শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

স্মৃতিতে মুজিবনগর সরকার

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম

স্মৃতিতে মুজিবনগর সরকার

১০ এপ্রিল। বিমানে আমাদের আগরতলা রওয়ানা হওয়ার কথা। তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মণি, তোফায়েল আহমেদ ও আমি লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দর যাই। অন্যান্যের মধ্যে মি. নগেন্দ্র সিং আমাদের সঙ্গী হলেন। বিমানটি খুবই ছোট, এতে বসার মতো পাঁচ-ছয়টি আসন ছিল। খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলোর একটিতে আমরা নামি; যেটা ছিল বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি। বিমানবন্দরে আমরা দুপুরের খাবার খাই। বিএসএফের মাধ্যমে খবর দেওয়া হলো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার খোঁজ পেলে পরবর্তী কোনো বিমান তৈরি রাখতে। উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা অঞ্চলের কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। তাদের বেশির ভাগ কলকাতা এসে গেছেন। কিছুক্ষণ পর আমরা বাগডোরা বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে জিপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভিতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলোয় উঠলাম। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী এখানে কোনো একটি জঙ্গল থেকে গোপনে বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারিত হবে। এ সময় তোফায়েল আহমেদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মণি কিছু নির্দেশসহ তোফায়েল আহমেদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন।

মনসুর ভাইয়ের জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। আমি তার পাশে বসে আছি। তার সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোনো আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদের ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন তোলেননি। পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সঙ্গে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে কোনো আপত্তি করবেন না। তা ছাড়া তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন। তবুও চারজন এক থাকলে মোশতাক ভাইকেও রাজি করানো যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা করার পালা। তাজউদ্দীন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেওয়া হলো।

শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বাইরের ঘরে বিএসএফের আঞ্চলিক কর্মকর্তার সঙ্গে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা এবং শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করলাম। শেখ মণির সঙ্গে কথা শেষ করে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানান, শেখ মণি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজি নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএলএ ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শেখ মণি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা না করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

আমি সরকার গঠনের পক্ষে যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে দেরি হলে সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তো নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মোশতাকের তখনো দেখা নেই। তারা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনো আসেনি। ইতিমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক স্বার্থ গড়ে উঠেছে। সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠনের ব্যাপারে আমরা ভারত সরকারকে বিশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পোষণ করবে। ভারত সরকারও জানে আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচার হবে। আমার এসব কথা শেখ মণি মানতে রাজি নন। শেখ মণি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বলেন আমি যেন গোলক মজুমদারকে জানিয়ে দিই যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার হবে না। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানো হবে।

গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে, আজ বক্তৃতা প্রচার হবে না। এ কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বিলম্ব করা ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব ঠিকঠাক সে মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে তা আমরা ভেবে দেখেছি কি না। ইতিমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেছে। আমি গোলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত একা নিয়েছিলাম। এদিন ছিল ১০ এপ্রিল। রেডিও অন করে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দীন ভাই ও শেখ মণি আছেন। রাত তখন সাড়ে ৯টা। সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এলো। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।

বক্তৃতা প্রচারিত হলো। আমাদের তিনজনের মুখে কোনো কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গোলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত প্রচার বন্ধ করতে পারেননি। মনসুর ভাই ভাত খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পাননি। পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দিন ভাইয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরও বৃদ্ধি পেত বইকি।

শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগরতলা গিয়ে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে শেখ মণি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবায় গিয়ে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।

তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারের পর অনেক রাতে কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামান (সেক্টর কমান্ডার) ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সেক্টর রয়েছে। একটি সেক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল জামান। তারা জানান, গেরিলা কায়দায় আকস্মিক হামলায় শত্রুদের পর্যুদস্ত করা হচ্ছে। আমি অবাঙালিদের ওপর হামলা না করার পরামর্শ দিলাম। অবাঙালি বিহারিদের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ। রংপুর ও সৈয়দপুরে বেশকিছু বিহারি রয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে হামলা বন্ধ করা হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হামলা বন্ধের ব্যাপারে চেষ্টা করছেন। অবশ্য অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। আলোচনা করতে করতে রাত প্রায় ভোর হয়ে গেল। ভোরের দিকে তারা দুজন চলে গেলেন। তাদের অনেক কাজ। এক মুহূর্ত সময় নেই। যোদ্ধারা তাদের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন, সরকার গঠনে তারা আনন্দ প্রকাশ করলেন।

পরদিন ১১ এপ্রিল নাস্তা করে আমরা বিমানে উঠি। আগের রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর থেকেই শেখ মণি চুপচাপ রয়েছেন। বক্তৃতার কথা শুনে মনসুর ভাই উৎফুল্ল। রাতে বিশ্রামের পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মনসুর ভাই অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশি খুশি। খুব নিচু দিয়ে আমাদের বিমান উড়ছে। দুই দেশের সংলগ্ন বিমানবন্দরে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফের স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। এ কথা শুনে আমরা ইউরেকা বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে তারা দুজন এলেন। নজরুল ভাইকে জিপ থেকে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানলাম ২৫ মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে দুই দিন টয়লেটে পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়কপথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দীন ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি তাদের অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোবারকবাদ জানান। এসব দৃশ্য দেখে আমরা সবাই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহণ করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন।

আমাদের আগরতলায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তার চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। রাতের খাবারের পর নেতারা বৈঠকে বসেন। ডা. টি হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এ পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানান। সারা রাত সলাপরামর্শ হলো। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলো, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে এ কথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা সমঝোতার জন্য ব্যবস্থাটা একেবারে খারাপ নয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দীন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বৈঠকে সেগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৩ এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আবদুস সামাদ আজাদ ও কর্নেল ওসমানী কলকাতা আসেন। অন্যরা রয়ে গেলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা দুটি প্রবেশপথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এ পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে।

মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর দস্যুরা সেখানে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে নতুন স্থানের কথা চিন্তা করলাম। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, গোলক মজুমদার ও বিএসএফের চট্টোপাধ্যায় জানতেন। ইতিমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী প্রথম যে ভাষণ দেন, তার কপি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় তৈরি করা হয়েছিল। ইংরেজি কপি বিদেশি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল, প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রযোজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তার জন্য পোশাক তৈরি করা হলো।

শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজন কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়ানা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। সেই ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম, স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন। আপনারা সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কীভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টি গাড়িযোগে রওয়ানা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজনই দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সঙ্গে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌঁছাতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তওফিক এলাহি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন। এদিকে পাক হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে। সম্মুখসমরে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

নির্দেশ সত্ত্বেও দেশমাতৃকার মুক্তিপাগল যোদ্ধারা বাংকার ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। মাহবুব ও তওফিক তাদের সৈন্যসহ পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন। তারা সুকৌশলে পিছু হটে আসেন। মনোবল ঠিক রেখে পশ্চাদপসরণ করা একটা কঠিন কাজ। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার থেকে উঠে আসে। ওদের চোখেমুখে বিশ্বাসের দীপ্তি বিদ্যমান ছিল। কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানকে মুজিবনগর নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্দসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী।

[লেখাটি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি। সূত্র : বিডিএস '৭১]

 

সর্বশেষ খবর