শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

শামসুর রাহমানের গদ্যসনেট

কাবেদুল ইসলাম

শামসুর রাহমানের গদ্যসনেট

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬), পোট্রেট : কাইয়ুম চৌধুরী

একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা বা কাব্যভাবনার শ্রেষ্ঠকবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। এ উক্তি ও দাবি আমরা তার পূর্ববর্তী খ্যাতিমান কবিদের কীর্তিগাথা বিশেষত ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৬) ও আহসান হাবীব (১৯১১-৮৫) এবং তার সমসাময়িক বিশেষ করে আরেক প্রধান ও তুমুল জনপ্রিয় কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-)-এর কথা মনে রেখেই করছি। বস্তুত কবিতার নিরন্তর বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তুর চয়ন ও তাতে আধুনিকতার বীজ বপনে ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মননশীল চিন্তার অনুশীলন, সংবেদনশীলতা ও দেশি-বিদেশি ইতিহাস-পুরাণ সাঙ্গীকরণে ক্ষান্তিহীনতা, সর্বোপরি স্বসমাজ ও সমকালীন রাজনীতি বা স্বদেশভাবনার প্রত্যক্ষ চিত্রায়ণ সত্ত্বেও কবিতাকে শেষ পর্যন্ত তার আবশ্যিক শর্তযুক্ত গণ্ডিতে অর্থাৎ কবিতায় সং-আত্দস্থ রাখার সদর্থক দায়বদ্ধতা প্রভৃতি তাকে স্বদেশজ পূর্বসূরি, সমসাময়িক ও উত্তরচারীদের থেকে পৃথক, বিশিষ্ট ও অনন্য করেছে, তা বলাই বাহুল্য। (দেখুন, মৎপ্রণীত শামসুর রাহমানের সনেট : বিষয়বস্তু ও গঠনশৈলী, উত্তরণ, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৯) তবে এ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার ক্ষেত্র এটি নয় বিধায় আমরা এখানে তার সুবিস্তৃত কাব্যপরিমণ্ডলের একটি বিশেষ দিক- তথাকথিত গদ্যসনেট নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা করব।

এক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা বলার তা হলো, মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮৩৪-১৮৭৩) থেকে শুরু করে শামসুর রাহমানের আগে পর্যন্ত বাংলা ভাষায় গদ্যসনেট নামে কোনো সনেট কেউ লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। আর লিখলেও আমাদের নিম-পাঠাভিজ্ঞতায় সেটি ধরা না-পড়ায় সে জন্য আমাদের অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধ কবুল করছি। ফলত বিষয়টি যদি সত্য হয়, তবে অবশ্যই স্বীকার্য যে, এ বিষয়ে বা অন্য কথায় বাংলায় গদ্যসনেট রচনায় তিনিই প্রথম পথপ্রদর্শক বা পথিকৃৎ।

আমাদের জানা মতে, শামসুর রাহমানের মোট ৬৭টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে গদ্যসনেট : ১, গদ্যসনেট : ২ ইত্যাদি ধারাক্রমে তার সাকুল্যে ১৫টি গদ্যসনেট দৃষ্ট হয়; এবং সেটিও একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থে, যথা 'তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি'; এতে অন্তর্ভুক্ত নিয়মিত বা গতানুগতিক সনেটের পাশাপাশি প্রথমে একাধিক্রমে ৯টি, পরে ১টি, আরও পরে ৩টি ও শেষে ২টি- সব মিলিয়ে মোট ১৫টি গদ্যসনেট গ্রন্থিত। তবে বলা বাহুল্য যে, এগুলো আদৌ সনেট পদবাচ্য কিনা অর্থাৎ সচরাচর 'সনেট' বলতে আমরা যে প্রথাবদ্ধ ও অাঁটসাঁট কাব্যকলা বা রীতির গীতিকবিতাকে বুঝি, তাতে এগুলোকে ফেলা যাবে কিনা, স্থানাভাবে সে সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা যাব না। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে, প্রাগুক্ত শামসুর রাহমানের সনেট : বিষয়বস্তু ও গঠনশৈলী) তবে এগুলোর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করব।

