শুক্রবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

জাতীয়তাবাদের সীমা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জাতীয়তাবাদের সীমা

'জাতীয়তাবাদের সীমা' শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো ২৪তম পর্ব-

কিন্তু সমাধানটা তো পুঁজিবাদ ছেড়ে কৃষিজীবনে প্রত্যাবর্তনে নেই, রয়েছে উৎপাদনের বিকশিত শক্তি এবং আহরিত সম্পদের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করায়।

রবীন্দ্রনাথ সেভাবে চিন্তা করতে সম্মত ছিলেন না। সোশ্যালিজম ও কমিউনিজম সম্পর্কে তার ধারণা মোটেই অস্পষ্ট ছিল না। প্রথম জীবনে লেখা তার এক প্রবন্ধ 'সোশ্যালিজম' (১৮৯৩)-এ দেখা যায় যে, তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, 'ইউরোপে সোশ্যালিস্ট সম্প্রদায়ের উপদ্রব' প্রতিদিন যেভাবে গুরুতর হয়ে উঠছে তাতে 'সেখানে আজ হোক বা দুই দিন পরে হোক, একটা প্রচণ্ড সামাজিক বিপ্লব ঘটা অসম্ভব নহে।' এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, সর্বসাধারণের স্বাধীনতাই সোশ্যালিজমের উদ্দেশ্য। কিন্তু স্বাধীনতার এই আন্দোলনের প্রতি তার যে সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে তা নয়। অনেক পরে ১৯৩০ সালে, তিনি রাশিয়ায় যান এবং সেখানে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে তা দেখে রীতিমতো অভিভূত হয়ে হন। সে কথা তিনি অকুণ্ঠচিত্তে প্রকাশও করেছেন। কিন্তু রাশিয়াতে যে 'বলশেভিক' অর্থনীতি প্রয়োগ ঘটেছে সেটিকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তার ধারণা হয়েছে যে, 'সমষ্টির প্রতি ব্যষ্টির উপেক্ষা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল বলেই সমষ্টির দোহাই দিয়ে আজ ব্যষ্টিকে বলি দেওয়ার আত্দঘাতী প্রচেষ্টা উঠেছে।' এটাকে তিনি বলপ্রয়োগ হিসেবেই দেখেছেন। রাশিয়ায় যে ব্যাপারটির তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সেটি হলো শিক্ষা। তার মন্তব্য, 'ভারতবর্ষ থেকে অনেক চর সেখানে ঘোরে, বিপ্লবপন্থিরাও আনাগোনা করে, কিন্তু আমার মনে হয় কিছুর জন্য নয়, কেবল শিক্ষাসম্বন্ধে শিক্ষা করতে যাওয়া একান্ত দরকার।' রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠকেরা লক্ষ্য না করে পারেননি যে, তিনি তার পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন; স্পষ্টতই পিতামহের কাজকর্মের প্রতি তার সমর্থন ছিল না। কিন্তু এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, তিনি রাশিয়াতে গিয়ে সবকিছু দেখলেন ও বোঝার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার পত্রাবলীতে একবারও স্ট্যালিন তো নয়ই, এমনকি লেনিনের নামও উল্লেখ করলেন না। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ওই সমাজবিপ্লবীদের অর্জন তার প্রশংসা অর্জন করলেও, অর্জন পদ্ধতির 'সহিংসতা' তারা সমর্থন পায়নি। সোনার ধানকে সোনার তরীতে তুলতে তার আগ্রহ আছে, কিন্তু ধানচাষিকে মর্যাদা দানে আগ্রহের অভাব।

গান্ধীর সঙ্গে অনেক প্রশ্নেই তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন, কিন্তু রাজনীতিতে সহিংস পথের প্রয়োগ সম্পর্কে তাদের ঐকমত্য ছিল। তবে ১৯০৫ সালে গড়ে-ওঠা স্বদেশী আন্দোলনের স্বদেশী দিকটির তিনি সমর্থন করেছেন বটে, কিন্তু গান্ধীর 'বয়কট' অংশকে সমর্থন করতে পারেননি। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ঘরে-বাইরে উপন্যাসে (১৯১৬) বেশ ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এর প্রায় ঊনিশ বছর পরে লেখা চার অধ্যায় উপন্যাসে (১৯৩৪) যে-তরুণদেরকে তিনি বিভীষিকাপন্থি বলে মনে করেছেন তাদের প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি তিনি প্রকাশ করেননি; তাদের মনোভাবকে বুঝতে যে চেষ্টা করবেন সেটাও তার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। পথের দাবি যখন নিষিদ্ধ হয়ে যায় তখন শরৎচন্দ্র আশা করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ সে ঘটনার প্রতিবাদ করবেন, শরৎচন্দ্রের সে আশা পূরণ হয়নি, উপরন্তু এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে যে চিঠিটি লেখেন তাতে শরৎচন্দ্রের পক্ষে অত্যন্ত হতাশ হওয়ার কারণ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠিতে একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। সেটি যে সুস্পষ্টরূপে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এমন নয়, তাতে বরং ইংরেজের কিছুটা প্রশংসাই আছে, যেমন আছে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন জানানোর মনোভাবের প্রতি নিন্দা। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন যে, বইটি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে, তাই এটা স্বাভাবিক যে, ইংরেজ এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য ছিল এই রকমের যে, নানা দেশ ঘুরে এসে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে একমাত্র ইংরেজ গভর্নমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশি প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোনো গভর্নমেন্টই এতটা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে না। ইংরেজের বিরুদ্ধে লিখে তার কাছেই আবার কৃপা প্রার্থনাকে তিনি নৈতিকভাবে অন্যায় বিবেচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে লিখেছেন,

