শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

শরম (৩০তম পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (৩০তম পর্ব)

অলঙ্করণ : আহমেদ তারেক

'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

দুজন একসঙ্গে থাকবো, একটা বাড়ি, একটা উঠোন, কিছু গাছপালা, একসঙ্গে চা, একসঙ্গে খাওয়া, একটা বিছানা, রাতে বাড়ি ফেরা, শোয়া, শুয়ে আদর আহলাদ, একটা বাচ্চা, একটা ইস্কুল, টাকা পয়সার হিসেব, পাকা চুল, অবসরজীবন, নাতি নাতনি, মৃত্যু। চোখের সামনে নিশ্চিত ওই জীবন। সুখের স্বস্তির জীবন।

ভাবলে সুরঞ্জনের গা কাঁপে। রিশপে রাত্তিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জড়াজড়ি করে শুয়ে স্বপ্নের কথা বলছিল দুজন। সারারাত। আকাশে চাঁদ ছিল, চাঁদের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা যে কী অপরূপ হয়ে উঠতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। জুলেখার সঙ্গে তার সবচেয়ে ভালো সময় ওই রিশপেই কেটেছে। এক জীবনে আর কী দরকার! ওই স্মৃতি নিয়ে তার বাকি জীবন চমৎকার কেটে যাবে। জুলেখা থাকুক তার মতো করে, সুখে। সুখে থাকাটাই তো আসল। ওই স্বপ্নগুলো সামনে থাকলেই সুখে থাকা চায়। পূরণ হয়ে গেছে তো স্বপ্ন বলতে তখন কিছু থাকে না। সুখে কাটানোর চেয়ে সুরঞ্জনের মনে হয় সামনে সুখের স্বপ্ন নিয়ে অসুখে কাটানো ঢের ভালো। এতে উত্তেজনা থাকে। উত্তেজনা না থাকলে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ শীতল একটি জীবন নিয়ে চরমতম হতাশার অন্ধকারকে সঙ্গী করে ঠায় বসে থাকতে হয়। সে নিজে যেমন বসে আছে। জুলেখা চেষ্টা করে তার জোয়ার দিয়ে মাঝে মাঝে সুরঞ্জনের মধ্যে তরঙ্গ তুলতে। ওঠে তরঙ্গ, কিন্তু কাছে সে না থাকলে আবার শান্ত হয়ে যায় চরাচর। সম্ভবত মেয়েটি তাকে নিয়ে আর কোনও স্বপ্ন দেখে না। না দেখুক। একবার শুধু মাঝে এসএমএস পাঠিয়েছে, কোথায়? লিখে। উত্তর দিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে। ব্যস। আর কোনও কথা নেই। সুরঞ্জন একবার আই মিস ইউ লিখেও সেন্ড করেনি। সত্যিই সে জুলেখাকে কি মিস করছিল? তখন মনে হয়েছে না করছে না। বরং একটা বই নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতেই তার মনে হয়েছে জুলেখার সঙ্গে প্রেম করার চেয়ে ভালো। বরং তার মনে হয়েছে সোবহানের সঙ্গে গল্প করাও ওই প্রেম করার চেয়ে ভালো। এখন মায়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো মনে হচ্ছে ঢের আনন্দের কাজ। জুলেখার সঙ্গে সম্পর্কটা সম্ভবত গড়ে উঠেছিল তার নিঃসঙ্গতার কারণে। কিছু অসৎসঙ্গের সঙ্গে টানা পোড়েন, নিজের মধ্যে কিছু ভাঙাচোরা, ঠিকানা পাল্টানো, শুরু থেকে সবকিছু শুরু করা, আগের জীবন ঝেঁটে বাদ দিয়ে নতুন জীবন গোছাতে গেলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতাই ঢুকিয়েছিল জুলেখাকে। প্রায়শ্চিত্ত_ ওসব বাজে কথা। প্রায়শ্চিত্ত কখনও কিছু দিয়ে হয় না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। জুলেখাকে যেভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল, তা কোনও দিন ওর জীবন থেকে মুছে দেওয়া যাবে না। ধর্ষকগুলোকে সব ফাঁসি দিলেও ওই বীভৎস স্মৃতি জুলেখা যতদিন বাঁচে, বেঁচে থাকবে তার সঙ্গে। তার শ্বাসের সঙ্গে শ্বাস নেবে স্মৃতি।

