শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

শরম (৩৩তম পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (৩৩তম পর্ব)

অলঙ্করণ : তারেক

'লজ্জা' উপন্যাস লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। একপর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের দেখা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখলেন তার নতুন উপন্যাস 'শরম'। উপন্যাসটি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

সুরঞ্জন হুইস্কির অর্ডার দেয়। জুলেখা ব্লাডি মেরি। পাহাড়ে সুরঞ্জনের কাছে ব্লাডি মেরিতে হাতে খড়ি জুলেখার। দুজনের গ্লাস সামান্যই শেষ হয়েছে, তখনই সোবহানের আগমন।

-এ হল আমার বন্ধু, শোভন ওরফে সোবহান। মোহাম্মদ সোবহান।

জুলেখা একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে গ্লাসে চুমুক দেয়।

সোবহান বসে সুরঞ্জনের পাশের চেয়ারে। নিজের জন্য সে একটা স্প্রাইটের অর্ডার দেয়।

-ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম, জুলেখার কথা। খুব ভালো মেয়ে। জিরো থেকে উঠে এসেছে। এখন একটা চাকরি করে। এমন মেন্টাল স্ট্রেন্থ, ভাবাই যায় না। আমার পক্ষে তো এমন হওয়া সম্ভবই না। আর সোবহান তো বিশাল জিনিস। আমার আইডল বলা চলে। মনোবলের পাহাড়। ওয়েল এস্টাবি্লস্ট। তোমাদের দুজনের স্বভাব চরিত্রে এত মিল। অ্যামবিশাস। কেরিয়ারিস্ট। ভাবলাম পরিচয় করিয়ে দিই।

এরপর সুরঞ্জনের সঙ্গে কথা কিছু বলে জুলেখা, বেশি বলে সোবহানের সঙ্গে। কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর, কী চাকরি, কী ব্যবসা। ফিডার রোডে নিজের ফ্ল্যাট নাকি ভাড়া। নিজের শুনে চমকিত হয়।

সুরঞ্জন বলে, ভেবো না। ওর গাড়িও আছে। গাড়ি চালিয়ে তো এলো আজ। পার্কিং পেলে কোথাও?

সোবহান ঘাড় নাড়ে। ওরও কি জুলেখার প্রতি আকর্ষণ? ঠিক বোঝা যায় না। সে শুধু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়। নিজে কোনও প্রশ্ন করে না। সুরঞ্জনের কাছে যেটুকু শুনেছে, সেটুকুকেই সে যথেষ্ট মনে করছে।

জুলেখা কথায় কথায় বলে, আমি খুব ছোট চাকরি করি। আমার তো চাকরি বাকরি করার কোনও কথা ছিল না। কথা ছিল স্বামী সন্তানের সেবা করবো। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। দুঃসময়ে যারা সঙ্গে থাকে, তারাই সত্যিকার বন্ধু। আমার বন্ধু বলতে সত্যি বলতে কী, কেউ নেই। যা ছিল, তা সুরঞ্জনই। তিন কুলে যার কেউ নেই, আমার মতো জীবন তাদের। তবে যা আছে সামনে তা দেখতে চাই। জীবন আমাকে যেটুকু দেয়, যাই দেয়, সব গ্রহণ করতে চায়। আপনি?

সোবহান দেখতে সুরঞ্জনের চেয়ে অনেক ভালো। আধুনিক। বুদ্ধিমান। ধোপদুরস্ত। কী করে এর ঠিক উল্টো চরিত্রের ছেলে সুরঞ্জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল, তা বোঝা দুষ্কর। জুলেখা জানে, দেখতে ভালো ছেলের আসলে কোনও মূল্য নেই। মন কেমন, সেটিই বড় কথা। কথা বলতে বলতে সে ব্লাডি মেরি দুটো শেষ করে এবং বোঝে যে সোবহানের সঙ্গ তার ভালো লাগছে, সততা আর সভ্যতা দুটো জিনিস জুড়ে দিয়ে বানানো হয়েছে সোবহানকে। আপাতত তাই মনে হয়। আসলে কী, তা কী আর কম করে হলেও বছর না গেলে বোঝা যাবে। কিন্তু সোবহান যত মহানই হোক না কেন, জুলেখার তাতে কী! এইটুকু হল, যে জানা হল, সুরঞ্জনের একজন ভালো বন্ধু আছে। এর অর্থও এই নয় যে সুরঞ্জন একটু জাতে উঠলো, বন্ধুভাগ্য ভালো হলেও কারও মর্যাদা বেড়ে যায় না। মর্যাদা বাড়ে সে যদি মর্যাদা বাড়ানোর মতো কাজ করে।

আপনি খুব কম কথা বলেন।

সোবহান হাসে।

প্রেম করে বিয়ে করেছেন?