প্রথমত ১৫টি গদ্যসনেটের সবকটিই ১৪-পঙক্তিসমন্বিত। এর মধ্যে গদ্যসনেট : ১ থেকে গদ্যসনেট : ১৪ ধারাক্রমে বিন্যস্ত সনেটসমুচয়ে ৮-চরণে 'অষ্টক' ও ৬-চরণে 'ষটক' বিভাগ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ১৫-সংখ্যক গদ্যসনেটটি ৬+৪+৪ পঙক্তিভাগে বা স্তবকে গ্রন্থিত। ফলে দেখা যায়, প্রথাবদ্ধ ও নিয়মিত ধাঁচের সনেটের দুটি শর্ত অর্থাৎ ১৪-পঙক্তির সমাবেশ ও 'অষ্টক'-'ষটক' বিভাগ অধিকাংশ গদ্যসনেট পূরণ করেছে।

দ্বিতীয়ত এবং যেটা সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য ও সনেটরচনার জন্য গাঢ়পিনবদ্ধতার নিদারুণ অভাব, তা হলো এর পঙক্তিগুলোর অক্ষরপাতের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট বা একক নিয়ম-নীতি মান্য করা বা এতে প্রতিফলিত হয়নি। বরং অক্ষরবিন্যাসে যারপরনাই বিশৃঙ্খলাই পরিদৃশ্যমান। কার্যত তার অনুসরণে যদি কেউ 'গদ্যসনেট' লিখতে অনুপ্রাণিত হন, যেমনটা ইতালীয় বা ইংরেজি সনেটের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি (শামসুর রাহমান) সহ অনেকেই বাংলা ভাষায় সনেট লিখেছেন; বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই সামনে একটা নিরূপিত মান বা আদর্শ থাকে বা থেকেছে। ফলে সনেট লেখা সহজসাধ্য হয়েছে এবং রসবোদ্ধা ও সমালোচকের জন্য আগে থেকে এক বা একাধিক মানদণ্ড সুনির্দিষ্ট থাকায়/হওয়ায়, তার বা তাদের পক্ষে প্রচলিত 'ফর্মে'র আদর্শে লিখিত সনেটের রসাস্বাদন ও বিচার সম্ভব হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে শামসুর রাহমানের গদ্যসনেট এরূপ বিশেষ কোনো আদর্শ প্রতিস্থাপন করে না। বস্তুত কোনো আদর্শ রূপরেখা বা 'ফর্ম' প্রতিষ্ঠা না করাই শামসুর রাহমানের তথাকথিত গদ্যসনেটের মুখ্য দুর্বলতা। কাজেই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-রীতির অবর্তমানতা ও আদর্শহীনতার কারণেই মূলত এগুলোকে আমরা আদৌ সনেট বলার পক্ষপাতী নই। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে এগুলো গদ্যসনেট। সুতরাং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তা বিচার্য। এ প্রশ্ন সঙ্গত হলেও একই কারণেই তা অগ্রহণীয়ও বটে। কেননা গদ্যকবিতা বলতে আমরা যে ধরনের কবিতাকে বুঝি, তারও কিছু বৈশিষ্ট্য বা শর্ত থাকে, অন্যভাবে বললে প্রচলিত গদ্যকবিতার ছন্দে যে মুক্তকচ্ছগতি, সেটিও এখানে প্রায়শ অনুপস্থিত। যাই হোক, আমরা নিচে দুটি সম্পূর্ণ গদ্যসনেট পরপর উদ্ধৃত করছি, যা থেকে বুঝা যাবে এগুলোর ছন্দে, বিশেষত পঙক্তির দৈর্ঘ্যবিন্যাসে কী অপরিসীম স্বেচ্ছাচারিতা বিদ্যমান।