নিজের জোরে নয়, পরন্তু সেই পরের সহিষ্ণুতার জোরেই যদি আমরা বিদেশি রাজত্ব সম্বন্ধে যথেচ্ছ আচরণের সাহস দেখাতে চাই, তবে সেটা পৌরুষের বিড়ম্বনা মাত্র- তাতে ইংরেজ রাজ্যের প্রতিই শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়, নিজের প্রতি নয়। এই বক্তব্যে সত্য আছে, কিন্তু আবার আপসকামিতার আভাসও যে নেই তা নয়। এমন আপসকামিতা আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও পেয়েছি। বঙ্কিমচন্দ্র বড় জমিদার ও ছোট জমিদারের ভেতর ভাগ দাঁড় করিয়েছেন, তার মতে ছোট জমিদারেরাই আসলে খারাপ, বড়রা অতটা নয়। রবীন্দ্রনাথ একই রকমের পার্থক্য করেছেন বড় ইংরেজ ও ছোট ইংরেজদের ভেতরে। তার মতে ভারতবর্ষে যারা শাসন করতে এসেছিল তাদের অধিকাংশই ছোট ইংরেজ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লিখিত 'সভ্যতার সঙ্কট' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, 'ব্যক্তিগত সৌভাগ্যক্রমে মাঝেমাঝে মহাদশয় ইংরেজের সঙ্গে আমার মিলন ঘটেছে। এই মহত্ত্ব আমি অন্য কোনো জাতির কোনো সম্প্রদায়ে দেখতে পাইনি। এরা আমার বিশ্বাসকে ইংরেজ জাতির প্রতি আজও বেঁধে রেখেছেন।' ছোট ইংরেজদের দৌরাত্দ্য তিনি দেখেছেন, দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন। ঠাট্টা বিদ্রূপ তো বটেই, প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবেও তাদের 'কীর্তির' বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর তার একক ও একাকী প্রতিবাদ, হিজলিতে রাজবন্দীদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতার জনসভায় তার বক্তৃতা দান। মধুসূদনের সঙ্গে তার পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছি। বানরেরা যে রামের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মধুসূদনের কাছে তার কারণটা ছিল রাজনৈতিক। রামায়ণও ওই রকমের ইঙ্গিতই দেয়।

ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, বানর ও রাক্ষস- উভয় দলই ছিল অনার্য, দুই দলের ভেতর রাজনৈতিক বিরোধ ছিল, একদল তাই অন্যদলকে জব্দ করবার জন্য রামের সাহায্য নিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, রামচন্দ্র ধর্মের দ্বারাই অনার্যদিগকে জয় করিয়া তাহাদের ভক্তি অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি বাহুবলে তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়া রাজ্য বিস্তার করেন নাই [...] রামচন্দ্র যে বানরদিগকে বশ করিয়াছিলেন তাহা রাজনীতির দ্বারা নহে, ভক্তিধর্মের দ্বারা। এই রূপে তিনি হনুমানের ভক্তি পাইয়া দেবতা হইয়া উঠিয়াছিলেন।

মধুসূদনের রচনায় মেঘনাদের সঙ্গে প্রমীলার সহমরণ আমাদের বিস্মিত করে। অন্য অনেক ক্ষেত্রে মধুসূদন-বিরোধী হলেও সতীদাহের প্রতি অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের যে অনুমোদন ছিল তার প্রমাণ তার তখনকার লেখাতে রয়েছে : পূর্বে ভারতবর্ষের কার্যপ্রণালী অতি সহজ সরল, অতি প্রশান্ত অথচ দৃঢ় ছিল। [...] সতী স্ত্রী অনায়াসেই স্বামীর চিতায় আরওহণ করিত [...] সমাজরক্ষার জন্য চূড়ান্ত দুঃখ ভোগ এবং ধর্মরক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন করা তখন অত্যন্ত সহজ ছিল। [ চলবে ]

 

 

 

সর্বশেষ খবর