১৩ এপ্রিল, ২০১৫ সালে সব্যসাচী নোবেলবিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জার্মান সাহিত্যের তথা বিশ্বসাহিত্যের একটি অধ্যায় শেষ হলো। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস 'টিন ড্রাম'-এর জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি এক অবিস্মরণীয় ট্রিলজির স্রষ্টা : ক্যাট অ্যান্ড মাউস ও ডগ ইয়ারস এই ট্রিলজিতে অন্তর্ভুক্ত। জার্মানির ডানজিগ শহরের পটভূমিতে লেখা, যে শহরটিতে তিনি জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় 'ডাবলিনার' গল্পগ্রন্থের স্রষ্টা জেমস জয়েসকে, যিনি তার প্রিয় শহর তার জন্মশহর ডাবলিনারকে তার গল্পে অমর করে রেখেছেন।
গুন্টার গ্রাস যুদ্ধোত্তর কালের কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৬ অক্টোবর, ১৯২৭ ডানজিগ শহরে, যা বর্তমানে পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আট বছর পরে তিনি জন্মেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তার অবচেতনে না থাকলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) ভয়াবহতা ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। যে 'ম্যাজিক রিয়েলিজম' বা জাদুবাস্তবতা নিয়ে আমরা সরব, তা আসলে ১৯৬১ সালে গুন্টার গ্রাসের লেখায় প্রথম আবিষ্কার করি। আরও কয়েকটি বিষয় তার উপন্যাসে আমরা লক্ষ্য করি, তা হলো প্রাণী ও জীবজন্তুর ব্যবহার। উপন্যাসের শিরোনামে শুধু নয়, চরিত্রের অনুষঙ্গ হিসেবেও মাছ, বিড়াল, ইঁদুর বার বার এসেছে। অবশ্যই প্রতীক হিসেবে এদের তিনি নতুন ব্যঞ্জনা দিতে চেষ্টা করেছেন। তার অন্য অনেক অগ্রজ লেখক বিশেষ করে আলবেয়ার কাম্যু, টমাস মান, হেইনরিখ বোলের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি আমাদের নমস্য।
টিন ড্রাম চলচ্চিত্রায়িত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং বিপুল দর্শকপ্রিয়তা ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' তার দ্বিতীয় উপন্যাস, যা খ্যাতিমান প্রকাশক পেঙ্গুইন ছেপেছিল। ১৩৭ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এ উপন্যাসটি অনুবাদ করেছিলেন রাল্ফ ম্যানহেইস। বেশ স্বচ্ছ সাবলীল অনুবাদ, মনে হয় মূল উপন্যাস পড়ছি।
ঈশপের গল্প বলার ভঙ্গি, অনেকটা সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ এক আঙ্গিক বেছে নিতে ভালোবাসেন গ্রাস। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' উপন্যাসে তীক্ষ্ন ও অনুপুঙ্খ ডিটেইল্স আছে। অসম্ভব পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী গ্রাসে আছে কটাক্ষ অভিযোগ আর অতীতের কথাচিত্র। জার্মানির যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে এঁকেছেন গ্রাস। এই যে চূড়ান্ত বাস্তবতা, এটা জার্মান সাহিত্যধারার বাস্তবতাবাদ কিন্তু যে জাদুবাস্তবতা ইদানীং উচ্চারিত হচ্ছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি, তা নতুন কোনো বিষয় নয়।
গ্রাসের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে মাছ কিংবা প্রাণিজগতের সদস্যরা বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। মূলত শিল্পী ও স্থপতি আবার একই সঙ্গে কবি ও নাট্যকার; যার অতীত স্মৃতিময়, নাৎসিদের ব্যাখ্যাতীত নিষ্ঠুরতায় বিপর্যস্ত যে ছেলেবেলা বাবা ছিলেন ছোট মাপের মানুষ, স্বল্প আয়ের সামান্য এক মুদি দোকানের মালিক; মা ভিন্ন সম্প্রদয়ের এক গৃহবধূ; প্রিয় শহর ডানজিগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা; 'টিন ড্রাম' ও 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' উপন্যাসে গভীর বেদনা ও গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ শহরটি।
অন্য এক উপন্যাস 'দ্য ফ্লাউন্ডার'-এ তার সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। নারী-পুরুষের চিরকালীন দ্বন্দ্ব-বিরহকে ঘটনার মুখোমুখি এক নাজুক প্রেক্ষাপটে রেখে রস ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় প্রশ্ন করা হয়েছে মানবসভ্যতার এই মানবজমিন নির্মাণে নারী-পুরুষের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে, তা কতটা কার্যকর, যদি কার্যকর না হয়, কোথায় তার অপূর্ণতা।
