শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

একটুখানি ছেলেবেলা

ইমদাদুল হক মিলন

একটুখানি ছেলেবেলা

সন্ধ্যাবেলা সদরঘাটে এসে থেমেছে লঞ্চ।

সেই কোন সকালে মাওয়া ঘাট থেকে রওনা দিয়েছি। চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ঘুরে ঢাকায় আসতে সন্ধ্যা। মা আর পুনুআম্মার সঙ্গে আমরা সাত ভাইবোন। মার কোলে মুকুল, পুনুআম্মার পায়ের কাছে রিনা। সে মুকুলের চে' একটু বড়। দক্ষিণ থেকে আসা লঞ্চ ফতুল্লার দিকে বাঁক নিচ্ছে, মার মুখে হাসি ফুটল। ইটভাটার চিমনিগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এইত্তো ঢাকা আইসা পড়ছে!

পদ্মা তখন বিশাল নদী। সমুদ্রের মতো। এপার ওপার দেখা যায় না। ষাটনলের ওদিকটায় এসে মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। পদ্মার পানি ঘোলা, মেঘনার কালো। দুই নদীর মিলনস্থলটা অদ্ভুত। এক নদীর পানি মিসছে না অন্য নদীর সঙ্গে। যে যার সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। লঞ্চের জানালা দিয়ে উৎসুক ভাইবোন আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কী বিস্ময়! পাশাপাশি দুই নদী, পানি সুরঙের। কত জেলে নাও, মহাজনী নাও নদীতে! পাল তোলা নাও এদিক যায়, ওদিক যায়। কাগজের নৌকার মতো কাৎ হয়, কাৎ হয়। হালে বসা মাঝি ছবির মতো স্থির। দাঁড় টানা মাঝিরা তালে তালে ফেলছে বইঠা। কালো শুশুক ভুস করে ওঠে, ভুস করে ডুবে যায়। শুশুককে আমরা বলি 'শিশুম'।

লঞ্চটা কলার মোচার মতো দুলছে। ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ তো আছেই, সেই শব্দ ম্লান করে দিচ্ছে হাওয়ার শব্দ। কোত্থেকে যে আসছে এমন মাথা খারাপ হাওয়া! হাওয়ার চাপে বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছে পদ্মা-মেঘনায়। একদিকে হাওয়া, অন্যদিকে ঢেউ। মা আর পুনুআম্মার মুখ শুকনা। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন দুজনে। আমাদেরকে বলছেন, আল্লার নাম নে।

দুনদীর মোহনায় লঞ্চডুবি হয়। ঝড়-বৃষ্টিতে তো হয়ই, অন্য সময়ও হয়। পানি এমন গভীর এখানকার, ডুবলে বাঁচার উপায় নেই। যত ভালো সাঁতারই জানো, কাজ হবে না।

আজাদ ছাড়া আমরা কেউ তখনও সাঁতার শিখিনি।

কত বয়স আমার তখন? পাঁচ সাড়ে পাঁচ! নাকি ছয় হয়েছে!

সদরঘাটে তখনও টার্মিনাল হয়নি। গ্রাম এলাকার লঞ্চঘাটের মতো নদীতীরের বালিয়াড়িতে এসে সিঁড়ি নামায় লঞ্চ। যাত্রীরা একে একে নেমে আসে। হাতে ব্যাগ, সুটকেস, মাথায় বোঁচকা বাচকি। আমরাও সেইভাবে নেমেছিলাম। লঞ্চঘাটে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্বা। আমাদেরকে হাত ধরে নামিয়েছিলেন।

কী স্নিগ্ধ মায়াবি মানুষ আব্বা! তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু আব্বাকে দেখি। পরনে ঝুল পকেটঅলা সাদা শার্ট আর পায়জামা। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। শ্যামল রঙের মুখে হাসিটা লেগেই আছে।