[ক] গদ্য সনেট : ৯

"বহুকাল থেকে দেখছি সুখ আমার বেশিদিন/সয় না। বালকবেলা আম্মার দেওয়া ইস্কুলের/টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মহানন্দে দুলদুল ঘোড়ার/একটা রঙিন ছবি কিনেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই সেটি কোথায়/হারিয়ে গেল, তার হদিসই পেলাম না আর। যখন আমি/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আব্বা আমাকে কফি রঙের একটি শেফার্স কলম/কিনে দিয়েছিলেন, পেয়ে কী-যে সুখী হয়েছিলাম; কিন্তু/পুরনো না হতেই সেটি চলে গেল পকেটমারের কব্জায়।//গতকাল অনেকদিন পর সকালে টেলিফোনে গৌরীর/কণ্ঠস্বর শুনে কী-যে সুখ পেয়েছিলাম, কী করে বোঝাবো অন্য/কাউকে? আমার দেহমন হয়ে উঠেছিল উৎসবের আলোকসজ্জা।/দুপুরেই রিসিভার রাগী কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ/করছিল, কিছুক্ষণ পরেই স্তব্ধ। হায়, এমনই বরাত আমার, ক'দিন/তার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না, দেখা হওয়ার পথও বন্ধ।"

[খ] গদ্য সনেট : ১৫

"তোমার অভিমানগুলো রাতের দেয়ালে/মাথা কুটে কুটে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল/নিঝুম মেঝেতে এবং আমি/সেগুলো জড়ো করে একটি পুষ্পস্তবক বানিয়ে/তার চৌদিকে ভ্রমরের মতো/গুঞ্জরন তুলি। সেই সুর নকশা অাঁকে নৈশ প্রহরে।//তোমার দুচোখের কান্না, হৃদয়ের অশ্রু-ফোঁটা শ্রাবণ-দুপুরে,/বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে ঝরতে থাকে অবিরল;/আমি সেই অশ্রুকণাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে/তৈরি করি মুক্তার এক অনুপম হার।//রাতজাগা পাখির বুকে পুষ্পস্তবক আর/মুক্তোর হারের কবিতা লিখে/তাকে পাঠিয়ে দিলাম শুকনো মেঘের কাছে;/মেঘ ওকে আলিঙ্গন করে ভিজে উঠলো ঝরে পড়ার জন্যে।"

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তোলা যায়, 'সনেট' বলতে যে কঠোর প্রথাশাসিত রূপবন্ধে ও ছন্দে, সুসংহত ভাবের কবিতা লেখা হয়, তা এ থেকে আদৌ লভ্য নয়। বস্তুতপক্ষে কেবল ১৪-পঙক্তির সমন্বয় ও 'অষ্টক'-'ষটক' বিভাজন ছাড়া সনেটের জন্য আবশ্যকীয় আর কোনো নিয়ম-রীতিই গদ্যসনেটগুলোতে নেই। সুতরাং আবারও বলছি, এগুলোকে সনেট বলার পক্ষপাতী আমরা নই। তবে সাধারণ গদ্যকবিতা হতে এগুলোর কোনো বাধা নেই।

যাই হোক, আপাদমস্তক ছন্দশাসিত কবি শামসুর রাহমানের যে চিরাচরিত বিশিষ্টতা, যেমন ভাব বা বিষয়বস্তু, ছন্দ, অলঙ্কার, স্বকীয় ভাষাশৈলী এবং বিশেষত বাকভঙ্গি বা চিত্রকল্প ও আবিশ্ব পুরাণচারিতা প্রভৃতির অনায়াস চিত্রণ তার কবিতায় ঘটে থাকে, তথাকথিত গদ্যসনেটেও সে সম্পর্কিত কিছু ইঙ্গিত দিয়ে বর্তমান আলোচনা শেষ করব।

