'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
কি রণময়ী শিউরে ওঠেন যদি তিনি হঠাৎ সুধাময়ের মতো চলে যান কোথাও, কী হবে ছেলের! জুলেখা কি তখন কোনও দায়িত্ব নেবে? না, তাঁর বিশ্বাস হয় না দায়িত্ব নেবে বলে। জুলেখা, কিরণময়ী যতদূর জানেন স্বামী পরিত্যক্তা, তার ওপর একটা ছেলে আছে। দেখতে শুনতে ভালো, এই মেয়ে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে কোনও সহৃদয় ধনবান। সুরঞ্জন কে, কী আছে তার যে মেয়ে তার সঙ্গে সেঁটে থাকবে! ভালোবাসার কথা অনেকে বলে। ভালোবাসা জিনিসটির আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে বলে তার বিশ্বাস হয় না। সুরঞ্জন, তিনি লক্ষ্য করেছেন, মুসলমান বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছে। মুসলমানগুলো কি ওই তপসিয়া থেকে আসে, সন্দেহ হয়। ওই এলাকাটায় সন্ত্রাসীদের বাস।
ছেলেটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই দুশ্চিন্তা সব তাঁর একার। স্বামী বেঁচে থাকলে তাঁকে কিছু ভাগ দেওয়া যেত। আত্দীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারাই আছে, কেউ খবর নেয় না। তাদের বাড়িতে যাওয়া আসাও নেই এখন আর। কেউ কারও জন্য আর ভাবে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিঃসঙ্গতা কিরণময়ীকে ছিঁড়ে খায়। তাঁর ইচ্ছে করে কোনও একদিন এই দুঃসহ জীবন থেকে বাঁচতে তিনি আত্দহত্যা করেন।সারাদিনের না খাওয়া শরীরে ভাবনাগুলো পোকার মতো পিলপিল করে হাঁটে আর কামড়ায়। মঙ্গলা একসময় খোঁজ নিতে এসে দুটো রুটি বানিয়ে আর একটা ডিম ভেজে দিয়ে যায়। খাবে যখন, তখনই সুরঞ্জন ঢোকে। ছাত্র পড়িয়ে এলো। ক্লান্ত। কিছু খাবি রে? বলতেই বললো খাবো। কিরণময়ী মঙ্গলার বানানো ওই রুটি ডিমই খেতে দেয় সুরঞ্জনকে। কী ব্যাপার, ভাত নেই? হঠাৎ রুটি ডিম কেন? কিরণময়ী উত্তর দিলেন না। সুরঞ্জন গোগ্রাসে খেয়ে নিল রুটি ডিম। থাকলে আরও খেত। কিরণময়ী নিজে চা আর এক বাটি মুড়ি খেয়ে নিলেন।
কিছু একটা কর সুরঞ্জন, এভাবে আর চলছে না। কথা শুরু করলেন কিরণময়ী।
কী চলছে না শুনি?
এ পাড়ায় কোনও ভদ্রলোক থাকে?
শহরের মধ্যিখানে তুমি কম টাকা ভাড়ায় আর বাড়ি কোথায় পাবে বলো তো। এ পাড়ায় কি আর মানুষ থাকছে না? ওদের তুমি মানুষ বলে মনে করো না?
তোর বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন। কোনও ডাক্তার ফ্যামিলি এ পাড়ায় থাকে?
বাবা তো বেঁচে নেই। এখন টিউশনি করে চলা আর শাড়ির বিজনেস করা তাও বাড়িতে বসে, তাদের পক্ষে এর চেয়ে বেশি আর স্ট্যান্ডার্ড আশা কর কেন।
ভালো চাকরি টাকরি কিছু কর। কিছুর জন্য তো চেষ্টা করছিস না।
করছি না চাকরি? এই যে টিউশনি করছি, এ কি কিছুই না?
তোমার কাছে এর কোনও মূল্য নেই? শুধু টাকা হলেই মূল্য আছে? কাড়ি কাড়ি টাকা আনতে পারলেই মূল্য? টাকা কি পাচ্ছি না আমি? আমি তো বেকার বসে নেই। রোজগার তো করছি।
এবার কিরণময়ী তেরে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কী রোজগার করছিস? দু হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া তো আমাকেই দিতে হচ্ছে। গত তিন মাস ধরে দিচ্ছি। সে খেয়াল করেছিস?
