রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

’৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস

মুস্তফা চৌধুরী

’৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস

আমিনা উলসির সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন মুস্তফা চৌধুরী, ১৯৯৮

গবেষণা শুরু করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিশ্বের যেসব দেশ ও জাতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে সহযোগিতা করেছিল সে ক্ষেত্রে কানাডার ভূমিকা কি ছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে। কাজ শুরু করার অল্পদিনের মধ্যেই কিছু চাঞ্চল্যকর দলিলপত্রের সন্ধান পাই, যা ’৭১-এর ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কানাডীয়দের উদ্যোগ, পরিশ্রম ও ত্যাগের প্রমাণ। সেসব নথিপত্র রয়েছে কানাডীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়, প্রাদেশিক সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মাদার তেরেসার আশ্রম ‘শিশু ভবন’ এবং জেনেভাস্থ ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসেসের নিজ নিজ রেকর্ডস অফিস ও আরকাইভসে।

স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। বিশেষ করে আজ যাদের বয়স ষাটের ওপর, তারা অনেকেই বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফের গ্রামগঞ্জ ও শহরে শহরে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক অগণিত বাংলাদেশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষদর্শী। গত ৪৩ বছরে স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর বহু গবেষণা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে শুরু করে বাঙালিদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উল্লাসের কাহিনী বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও সে সময়ের নারী ধর্ষণ ও যুদ্ধশিশু নিয়ে কোনো বিশেষ গবেষণা হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পরপরই পৃথিবীর যেসব অগ্রগামী দেশ বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল তার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একই সময়ে অনেক জনসেবামূলক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন জাতীয় স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অনাথ শিশুদের রোগ ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসে। তার মধ্যে কানাডীয় ‘ফামিলিজ ফর চিলড্রেন’-এর নাম সর্বপ্রথমেই উল্লেখ করতে হয়।

এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি পরিবারের মানবপ্রেমের দৃষ্টান্ত কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর যখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাস্তবে রূপ নিল, তখন বাংলাদেশের দেশনায়ক, রাজনীতিক ও স্বেচ্ছাসেবীরা একযোগে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসেন। সবার মনে ছিল এক আশা, মুখে ছিল একভাষা এবং প্রাণে ছিল এক আনন্দ- মুক্তির আনন্দ। সে সময়েই জন্ম হয় কয়েক হাজার শিশুর, যাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘অবাঞ্ছিত শিশু’ হিসেবে। এসব ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুর জন্মকে কেন্দ্র করে প্রচলিত সংস্কারবদ্ধ সমাজে যে অশান্তির সৃষ্টি হয় তা বাইরে থেকে উপলব্ধি করা কঠিন। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও গৌরবে সবাই যখন মত্ত, তখন অন্যদিকে কয়েক হাজার লাঞ্ছিত নারী খুঁজছিল একটি নিরাপদ ও গোপন আশ্রয়। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ তাদের অসহায় ও যন্ত্রণার বিষয়টি কখনো সহানুভূতির সঙ্গে দেখেনি। বরং তাদের দেখেছে অনেকটা ঘৃণার চোখে। যদিও বাংলাদেশ সরকার  ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য দেশের জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিল এবং তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে নতুন প্রকল্পের লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংস্থার সাহায্য নিয়েছিল। বাস্তবে সেগুলো কতটুকু সফল হয়েছিল তার মূল্যায়ন কখনো করা হয়নি। ‘বীরাঙ্গনারা’ও তখন এবং এখনো সামাজিক বহুবিচিত্র কুংস্কারের প্রতিবাদ করার কোনো সাহসই পাননি। হাজার বছরের কূপমণ্ডূকতার বেড়া ভেঙে আলোর পথে কোনো বাংলাদেশি সেই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের কোলে তুলে নিতে না পারলেও বেশ কিছু কানাডীয় পরিবার সেই সংকটময় মুহূর্তে এগিয়ে এসেছিল। দুই দেশের সরকারি সহযোগিতায় আইনসম্মতভাবে দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক কিছু পরিবারের হাতে সেই নবজাত শিশুদের তুলে নেওয়ার জন্য সুদূর কানাডা থেকে এসেছিলেন একদল নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক। তার মধ্যে ছিলেন ডক্টর রবার্ট ফেরি এবং তার স্ত্রী হেল্কা ফেরি, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনো, লিজ মউলিং প্রমুখ। তারা ১৫টি যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে কানাডা পৌঁছান ২০ জুলাই ১৯৭২। এসব শিশু কানাডার বৃহত্তম পরিবেশে বড় হয়ে গড়ে তুলেছে তাদের জীবন। কিন্তু তারা জানে তাদের জন্মের ইতিহাস। জানে তাদের জন্মদাত্রী ধর্ষিত মায়েদের করুণ কাহিনী ও তাদের অভিশপ্ত জীবনের অলিখিত ইতিহাস। সুদূর কানাডার মাটিতে বড় হয়ে তারা নিজেদের সম্পর্কে কতটুকু সচেতন? কি তাদের প্রতিক্রিয়া? কোন সংস্কৃতির প্রতি তারা আকৃষ্ট? তাদের আত্মপরিচয়ই বা কি? তারা কি পাকিস্তানি? নাকি বাংলাদেশি? নাকি কানাডীয়। তারা কিভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে চায়?

১৯৭২ সালে কানাডার ১৪ জন দম্পতি যারা বাংলাদেশি ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাদের সবারই বয়স ছিল ৩০ এর কোঠায়। সমসত্তায় মধ্যম শ্রেণির নাগরিক, সবারই নিজস্বভাবে রোজগার করার ব্যবস্থা ছিল। কেউ কেউ একাধিক পেশার পিছনে ছুটলেও কয়েকজন আবার ঘরবাসী হোমমেকার ছিলেন। কিন্তু সবাই মধ্যম শ্রেণি বা মধ্যবিত্তের মনস্কতা বা মূল্যবোধের অধিকারী। কোনো কোনো মা খণ্ডকালীন কাজকর্ম করলেও অধিকাংশ মা ঐতিহ্যবাহী গৃহকর্মী এবং ছেলেপুলেদের প্রধান যত্নকারী ছিলেন।
তাদের স্বামীরা পুরোপুরি চাকরি অথবা ব্যবসায় রোজগারমনস্ক এবং তারা আর দশজন সাধারণ কানাডীয়ের মতো ছিলেন।
তারা চেয়েছেন তাদের সন্তানদের মধ্যে তাদের গুণাবলী বিকশিত হোক, আত্মমর্যাদা তাদের প্রখর হোক, অন্যান্য মূল্যবোধ ও ন্যায়-নীতিবোধ জাগ্রত হক, যাতে তারা সৎ, দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল কানাডীয় হিসেবে ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখে।
যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আমার গবেষণাগ্রন্থ ’৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে একাডেমি প্রেস অ্যান্ড পাবলিসার্স লাইব্রেরি (এপিপিএল)। ৪১৭ পৃষ্ঠার এ বইটিতে যুদ্ধশিশুদের বেঁচে থাকা ও জীবনের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থটির মূল্য ৮০০ টাকা।

 

সর্বশেষ খবর