বাড়িটা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে দেখতে। এখন মায়ার স্বপ্নের সংসার গড়ে উঠছে বাড়িটায়। শ্বশুরবাড়ির কেউ এখনও খবর অবধি নেয়নি। কিরণময়ীর খুব ভালো লাগছে দেখতে যে মায়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিদিনকার দুঃসহ জীবন থেকে নিজেকে মুক্তি দেবে। দিতে কি সত্যিই পারবে? আবার হঠাৎ কখন কার ওপর বিগড়ে যায়, কখন আবার কারও আচরণে মন খারাপ হলে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা হবে। ভয় হয় কিরণময়ীরই। ঠিক এ সময় কিরণময়ী বুঝতে পারছেন না সুরঞ্জন কী রকম ভাবে নিচ্ছে পুরো ব্যাপারটা। সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িতে বোনপো বোনঝি নিয়ে কাটায়, বাকি সময় বই পড়ে নয়তো টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জুলেখা অনুপস্থিত। তবে কি দুজনে কোনও মনোমালিন্য হল, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল কী! যদি হয় হয়েছে, এ নিয়ে কিরণময়ী ভেবেই বা কী করবেন। ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। মায়ার উপস্থিতি যদি জুলেখার অনুপস্থিতি ঘটায়, তবে হয়তো কোথাও কোনও মঙ্গল সত্যিই আছে। মায়া সুরঞ্জনের বোন। বোন চিরকাল থাকে। স্ত্রী বা প্রেমিকা আজ আছে কাল নেই। সুদেষ্ণা আর জুলেখা এসেছে, গেছে বা যাবে। যার এত বছরেও সংসার হয়নি, তার আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কিরণময়ী মনে করেন না সুরঞ্জনের আর সংসার করার বয়স আছে, বা ও ব্যাপারে সুরঞ্জনের কোনও সত্যিকারের উৎসাহ আছে। কত কত পুরুষ অবিবাহিত অবস্থায় থাকে। সুরঞ্জনের কপালেও তাই আছে। আর এমন তো ধন সম্পদ নেই তাদের যে মনে হতে পারে, মরে গেলে এগুলো ভোগ করবে কে বা খাবে কে তাই কিছু বংশের প্রদীপ রেখে যাই। কোনওভাবে সংসার চলে, চলে পর্যন্তই। সদস্য বাড়ানোর কোনও আর দরকার নেই। এমন কিছু রোজগার কারওর নেই যে উজ্জ্বল ঝকঝকে কোনও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আছে। এভাবেই টিউশনি করে, এভাবেই ছোট খাটো কাজ করে, এভাবেই দুতিনটে শাড়ি কাপড় বিক্রি করে শহরের মধ্যিখানের নাম করে মুসলমান অধ্যুষিত অন্ধকার গলিতে বাস করতে হবে। এর মধ্যে যদি পরিবারটি খানিকটা সুখে স্বস্তিতে থাকতে পারে, তারই চেষ্টা করতে হবে। সুরঞ্জনের না হয় হল না, এখন সে যদি বোনের দুটো বাচ্চাকে মানুষ করতে পারে, তবেই তো ছেলেপুলে না হওয়ার দুঃখ অনেক ঘুচবে। ঠিক কিরণময়ীর মতো করে মায়াও ভাবছে, সুরঞ্জনও কি ভাবছে না? তার অবচেতনেই ভাবনাটা বসে আছে।

পরিবারের সবাইকে এক করে দিল মায়া। একজন সদস্য নেই, দুজন সদস্য বেড়েছে। জুলেখা এই পরিবারের কোনও সদস্য নয়। মায়ার স্বামীও সদস্য নয়। কেমন সব। সুরঞ্জনের অবশ্য কোনও অদ্ভুত জিনিসে আপত্তি নেই। সে বরং এক ধরনের মজাই পায়। এই ঘটতে থাকা অদ্ভুত জিনিসগুলো জীবনে কিছুটা হলেও তরঙ্গ তোলে তার।

এর মধ্যেই একদিন বাড়িতে মায়া তার মেয়ের জন্মদিন পালন করছে। ভালো রান্না হচ্ছে। মায়ার মনও খুব ভালো। এই দিন সুরঞ্জন বলেছে তার এক বন্ধুকে সে ডাকবে। মায়া বলে, একজন কেন, একশ জনকে ডাকো, কিন্তু মুসলমান কাউকে যেন ডেকো না। মায়া যে জুলেখার কথা ভেবে বলেছে তা সে জানে।

কাকে বলছো? নাম কি?

তুই চিনবি না।

না চিনি। নামটা তো বলতে পারো।

শোভন।

সোবহানকে সে শোভন উচ্চারণ করলো। মিথ্যে বলছে, বুঝেই করলো। [চলবে]

 

সর্বশেষ খবর