শামসুর রাহমানের গদ্যসনেটে ভাব-বিষয়বস্তু খুবই সীমিত, মাত্র ১৫টি কবিতায় সেটি হওয়াই স্বাভাবিক বটে। তবে এককথায় যদি বলতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে যে, এগুলোর ভাবে-বিষয়ে প্রেমিকাপ্রীতি বা প্রেমই মুখ্য। অধিকন্তু এতে অন্য যে দু'একটি বিষয় এসেছে, তাও অনেকটা প্রেম-ভাবনার সোপান ধরেই। এতে কবি বেশকিছু চমৎকার উপমা ব্যবহার করেছেন, যদিও সঙ্গত কারণে উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদি অলঙ্কার এবং চিত্রকল্পের সংশ্লেষ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। নিচে দেখা যাক, এর দু-একটা : [ক] "আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দুর্ভিক্ষকবলিত/বিশুষ্ক, করুণ মানুষের মতো ত্রাণসামগ্রীর আশায়?" (গদ্যসনেট : ৫)// [খ] "আমি কি বলিনি আমাকে তুমি এভাবে দণ্ড দিও না/কখনো, যা আমার রক্ত শুষে নেয় ড্রাকুলার মতো?" (গদ্যসনেট : ৬)// [গ] "এখন আমি স্নিগ্ধ সরোবরে সাঁতার কাটছি আর তোমার দিকেই/ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে মাছের মতো আমার দু'টি স্পন্দিত হাত।" (গদ্যসনেট : ৮)// [ঘ] "দুপুরেই রিসিভার রাগী কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ/করছিল, কিছুক্ষণ পরেই স্তব্ধ।" (গদ্যসনেট : ৯)// [ঙ] "সেগুলো জড়ো করে একটি পুষ্পস্তবক বানিয়ে/তার চৌদিকে ভ্রমরের মতো/গুঞ্জরন তুলি।" (গদ্যসনেট : ১৫)

তার চিত্রকল্পে দৃশ্যলোক ও তার মধ্যদিয়ে মনোবিশ্বে উদ্ভাসিত স্বপ্ন-কল্পনা কখনো কখনো দূরবিস্তৃতই শুধু নয়, কখনো তা একই সঙ্গে ভীতি, গাম্ভীর্য ও সর্বোপরি সৌন্দর্য জাগিয়ে তোলে, যেমনটা এ-পঙক্তিবলয়ে পাই : "আমার ওপর ছুটে যাচ্ছে নাদির শাহের কেশর দোলানো/অশ্বপাল, তৈমুরের নাঙা তলোয়ার আমাকে ক্রমাগত/রক্তাক্ত করছে এবং মেরুপ্রদেশের ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল/আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমি আর কত সইব এই স্বৈরাচার?" (গদ্যসনেট : ৫)

আবার ক্বচিৎ তা অনাস্বাদিত মুগ্ধতার বেশুমার ফল্গুধারাও ছড়িয়ে দেয় : "আজ আমি পদ্মফুলের অজস্র/পাপড়ির আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছি, আমার সকল/রোমকূপে আনন্দধারা, এই মুহূর্তে আমি বসন্ত বাহার;/কেননা, দু'সপ্তাহ পর তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি।/... যে অভিমানের জ্বালা ধরানো/ক্রূর শুঁড়গুলি ক্ষত তৈরি করছিল হৃদয়ে, সেসব/এখন শুকনো পাতার মতো খুলে গ্যাছে, ...।" (গদ্যসনেট : ৮)

গদ্যসনেট শরীরে শব্দসম্পদ স্বীকরণে শামসুর রাহমান বরাবরের মতো বাংলা ভাষার প্রধান শব্দোৎস তথা তৎসমের অনুগামী। তবে কোনো ছুঁৎমার্গে যে বিশ্বাসী নন, তার প্রমাণ এই শব্দ-সড়কে তিনি নিতান্ত গ্রাম্য ও বিদেশি শব্দকেও অসঙ্কোচে স্থান দিতে কসুর করেন না। তাই তার গদ্যসনেট লভ্য- 'আন্ধারে' (গদ্যসনেট : ১, ১২), 'ওলান' (গদ্যসনেট : ১৩), সোফা/সোফাসেট, টেলিফোন, রিসিভার, ক্যাসেট প্লেয়ার, মিনিট, র্যাক, লাইন, ইস্কুল, টিফিন, সিগারেট, (ডাক) টিকিট/বাক্স, সাইকেল, এনজিও, স্যান্ডেলিয়া, পেন্টিং, কফি, শেফার্স, বাসন (পর্তুগিজ), কফিন, শীশমহল, ফজরের আজান, মুয়াজ্জিন, তালাশ, সুফী, আলখাল্লা, (বসন্ত) বাহার ইত্যাদি ইংরেজি ও আরবি-ফারসি শব্দ।

