগে কয়েকটা শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ি থেকে বেরোলেই কিছু সোনার দোকান। জগন্নাথ জুয়েলার্সে কিরণময়ী তাঁর সোনার চেইন বিক্রি করে দিয়েছে খুব বেশিদিন আগে নয়। মায়াকে জানালে বাড়ি মাথায় করবে, তাই সুরঞ্জনকে জানিয়েছেন। টাকা তাঁর শাড়ির ব্যবসায় খাটিয়েছেন। বেনেপুকুর রোডের দুটো পরিচিত বাড়িতে তিনি কাপড়গুলো দেখান। দুটো বিক্রি হয়। টাকা সামনের সপ্তাহে দেবে বলে দেয়। আর পার্ক স্ট্রিটের ওপর একটি বাড়িতে পাওনা টাকার অর্ধেকটা ফেরত পেয়ে চলে যান শিয়ালদা স্টেশনে। স্টেশন থেকে দমদমের দিকে তিনটে স্টপেজ পরেই বেলঘরিয়া। তার পুরোনো পাড়ায় কজনকে বাকিতে শাড়ি দিয়েছিলেন, সেই কজনের কাছে গিয়ে টাকা তোলেন, আর নতুন কজনকে শাড়ি কাপড়গুলো দেখান। কারও পছন্দ হয়, রাখেন তিনটে। বাকি যা আছে, তা নিয়ে দুতিনটে পুরোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে কিছুক্ষণ বসে চা খেতে খেতে আশা আর হতাশার গল্প বলে ফিরে আসেন ট্রেনে করে শিয়ালদা আর বাসে করে এন্টালি, এন্টালি থেকে রিকশায় জাননগর। গলির ভেতর কিরণময়ীর বাড়ির দেয়ালে এক টুকরো টিনে লাল রঙে লেখা মায়াবন। এই নামটিই তিনি রেখেছেন তাঁর অদৃশ্য শাড়ির দোকানের।

সকালে বেরিয়ে তাঁর ফিরতে ফিরতে বিকেল। বিকেলে ফিরে তাঁর আর ইচ্ছে করে না রান্না চড়াতে। না খেয়েই শুয়ে পড়েন। সুরঞ্জন ঘরে না থাকলে তার আর রান্নার ইচ্ছে আজকাল করে না। রান্নার জোগাড় করাটাই ঝামেলা। মঙ্গলা নামের একটা দুঃস্থ মেয়ে আসে ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজ করতে। ওকে দিয়েই কাটা বাছা করিয়ে নেন তিনি। সব দিন ভালো লাগে না। বয়স হচ্ছে। বয়স হচ্ছে এটা ওপরে না বোঝা গেলেও ভেতরে তো হচ্ছে। এই বেলঘরিয়া যাওয়া আসা কিরণময়ীকে কাহিল করে ফেলে। এই কাজগুলোর দায়িত্ব সুরঞ্জন কোনওদিন নেবে? নেবে না। ঘরদুটোর ভাড়াও আজকাল কিরণময়ীকেই দিতে হয়। কী করে মা তাঁর ওই টাকা কটা রোজগার করছেন। [ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর