শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভয়াবহ সেই দিন-রাত

ভয়াবহ সেই দিন-রাত

দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায়

জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের মৃত আমেদ শেখের ছেলে দরিদ্র হেলাল উদ্দিন নিজের ভাগ্য ফেরানোর আশায় ২০০৮ সালে জমি-জিরেত বিক্রি করে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ করে দুবাই যান দালালের মাধ্যমে। দুবাই থেকে দালালের মাধ্যমে ২০০৯ সালের আগস্টে যান লিবিয়ায়। ছয় বছর যাবৎ তিনি লিবিয়ায় ছিলেন। সর্বশেষ গত তিন বছর ধরে বাউস নামে একটি তেল কোম্পানির অধীনে কাজ করছিলেন আলগাজি সিটির মরুভূমিতে অবস্থিত আল-ঘানি অয়েল ফিল্ডে মাসিক ৫০০ ডলার বেতনে। যুদ্ধাবস্থার কারণে লিবিয়ার অনেক স্থানেই কাজের পরিবেশ নেই। মরু শহর আলগাজির প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বাউস কোম্পানির আল-ঘানি অয়েল ফিল্ড। অন্যান্য তেল ক্ষেত্র বন্ধ করে দিয়ে লোকজন সরে গেলেও আল-ঘানি অয়েল ফিল্ডের কর্মকর্তা, শ্রমিকসহ ১০/১২ জন কাজ করছিলেন ফিল্ডে।

অপহরণ ঘটনা

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ মার্চ অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানালেও হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন তাদের অপহরণ করা হয়েছিল ৭ মার্চ শুক্রবার। হেলাল উদ্দিন জানান, সেদিন সকাল থেকে টুকটাক কাজ শেষ করে ফিল্ডের শ্রমিক আর কর্মকর্তারা যার যার কন্টিনারে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বেলা তখন প্রায় ২টা। এমন সময় হঠাৎ দুটি বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো আল-ঘানি অয়েল ফিল্ড। দুজনের চোখে-মুখে তখন আতঙ্ক। আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে হেলাল ফিরে আসেন নিজের কন্টিনারে। তার কিছু সময় পরই হেলাল উদ্দিন তার কন্টিনারের দরজায় শুনতে পান দমাদম লাথি আর রাইফেলের বাঁটের শব্দ। দরজা খুলে দেখতে পান তার মাথা লক্ষ্য করে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে কালো স্কার্ফে মুখঢাকা এক জঙ্গি।

অজানার উদ্দেশে যাত্রা

অস্ত্রের মুখে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ফিল্ডের খোলা জায়গায়। সেখানে লাইন ধরে বসাছিল ফিল্ডের আরও কয়েকজন কর্মী। অস্ত্রধারী তিন জঙ্গির মধ্যে একজন জঙ্গি লাইন পাহারা দিচ্ছিল। আর দুজন জঙ্গি একে এক ধরে আনছিল অন্যান্য কর্মীদের। সব মিলিয়ে ১১ জন কর্মকর্তা ও শ্রমিককে এক লাইনে বসানো হলো। ঘাড়ের কাছে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে মুখোশপরা জঙ্গিরা। এক পর্যায়ে কোম্পানির নিজস্ব পরিবহন বাস বের করে আনল এক জঙ্গি। সেই বাসে লাইন ধরিয়ে ১১ জনকে উঠানো হলো। চলতে শুরু করল বাস। প্রায় দেড় কিলোমিটার চলার পর বাস থেকেই শোনা যাচ্ছিল অনেক মানুষের কণ্ঠে গগনবিদারী ' আল্লাহু আকবর' স্লোগান। বাসটি একটি ছোট মরু এয়ারপোর্টের চতুর্দিকে কয়েকবার চক্কর দিয়ে থামল। এয়ারপোর্টে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ৩০/৩৫টি গাড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশে আবৃত ৭০/৮০ জন জঙ্গি তখনো আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল। ১১ জন জিম্মিকে বাস থেকে নামানো হলো। সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে করা হলো জিজ্ঞাসাবাদ। ১১ জনের মধ্যে একজন লিবিয়ান ও একজন তিউনেশিয়ান মুসলিমকে ছেড়ে দিল জঙ্গিরা। বাংলাদেশি শ্রমিক হেলাল উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেনসহ বাকি নয়জনকে ফের উঠানো হলো বাসে।