বালিয়াড়ি ছাড়িয়ে ইট-সুরকির পুরনো বাঁধ! ওই বুঝি বাকল্যান্ড বাঁধ। মাঝখানে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দেখি, এখন যেখানে টার্মিনাল তার পুবকোণে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কত লোকজন চারদিকে, কত দোকানপাট। লাইটপোস্টে ঝুলে আছে বিদ্যুৎ বাতি। সেই প্রথম বিদ্যুতের আলো দেখা। কী বিস্ময়! সদরঘাটে তখন দালানকোঠার সঙ্গে মিলেমিশে আছে টিনের ঘর। সেইসব ঘরে জামা কাপড়ের দোকান, মুদি, মনোহারি আর খেলনাপাতির দোকান। এলোমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিল সাজিয়ে দোকান বসেছে ফুটপাত ঘেঁষে। হারিকেন জ্বলছে কোনও দোকানে, কোনও দোকানে হ্যাজাগবাতি। মেনটেল ঝুলে পড়া বাতির চারপাশে বিনবিন করছে পোকা। তাপে পুড়ে মরেছে অনেক। বাতির শোঁ শোঁ আওয়াজ আর সাদা আলোয় কী রকম আমুদে ভাব। কোনও কোনও দোকানে আছে বিদ্যুৎ বাতি। তার হলদেটে আলো রোদের মতো ছড়িয়ে আছে। ধুম রান্নাবান্না চলছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়, খাওয়া-দাওয়া চলছে। ঘিয়ে ভাজা হচ্ছে পরোটা, সেই মনোহর গন্ধ এসে নাকে লাগে। ফলের দোকান থেকে আসে একটু বেশি পেকে যাওয়া সাগরকলার গন্ধ। লঞ্চে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। পুরনো বড় একটা টিফিন কেরিয়ারে ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে এসেছিলেন মা। খিদে চেপে তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিকটা দেখি। ফুটপাতে বসে বিস্কুট, পাউরুটি বিক্রি করছে কেউ, কেউ বিক্রি করছে দাঁতের মাজন। সেলাই মেশিন নিয়ে পথের ধারে বসে লুঙ্গি সেলাই করছে খলিফা। সুর করে কবিতা পড়ছে এক লোক। তার চারপাশে নানা রঙের মানুষ। রাস্তায় শুয়ে চিৎকার করছে পঙ্গু ভিখিরি। দুচারটা রিকশা আসে যায়, ঘোড়ার গাড়ি আসে যায়। ঝক্কা ধরনের একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। ওই তো একটা মোটরগাড়ি চলে যাচ্ছে সদরঘাটের কামান ঘেঁষে। সব মিলিয়ে বিচিত্র এক জগৎ।

ঘোড়ার গাড়ি চলছে। সবাই ভিতরে, আব্বা বসেছেন কোচোয়ানের পাশে। তাঁর কোলে আমি। রোগা পটকা ঘোড়া দুটো টাকটুক টাকটুক শব্দে চলেছে। বুড়িগঙ্গার ধার ধরে পশ্চিমে যায় গাড়ি। কোচোয়ানের হাতে তেঁতুল রঙের চাবুক, মুখে অদ্ভুত শব্দ। থেকে থেকে শব্দ করছে সে, শপাং করে চাবুক চালাচ্ছে। তার শাসন আর চাবুক কোনওটারই তোয়াক্কা করছে না ঘোড়া। তারা চলছে তাদের মর্জিতে।

পশ্চিম দিকে আহসান মঞ্জিল। নবাববাড়ি। আমরা বলতাম 'নোয়াববাড়ি'। নোয়াববাড়ি এলাকার পুবপাশে বড় একটা দালানবাড়ি। মাঝখানে ভাঙাচোরা রাস্তা। তারও পুবপাশে জমিদার বাড়ি ধরনের একটা বাড়ি। পরে জেনেছি ওই বাড়িতে 'বুলবুল ললিতকলা একাডেমি'। এই দুই বাড়ির মাঝখান দিয়ে ওই রাস্তা। দূরে দূরে আলোর রেখা। এই রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছায়নি আলো। অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। সেই রাস্তায় পড়েছে গাড়ি। খানাখন্দে ভরা, সুরকি ওঠা ভাঙা রাস্তা। খানিকদূর গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিল। এদিকটায় নোয়াববাড়ির পুবদিককার গেট। গেটে পাল্লা ফাল্লা কিচ্ছু নেই। খোলা। গাড়িঘোড়া মানুষজন সব সময়ই যাচ্ছে আসছে।

আমাদের গাড়ি সেই গেট দিয়ে ঢুকে গেল।

নোয়াববাড়ি এলাকার ভিতর সুরকি বিছানো পথ। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে আহসান মঞ্জিল। বাঁদিকে অনেকখানি খোলা মাঠ, তারপর সদরঘাটের ওই রাস্তা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে বাদামতলী ঘাটের দিকে। রাস্তার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। নৌকা চলাচল করছে বুড়িগঙ্গায়, লঞ্চ চলাচল করছে। নানা রকম শব্দ আর আলো আসে নদী থেকে। আর এপাশে, উত্তরে নোয়াববাড়ির মাঠ। দুচারজন আড্ডাবাজ মানুষ মাঠে বসে গুলতানি করে। বিড়ি সিগ্রেট খায়। আবছা আলো অন্ধকারে টানে টানে বিড়ি সিগ্রেটের একবিন্দু আগুন দেখা যায়।