তাতে কী হয়েছে? তুমি দিয়েছো। বিজনেস করছো। দেবে না? বিজনেস করছো বলতে লজ্জা করে না তোর? বিজনেসে কিছু সাহায্য এ পর্যন্ত করেছিস? বুড়ো হয়েছি, তারপরও রোদে পুড়ে পুড়ে লোকের বাড়ি বাড়ি দৌড়াতে হয়। গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছিস তুই। মুসলমানদের অত্যাচারে জীবন শেষ হয়ে গেল ফ্যামিলির সবার। তোর বাবা মরেছে। মায়ার জীবনে এক ফোঁটা শান্তি আছে? তোর মুখ চেয়ে আমি বেঁচে আছি। কী রকম বেঁচে থাকা এটা? আর তুই কিনা চোখের সামনে একটা মুসলমান মেয়ে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করছিস? ওকে নিয়ে তুই বেড়াতে গেলি। আমি যে কত কত দিন বলেছি, একবার পুরী নিয়ে যা। কই কোনওদিন তো নিয়ে গেলি না! মা বলে মনে করিস? মায়ের কষ্টের দিকে কোনওদিন ফিরে তাকাস? বলে হু হু করে কাঁদতে থাকেন কিরণময়ী।
সুরঞ্জন কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে পেছনে ক্রন্দনরত কিরণময়ীকে রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। তার ভালো লাগে না কিছু। কাকে সে দোষ দেবে, নিজেকে নাকি কিরণময়ীকে, বুঝে পায় না। জুলেখার খোঁজ করা, বা কোনও বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় বসা, কিছুই করে না সে। পার্ক স্ট্রিটে একটা বারে বসে একা একা মদ খেতে থাকে। জুলেখার ফোন এসেছিল, কেটে দিয়েছে। অন্য দু একজন বন্ধুর ফোন ধরেনি। চার পেগ খাওয়ার পর নিজে সে সোবহানকে ফোন করে।
কী খবর?
আর খবর?
ভালো আছো তো?
আছি। এই থাকাকে ভালো থাকা বলে কি না জানি না।
মাসিমা ভালো?
সবাই একইরকম। জীবন এরকমই। সুখ আসে, দুঃখ আসে। সুখ যায়, দুঃখ যায়।
-অনেকদিন পর ফোন করলে। তোমাকে তো পাওয়া যায় না ফোন করে। ফোন অফ করে রাখো।
-ফোন ব্যাপারটাই বিচ্ছিরি লাগে।
ওপাশে সোবহান হাসে।
-তোমাকে খুব মিস করছি সোবহান।
-তাই?
-হ্যাঁ খুব।
-তাহলে ফোন টোন তো করো না।
-ফোনে কথা বলে খবরাখবর জানা এসব আমার কাছে খুব সুপারফিসিয়াল লাগে। মুখোমুখি বসে কথা বলতে হয়। চোখের দিকে তাকিয়ে স্পর্শ করতে হয়।
-তুমি কোথায় আছো বলো, আমি চলে আসি।
চলে এসো।
সোবহান ধর্মতলার দিকে ছিল। বেলঘরিয়ায় ফিরে যাওয়া বাদ দিয়ে পার্ক স্ট্রিটে সুরঞ্জনের কাছে চলে আসে। দুজন মুখোমুখি বসে। অনেকদিন পর। হ্যাঁ অনেকদিন পর। কতদিন? দুমাস পর দেখা। দুমাসকে দুজনেরই মনে হচ্ছে বুঝি দু বছর।
সোবহান মদ খাবে না।
-তোমাদের মুসলমানদের এই একটা বাজে স্বভাব। মদ খাবে না। গরু খাবে। আমাদের দেবতাগুলোকে খেয়ে সর্বনাশ করে দিলে। সুরঞ্জন বলে।
সোবহান জোরে হেসে ওঠে।
-মুসলমানরা আমার সর্বনাশ করেছে সোবহান। আমার নিজের দেশ গেছে। একটা লাইফ ছিল আমার আমার দেশে। আমার প্রেমিকা, আমার কেয়ারিং ফ্রেন্ডস ছিল। সব গেছে। এখন কোথায় আছি, কেন আছি, জানি না। কী রকম আছি? বলো তো। এই দেশটা তোমার দেশ। আমার দেশ না। তুমি এদেশে জন্মেছো, তোমার চৌদ্দ পুরুষ এ দেশে জন্মেছে। আমার কেউ এ দেশে জন্মায়নি। এই মাটিতে কেউ না। এ দেশটায় তোমার শত্রু আছে বন্ধু আছে, এ দেশটা এ মাটিটা তোমার। আমি তোমার ল্যান্ডকে নিজের ল্যান্ড বলে মনে করছি। মুসলমানের কারণে আমার সর্বনাশ হয়েছে। তাদের কারণে আজ জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখি না। আমার পুরো ফ্যামিলি শেষ। বুঝলে তো, শেষ। আমার বাবা শেষ, বোন শেষ, আমার মা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর আমি তো...
সোবহান বলে তুমি তো কী?