এই প্রশ্নে একটু থতমত খায় সে। সময় নেয় উত্তর দিতে।

থাক, উত্তর দিতে হবে না। প্রেম এই শব্দটা মনে হয় আপনার কাছে একটু অস্বস্তিকর।

আপনার কাছে অস্বস্তিকর নয়?

মোটেও না। প্রেম একবারই এসেছিল আমার জীবনে।

কেন? হৃদয় দুয়ার কি বন্ধ করে রেখেছেন নাকি?

বন্ধ ছিল না। বন্ধ করার কথা ভাবছি। আপনার কি? বন্ধ?

এবারও ঠোঁট টিপে লাজুক হাসি হাসে সোবহান। কোনও মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে সে অভ্যস্ত নয়। সুরঞ্জনের সঙ্গে হলে হয়তো কথা হতে পারতো।

আপনি সিনেমায় দেখা ভালো মানুষদের মতো।

কথা কম বলি বলে লোকে আমাকে ভালো মানুষ বলে।

আসলে কি ভালো নন?

আপনার টাকা আছে, কিন্তু অহঙ্কার নেই, এই কারণেও হয়তো ভালো বলে।

আপনার সঙ্গে সুরঞ্জনের খুব মেলে?

কী রকম? আমি তো জানি ওর সঙ্গে আমার খুব কম মেলে। কী মেলে? দুজনই মদ খাই? আমার অবশ্য জীবনে এ দ্বিতীয়বার খাওয়া..

না তা নয়।

তবে?

আপনারা দুজনই আমাকে খুব কম জেনে খুব প্রশংসা করছেন।

জুলেখা আর সোবহানের কথাগুলো খুব মন দিয়ে সুরঞ্জন শুনছিল এবং উপভোগ করছিল। সে যে টেবিলে আছে, তা জুলেখা কি ইচ্ছে করে ভুলতে চাইছে নাকি মুহূর্তেই সোবহানের প্রেমে পড়ে গেছে, ঠিক বুঝতে পারছে না।

আলাপে রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি জাত পাত ধর্ম কিছুই আসেনি। যা এলো প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রেম আবেগ ভালোবাসা সম্পর্ক বিচ্ছেদ। সুরঞ্জনের এই-ই ভালো লাগে, অন্য কোনও প্রসঙ্গ বিশেষ করে রাজনীতি আর অর্থনীতি হলে তো তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়, উঠে চলে যায় অন্য কোথাও। সে বলে দেয় এসব কঠিন জিনিস আমি বুঝি না। তাহলে কী ভালো লাগে, খেলার কথা বলো। আর কিসের কথা, ইতিহাস ভূগোল? ইতিহাস মোটেই না, ভূগোল বরং বলতে পারো। সংসার? ধুত। বই পত্র? বোরিং। গান বাজনা? হ্যাঁ সেটা চলে। নাটক? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরঞ্জন বলে, না। কেন? কী কেন? এত অনীহা কেন? ভাল্লাগে না। কী ভাল্লাগে? শুয়ে থাকতে, ভাবতে, কিছু না করতে, ঘুমোতে। প্রেম? ও আমার জন্য নয়। বাচ্চাদের পড়াতে ভাল্লাগে? লাগে। নিজের সম্পর্কে কী ভাবো? কিছুই না। সবচেয়ে বেশি কী ভালো লাগে? তামাশা। কারও সঙ্গে? নিজের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গে। মনে মনে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দেয় সুরঞ্জন।

কিছুটা বুদ্ধিদীপ্ত, কিছুটা অসংলগ্ন, কিছু অর্থবহ, কিছু অনর্থক কথোপকথন চলে আর রাত বাড়তে থাকে। সোবহান বিল মেটালো। সুরঞ্জন অনেকটাই মাতাল। জুলেখার কিছুই হয়নি। সোবহান ভালো ছেলে। ধবধবে সাদা সার্টেও একবিন্দু দাগ নেই। সুন্দর অাঁচড়ানো চুল। দাঁড়ি গোঁফ নেই। মুখে দাগ গর্ত নেই। সাদা দাঁত। বাঁধানো নেই, হলদেটে নেই। ছ ফুট লম্বা। লিকলিকে নয়। ভারীও নয় শরীর। সুরঞ্জনের চেয়ে বয়স বছর কয়েকের ছোট। এমন যুবক তো প্রার্থনীয়, বিশেষ করে জুলেখার। সোবহান গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে যায় বেগবাগানে সুরঞ্জনকে, জুলেখাকে হাজরায়।

রাতে সুরঞ্জনের ফোন জুলেখাকে। তখন সে কাপড় পাল্টে মুখ হাত ধুয়ে দাঁত মেজে রাতের পোশাক পরে সবে শুয়েছে। সুরঞ্জন ওদিক থেকে বললো, কেমন লাগলো?

ভালো।

দারুণ না?

হ্যাঁ দারুণ।

বলেছিলাম তোমাকে। [চলবে]

 

 

সর্বশেষ খবর