পুবদিক দিয়ে ঢুকে আমাদের গাড়ি এলো পশ্চিমে, তারপর উত্তরে বাঁক নিল, তারপর পশ্চিমে, তারপর আবার উত্তরে। এই রাস্তায় খানিক এগোলে হাতের বাঁপাশে নোয়াববাড়ির মসজিদ, ডানে অজুখানা। মসজিদ আর অজুখানার মাঝখান দিয়ে গাড়ি এসে পড়ল ইসলামপুর রোডে। এদিকটায় নোয়াববাড়ির উত্তরের গেট। ওই পুবদিককার গেটের মতোই, পাল্লা নেই, চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। ইসলামপুর রোড থেকে গাড়ি ঢুকেছিল আরেক গলিতে। জিন্দাবাহার থার্ডলেন, আমাদের বাসা। তখনও সন্ধ্যারাত, তবু কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে বাসা। ঘরে ঘরে কুপি জ্বলছে। তাও পিতলের কুপি না, টিনের। হারিকেন শুধু পুলিশ কাকার ঘরে। আমরা এতগুলো লোক এসেছি, ঘুম ঘুম বাড়িটায় কী রকম একটা সাড়া পড়ল। এ আসে দেখতে, ও আসে। আব্বা একে একে চিনিয়ে দিচ্ছেন। মাকে দেখিয়ে বললেন, এইটা হইল আজাদের মা আর ওইটা হইল খালা। মা আর পুনুআম্মা কারও দিকে তাকাবার সময় পাচ্ছেন না। তারা ব্যস্ত ট্রাঙ্ক সু্টকেস সামলাতে, বোঁচকা বুচকি সামলাতে। রাতে কী খাওয়া হবে তার ঠিক নেই। আব্বা সেভাবে বাজারঘাট করে রাখেননি। খিদেয় সবার মুখ শুকনো। আব্বা চলে গেলেন দোকানে। বিশাল দুই ঠোঙা মুড়ি নিয়ে এলেন। গ্রাম এলাকাকে আমরা বলতাম 'দেশ'। দেশ থেকে খেজুরের গুড় আনা হয়েছে। গুড় হচ্ছে 'মিঠাই'। মুড়ি-মিঠাই খাওয়া হলো রাতে। অন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না আব্বা, এক ফাঁকে আমার মাথায় মায়াবি হাত বুলিয়ে বললেন, প্যাড ভরছে, বাজান?

চৌকিতে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়ে গেছে। সারাদিন লঞ্চে কাটিয়ে আমরা খুবই ক্লান্ত। ঘুমে চোখ টানছে। ভাইবোনরা কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। মুড়ি-মিঠাইও খায়নি দুয়েকজনে। আব্বার প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলো না, ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে একটু বেলা করে। চওড়া বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে। বারান্দায় এসে দেখি, রোদের দিকে তাকাতে পারি না। ঘুম লেগে থাকা চোখ পিটপিট করে। সেই চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। সন্ধ্যারাতে ঘুমিয়ে পড়া বাড়িটি জেগে উঠেছে। সংসারী মানুষ লেগে গেছে কাজকর্মে। টুকটাক কথাবার্তা, ধোয়াপাকলা আর রান্নাবান্নার শব্দ। ছাদের সিঁড়িতে বসে আছে লোভী কাক। এদিক তাকায় কাক, ওদিক তাকায়। ফুরুৎ করে উড়ে যায় চড়ুই পাখি। মা আম্মা সংসার গোছাতে ব্যস্ত। ভাইবোনরা কেউ কেউ গতরাতের মুড়ি-মিঠাই খাচ্ছে, কেউ কেউ তখনও ঘুমিয়ে। আমার চোখ থেকে ধীরে ধীরে কাটছে ঘুম। ঘুম যত কাটে তত দিশাহারা হই। এ কোন জগতে এসে পড়েছি! কোথাও একটা গাছ নেই, একটুখানি সবুজ নেই। শুধু দালানকোঠা। এ তো খাঁচা! এ খাঁচায় আমি থাকব কেমন করে! আব্বা কই? আব্বাকে দেখছি না যে!

মা বললেন, তোর আব্বায় বাজারে গেছে! যা হাত-মুখ ধো। মুড়ি-মিঠাই খা।

কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করে না আমার। না হাত-মুখ ধুতে, না মুড়ি-মিঠাই খেতে! শুধু মনে হয়, এখানে আমি থাকব কেমন করে?

খানিক পর বাজার নিয়ে এলেন আব্বা। মিন্তির মাথায় চাঙারি, আব্বার দুহাতে চটের ব্যাগ। চাঙারি ভরা, ব্যাগ ভরা কী এত নিয়ে এলেন আব্বা? হাতের ব্যাগ বারান্দায় রেখে মিন্তির চাঙারি ধরে নামালেন আব্বা। আমি হতবিহ্বল ভঙ্গিতে তখনও দাঁড়িয়ে। এক ফাঁকে আব্বা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর সেই স্নিগ্ধ হাসিখানা মুখে বললেন, উটছো বাজান? এইভাবে শুরু হয়েছিল জিন্দাবাহার থার্ডলেনের জীবন। ধীরে ধীরে সেই জীবনে অভ্যস্ত হতে লাগলাম।

 

 

সর্বশেষ খবর