-আমি তো সেই কবেই শেষ। এই যে তুমি দেখছো আমাকে। এটা আসলে আমি নই। এ আমার ডেডবডি।
সুরঞ্জন আরও একটা লার্জ রয়েল স্টেগ এর অর্ডার দেয়। সোবহান ঠাণ্ডা জল চায়।
-বুঝলে সোবহান, এখানে মাঝে মাঝে দেখি যে বাবা তার ছেলেমেয়ে বউকে মেরে তারপর নিজে মরে। দেখ না? দেখ না এমন খবর?
হ্যাঁ। দেখি। দেখি না শুধু, পড়িও।
-পড়। পড়বেই তো। আমার এসকেপিস্ট বাবা সেটা করেনি। বুঝলে তো, আমার বাবা পালিয়েছে। একা একা পালিয়েছে। এমন জায়গায় পালিয়েছে যে তাকে তার শার্টের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে পার্ক সার্কাসের কানা গলিতে বা সচিন সেন নগরের বস্তিতে যদি ফেলতে পারতাম। ধরো চার নম্বর ব্রিজের বস্তিতেই যদি ফেলতে পারতাম, তাহলে তো কথাই ছিল না। পালিয়েছে মানুষটা। এতকাল সেকুলারিজম, কমিউনিজম, সোশালিজম, একজিসটেনশিয়ালিজম, পেট্রিয়াটিজম এইইজম, সেইইজমের গপ্প শুনিয়ে ব্যস ফুড়ুৎ। শালা স্বার্থপর। আমার বাবাটা ছিল একটা শিশুর মতো, আবার শয়তানের মতো।
সোবহান বসে বসে শুনতে থাকে সুরঞ্জনের কথা আর বলতে থাকে মদ আর না খেতে। বাড়ি যেতে। সুরঞ্জন বলে দেয় বাড়ি আজ সে ফিরবে না। ও বাড়িতে ফিরতে তার ভালো লাগে না। ও বাড়ি কিরণময়ীর বাড়ি। অপদার্থ ছেলেকে মায়েরও আর সহ্য হচ্ছে না। ছেলে যদি টাকা দিতে না পারে, তাহলে ছেলেও আর ছেলে থাকে না।
-বুঝলে সোবহান। তোমার মতো একটা ইঞ্জিনিয়ার হলে, দেদার টাকা কামালে দাম থাকতো। তোমাকে তো আবার কার্তিক পুজোর চাঁদা দিতে হয়। হা হা হা।
সোবহান খাবার খেতে থাকে। সুরঞ্জনকে বলে বলে খাওয়ায়। খেতে গিয়ে সে ছড়িয়ে ফেলে সব। আরও মদ খাবে গোঁ ধরে। সোবহান ওয়েটারদের আর কোনও মদ দিতে বারণ করে দেয়। বিল মিটিয়ে সে ওঠে সুরঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠায়।
-বাড়ি যাবে তো?
-না। সুরঞ্জন বলে, বাড়ি আমি যাবো না।
-তাহলে যাবে কোথায়?
-তুমি যেখানে যাও, সেখানে যাবো।
আমি তো বাড়ি যাবো।
তোমার সাথে যাবো আমি।
কেন, বাড়ি যাবে না কেন?
আই হেইট মাই মাদার।
বাজে কথা বলো না। বাড়ি চলো।
অত ভালো মানুষ সেজো না সোবহান। তোমার সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডশিপ। হোল ফ্যামিলি নিয়ে আমি তোমার ফ্রেন্ড হইনি। আমাকে টেক কেয়ার কর। গুলি্ল মারো ফ্যামিলি। মাসিমাকে একটা ফোন করে দাও যে বাড়ি ফিরবে না। বাড়িতে ফোন নেই।
চিন্তা করবেন তো।
করুক। আই কুডনট কেয়ার লেস। আমার কিছু যায় আসে না। সোবহান আরও কিছুক্ষণ অনুরোধ করে। কিছুতেই আজ সুরঞ্জন বাড়ি যাবে না। অগত্যা ডানলপের মোড়ে যেতে বলে ট্যাক্সিক। না ট্যাক্সি ওদিকে যাবে না। শ্যামবাজার অবধি যাবে। তাই সই। শ্যামবাজার থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি। পথে সোবহান এক হাতে ধরে রাখে সুরঞ্জনকে। আবার পড়ে না যায়। আগে তাকে দেখেছে মদ খেয়ে অর্থহীন কথা বলতে। কিন্তু আজ সীমা ছাড়িয়ে খিস্তি করছে সুরঞ্জন। যেতে যেতে সুরঞ্জন বলে, জানো সোবহান, মন দিয়ে শোনো। তোমাকে একটা কথা বলছি। কাউকে বলবে না। এটা খুব সিক্রেট। সিক্রেট, বুঝলে তো!
[চলবে]