তার প্রচলিত নিয়মের সনেটে প্রকৃতি সচরাচর খুব প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক না হলেও প্রকৃতিবিশ্বের অন্যতম উপাদান প্রাণিজগতের রয়েছে বিশেষ প্রাধান্য। গদ্যসনেটও এর ব্যতিক্রম নয়। এগুলোতে কবি প্রাণিকুলের নিম্নবর্গের কথা যেমন বলেছেন, যথা গন্ধমূষিক (গদ্যসনেট : ১, অতঃপর কখনো কখনো 'গস' হিসেবে উলি্লখিত), ইঁদুর, বাদুড় (গস : ১, ৩), ভ্রমর (গস : ২, ১৫), মাছ/কেলিপরায়ণ মাছ (গস : ২), রাতজাগা-/নীল পাখি (গস : ৭), দোয়েল (গস : ৫, ১২), শঙ্খচিল (গস : ১০), খয়েরি বাছুর ও গাভি (গস : ১৩), তেমনি তুলনামূলক শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর প্রাণীর উল্লেখও করেছেন যথা কুকুর (গস : ৯), অশ্ব, নেকড়ে (গস : ৫) ইত্যাদি। তবে আলোচ্য সনেটগুলোতে তার গাছ বা ফুলসংলগ্নতা অপেক্ষাকৃত কম। বস্তুত ৪টি মাত্র সনেটে পাই 'পলাশ' (গস : ৭), 'পদ্মফুল' (গস : ৮), 'বুনোঘাস' (গস : ১০) ও 'লাল শাপলা ফুল' (গস : ১২)।

তার সনেটের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তাতে প্রায়শ তার সমসাময়িক ও পূর্বসূরি কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা, এমনকি শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোও উজ্জ্বল স্থান করে নেয়। এর মধ্যে বিখ্যাত ও কীর্তিমানরা যেমন থাকেন, তেমনি কুখ্যাতদেরও তাতে সমানাধিকার। তাই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ (গস : ২), গালিব (গস : ৪), লালন (গস : ১২), ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, নটরাজ উদয়শঙ্কর (গস : ৭) যেখানে থাকেন, সেখানে নাদিরশাহ, তৈমুর লঙ (গস : ৫)-এর মতো দিগ্বিজয়ী কিন্তু নৃশংসচিত্ত পুরুষরাও ভিড়ে যান। আবার 'ড্রাকুলা'র মতো ভয়ঙ্কর, রক্তচোষক কাল্পনিক চরিত্রও গোপনে হানা দিয়ে যায়। অবশ্য তার অগণিত কবিতা ও নিয়মিত সনেটের মতো তথাকথিত গদ্যসনেটেও পুরাণ বা 'মিথ'-এর প্রতি অনুরাগ কবিতায় অন্যরকম আবহ নিয়ে আসে প্রায়শ। এখানে দেশকাল, জাতপাত সীমানিরপেক্ষ তিনি, তা স্বীকার করতেই হবে। পরিশেষে বলতে পারি, কোনো সুনির্দিষ্ট নিরিখে তথা সনেটীয় বিধি-নিয়মের মানদণ্ডে তার গদ্যসনেটগুলো উত্তীর্ণ না হলেও গদ্যকবিতা হিসেবে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য এবং আস্বাদ্যতা অলঙ্ঘনীয়। একই কারণে তার প্রচলিত ধারার কবিতাগুলোর মতোই এতে তার চিরাচরিত চারিত্র্য ও দার্ঢ্য সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

 

সর্বশেষ খবর