শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

জাতীয়তাবাদের সীমা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জাতীয়তাবাদের সীমা

শিল্পকর্ম : শাহাবুদ্দিন আহমেদ

'জাতীয়তাবাদের সীমা' শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো ২৫তম পর্ব-

 

সেই সময়ে বিধবা বিবাহের নিষেধ এবং বাল্য বিবাহের বিধিকেও তিনি সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন, 'পরিবারের দৃঢ়তা ও অখণ্ডতা রক্ষা করিতে হইলে ক্ষতি স্বীকার করিয়াও এই সব নিয়ম পালন করিতে হয়।' সমাজকে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের চেয়েও বড় মনে করতেন। সমাজে যে বহু রকমের গলদ আছে তা অবশ্যই জানতেন। তবে সমাজের সংস্কারই চেয়েছেন, বিপ্লব নয়। রাষ্ট্রকে তিনি মুখ্য বলে গণ্য করতেন না, কিন্তু রাষ্ট্র যে কতটা শক্তিশালী ছিল সেটা তো তার ধারণার বাইরে ছিল না। ইংরেজের রাষ্ট্র ভালো নয়, এটা তিনি জানিয়েছেন। তাকে ভাঙতে অসম্মত ছিলেন না; কিন্তু ভাঙার ব্যাপারে বল প্রয়োগের বিষয়ে তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। স্বাধীনতার যে প্রয়োজন এ কথা তিনি সর্বদাই বলেছেন; কিন্তু স্বাধীনতার চেয়েও মুক্তি যে বড় এটা বলতে ভোলেননি। তবে মুক্তির জন্য তিনি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের চেয়েও অধিক প্রয়োজন রিপুর বন্ধন ছিন্ন করা বলে জানিয়েছেন। যেমন, তিনি বলেছেন- ইউরোপে স্বাধীনতাকে যে স্থান দেয়, আমরা মুক্তিকে সেই স্থান দিই। আত্দার স্বাধীনতা ছাড়া অন্য স্বাধীনতা আমরা মানি না, রিপুর বন্ধনই প্রধান বন্ধন- তাহা ছোট করিতে পারিলে রাজা-মহারাজার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পদ লাভ করি।

রবীন্দ্রনাথের মতো বাস্তববাদী লেখক ও মানুষ সব যুগেই বিরল। কিন্তু তিনিই ভাববাদীদের মতো করে বলছেন, 'সমাজ তো একমাত্র বস্তুতান্ত্রিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তার যথার্থ ভিত্তি আমাদের মনে।' খেয়াল করছেন না যে মন জিনিসটা আকাশে থাকে না, থাকে বস্তুজগতে, সেই জগতের রঙেই সে রাঙা হয়, তার গতিধারা দিয়েই সে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। 'নেশন' কথাটা তার চিন্তায় এসেছে। না-এসে উপায় ছিল না। নেশন-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি আবার সেই একই ভাববাদিতার দ্বারস্থ হয়েছেন। তার ধারণা 'নেশন' একটি মানস পদার্থ। জাতি, ভাষা, বৈষয়িক স্বার্থ, ধর্মের ঐক্য ও ভৌগোলিক সংস্থান এর মূল উপাদান নয়। মূল উপাদান হচ্ছে দুটি। একটি অতীতে অবস্থিত আর একটি বর্তমানে। 'একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ, আর একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা।' কিন্তু এই স্মৃতি ও সম্মতিতে হিন্দুত্ব রয়েছে। 'ভারতবর্ষীয় সমাজ' নামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'হিন্দু সভ্যতা যে এক অত্যাশ্চর্য প্রকাণ্ড সমাজ বাঁধিয়াছে, তাহার মধ্যে স্থান পায় নাই এমন জাত নাই।' 'স্বদেশী সমাজ' নামের বহুল-আলোচিত প্রবন্ধটিতে তিনি দেশকে জননী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দেশের পরিচয় 'বন্দে মাতরমে'র মাতৃমূর্তি থেকে অবশ্যই স্বতন্ত্র, কিন্তু ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিরোধের আবহাওয়াতে এটি যে মুসলমানদের মনে ঐক্যের বোধ সৃষ্টি করতে সহায়ক হওয়ার কথা নয় সেটা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। আবেদনের আন্তরিকতা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে অন্তর্গত বর্ণনায় : [...] আসুন [...] আমাদের দেশের মাতৃগৃহকক্ষে মঙ্গলপ্রদীপটিকে উজ্জ্বল করিয়া তুলি- শঙ্খ বাজিয়া উঠুক, ধূপের পবিত্র গন্ধ উদ্গত হইতে থাক্- দেবতার অনিমেষ কল্যাণ দৃষ্টির দ্বারা সমস্ত দেশ আপনাকে সর্বতোভাবে সার্থক বলিয়া একবার অনুভব করুক।

এ বক্তব্যে যে আবহাওয়াটা তৈরি হয় মুসলমানদের দৃষ্টিতে তা হিন্দুয়ানি, যদিও রবীন্দ্রনাথ এখানে বাঙালি সমাজের কথাই বলছেন। এ সমাজে হিন্দু আছে, মুসলমানও আছে, কিন্তু তাদের পরিচয় হওয়া চাই এই যে তারা বাঙালি। বাঙালির আত্দপরিচয় সম্পর্কে 'বাংলা ভাষা পরিচয়' প্রবন্ধে তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, বাঙালি যে বাঙালি তার কারণ সে বাংলা ভাষায় কথা বলে। 'স্বদেশী সমাজ'-এ বলা হচ্ছে যে, সমাজের জন্য নেতা আবশ্যক হবে। প্রথমে তিনি একজন সমাজপতির কথা ভেবেছিলেন, পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন দুটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কারণে দু'জন নেতার কথা বলেছেন- একজন হিন্দু, অপরজন মুসলমান। তবে সমাজের ভেতর যে সামঞ্জস্য থাকবে সে ক্ষেত্রে কিন্তু হিন্দুত্বের কথাই শুধু ভেবেছেন। তার ভাষায়, 'সেই সমাজের সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু'। ধারণা করা অন্যায় নয় যে, এই কথাটা বলার সময় তিনি আর বঙ্গভূমির কথা ভাবছেন না, তার কল্পনা, হয়তোবা তার অজান্তেই, চলে গেছে ভারতবর্ষে। ইতিহাস এ কথা বলে যে, বাঙালির চিন্তা ও কল্পনা যখন ভারতবর্ষে চলে যায় তখন তার পক্ষে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে, সর্বভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সে হয়ে পড়ে হয় হিন্দু নয় তো মুসলমান। এটা রাজনীতিকদের বেলায় ঘটেছে, ঘটেছে বাংলার সাহিত্যের বেলায়ও; ঘটেছে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও।

রবীন্দ্রনাথ তার লেখায় প্রায়শ 'আমাদের' কথা বলেন। এই 'আমরা' একাধারে ভারতীয়, বাঙালি, এবং যখন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে তখন হিন্দু। 'আমরা' আবার শিক্ষিত মধ্যবিত্তও। কৃষকরা সর্বদাই ওরা, মুসলমানরাও অনেক সময়ে ওরা'দের সারিতে শামিল হয়ে যায়। 'জিজ্ঞাসা ও উত্তর' নামের প্রবন্ধে তিনি বলছেন, 'প্রশ্নকর্তা হয়তো জিজ্ঞাসা করিবেন, আমরা হিন্দু জাতি বলিলে যাহা বুঝি, সে জাতিত্ব কিসে স্থির হয়? তাহার উত্তর ধর্মে।' [ চলবে ]

 

 

সর্বশেষ খবর