নিঃসন্দেহে এরকম প্রশ্ন কেউ এর আগে উত্থাপন করেননি। এ কারণে সুইডিশ একাডেমি ১৯৯৯ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় এরকম একটা বক্তব্য দিয়েছেন ভুলে যাওয়া অতীতকে পুনরুদ্ধারের এক অপূর্ব ক্ষমতা তার লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। একজন লেখক তার দেওয়া সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র, ডায়েরি ও স্মৃতিকথায় নিজেকে উন্মোচন করেন। আমরা গ্রাসকেও তার স্মৃতিকথা, ডায়েরি এবং মৃত্যুর কিছুকাল আগে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে পরিপূর্ণভাবে খুঁজে পাই। একজন বামঘেঁষা মানবতাবাদী লেখক যিনি যুদ্ধক্লান্ত জার্মানিতে ঘৃণা উৎখাতে সচেষ্ট, যে লেখক ঢাকা-কলকাতা ভ্রমণ শেষে তার অভিজ্ঞতার কথা তীক্ষ্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন।
তিন খণ্ডের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'পাইলিং দ্য ওনিয়ন'-এ তার শৈশব, যৌবন, শিক্ষাজীবন, প্রেম ও বিয়ে, রাজনীতি, দেশ ও সমাজ নিয়ে তার ভাবনা খোলামেলাভাবে খুব সরাসরি ব্যক্ত করেছেন।
তিনি রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকেও লেখালেখিকে অবহেলা করেননি। লেখা চর্চা ছিল তার প্রথম প্রেম, তার প্রথম প্রণয়। ছবিও অাঁকতেন। তার বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই অাঁকতেন। গ্রাফিঙ্ ডিজাইনেও ছিল তার চমৎকার হাত। একই সঙ্গে স্থপতিত্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত 'পাইলিং দ্য ওনিয়ন' আত্মজীবনীর ট্রিলজি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনূদিত হয়ে পাঠকপ্রিয়তা পেতে থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর তার অতীতের কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এক সাক্ষাৎকারে তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমার ওপর ভারবাহী হয়ে ছিল অতীতের যেসব বিষয়, সেসব ঘটনা লিখতে পেরে আমি নিজেকে দায়মুক্ত মনে করছি'। যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মদের নিয়ে জার্মান জাতিকে পুনর্গঠনের বেশকিছু দিকনির্দেশনা এ ট্রিলজিতে তিনি ব্যক্ত করেছেন।
লেখালেখির ব্যাপারে তিনি সব সময়ই নিরীক্ষামূলক। তার গদ্য তীক্ষ্ন, সাবলীল ও দৃঢ়। তার উপন্যাসে সময়কে গভীর বিশ্লেষণে চিত্রিত করা হয়েছে। যেহেতু তিনি রাজনীতিসচেতন লেখক, তিনি সমাজ ও সময়কে আন্তরিকভাবে তার লেখায় মূর্ত করে তুলেছেন। তার লেখায় দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু কোনো ফাঁকফোকর নেই।
স্মৃতিময়তা তার লেখার আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা। তার অধিকাংশ উপন্যাসে ডানজিগ শহর ঘুরেফিরে বার বার এসেছে, কখনো স্মৃতিচিত্র হয়ে কখনো আত্মজৈবনিক বিশ্লেষণে ভাস্বর হয়ে।
জার্মান সাহিত্যের সঙ্গে এবং একইভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি জার্মানদের অনুরাগের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর জার্মান কবি গ্যেটের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গমন করেন এবং সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনের ওপর বক্তৃতা প্রদান করেন। গড়ে ওঠে দুই ভাষা ও দুই সংস্কৃতির মাঝে সম্প্রীতির সেতু, যা আজও অটুট রয়েছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজি বিভাগে জার্মান কবি ও কথাসাহিত্যিকদের লেখা পাঠ করতে হয়। গুন্টার গ্রাস এ সময়কার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। তিনি কবিও। একজন লেখককে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, এ কথাটি তিনি প্রথম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন।
আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর প্রশ্নে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধেরও বিরোধিতা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা আজও আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। বাংলাদেশে গুন্টার গ্রাস অচেনা নন, অনালোচিত ও অপঠিত নন। তবুও এখন সময় এসেছে দুই ভাষা বা তিন ভাষায় প্রাজ্ঞ পণ্ডিতদের অনুবাদের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলা ভাষায় সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় গ্রাসের প্রধানতম গ্রন্থগুলো দ্রুত অনূদিত হলে এ প্রজন্ম উপকৃত হবে। আমরা যোগ্য ব্যক্তির অনুবাদের অপেক্ষায় থাকব।