মৃত্যুর সঙ্গে মরুপথে

দুজনকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমাদের বহনকারী বাসকে মাঝে রেখে মরুপথে যাত্রা শুরু করে জঙ্গিদের ৩০/৩৫টি গাড়ির কনভয়। ৩০/৩৫ কিলোমিটার মরুপথ পেরিয়ে কনভয় থামে মরুর এক পরিত্যক্ত অয়েল ফিল্ডে। সেখানে আছরের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল জঙ্গিরা। এ সময় হেলাল উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন ও ঘানার নাগরিক ওমর মোহাম্মদ পাহারারত এক জঙ্গিকে জানায় তারা মুসলিম এবং নামাজ পড়তে চায়। সেই জঙ্গি কনভয়ের নেতাকে তাদের ইচ্ছার কথা জানালে জঙ্গিনেতা তাদেরকে সূরা-কালাম পড়তে বলে। সূরা-কালাম পড়ার পর মুসলিম নিশ্চিত হয়ে এই তিন জিম্মিকে জঙ্গিদের সঙ্গে জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। মুসলিম পরিচয় এবং নামাজে অংশ নেওয়ার পর থেকে এই তিনজনের প্রতি আচরণে কিছুটা সদয় হয় তারা। এ সময় খ্রিস্টান দুজন অস্টেলিয়ান অফিসার ও চারজন ফিলিপাইনি শ্রমিককে উঠানো হয় বাসে। হেলাল উদ্দিন, আনোয়ার আর ঘানার ওমর মোহাম্মদকে উঠানো হয় কনভয়ের আলাদা তিনটি গাড়িতে। ফের কনভয় চলতে শুরু করে। গাড়িতে খেতে দেওয়া হলো খেজুর, দই ও পাউরুটি।

মরু প্রান্তরে রাতযাপন

পথে অন্য একটি পরিত্যক্ত অয়েলফিল্ডে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফের যাত্রা করে কনভয়। প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা চলার পর রাতে কনভয় থামে এক মরু প্রান্তরে। তখন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। খোলা মরু প্রান্তরে কুয়াশার তীব্রতায় ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম আমরা তিনজন। জঙ্গিরা এশার নামাজ পড়ে খোলা মরুতে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। পাহারায় রইল বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী জঙ্গি। আমাদেরও একটু দূরে খোলা মরুতে থাকতে দেওয়া হলো। তখন আমরা ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপছি। উপায় না দেখে আমরা তিনজন মরুর বালু সরিয়ে গর্ত করে তাতে শুয়ে পড়ি। মরুর বালুতে জন্মানো জংলা ঘাস তুলে এনে গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করি। ভোরে ফজর নামাজের পর খেতে দেওয়া হয় পাউরুটি আর কেরসিন মিশ্রিত কয়েক ঢোক পানি। সকালে অন্য ছয় বিদেশি খ্রিস্টান জিম্মিকে দেখলাম বাস থেকে নামানো হলো আবার বাসে তুলে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হলো। বিদেশি ছয় খ্রিস্টান সহকর্মীর সঙ্গে এই আমাদের শেষ দেখা। বন্দী সময়ের বাকি দিনগুলোতে কনভয়ে সেই বাস আর দেখিনি। দেখিনি ছয় বিদেশি সহকর্মীকেও।

ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে

১৮ দিনে জঙ্গিরা আটবার স্থান পরিবর্তন করে। জিম্মি হওয়ার পরদিন কনভয় গিয়ে থামে মরুভূমির ভিতরে চতুর্দিকে বাউন্ডারি দেওয়া এক ক্যাম্পে। ক্যাম্পের ভিতরে রয়েছে বিল্ডিং ঘর। সেখানে একটি কক্ষে আমাদের তিনজনকে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। তিনদিন পর আমাদের নেওয়া হয় নতুন একটি ক্যাম্পে সেখানেও বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে দুদিন তালাবদ্ধ করে রাখা হয় আমাদের। ২৪ ঘণ্টায় একবেলা খাবার দেওয়া হতো।

কোনোদিন পাউরুটি, কোনোদিন জয়তুনের তেল আর চিনি মেশানো একমুঠো ছাতু আর কয়েক ঢোক কেরোসিন মিশ্রিত পানি। দুদিন পর আবার কনভয় ছুটে নতুন ক্যাম্পে। কনভয় থামে ৩০/৩৫ কিলোমিটার দূরের আরেক ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পে যে কক্ষে আমাদের থাকতে দেওয়া হলো সেটা একটু বড় হলরুমের মতো। সেখানে দেখতে পেলাম ১৫/১৬ বয়সের ১৩ জন কিশোরকে। প্রতিদিন জঙ্গিরা এই কিশোরদের নামাজের তালিম দিত। কাফের'দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দীপ্ত হতে এই কিশোরদের সামনে বক্তব্য দিত জঙ্গিরা।

ভয়াবহ সেই দিন-রাত

বন্দী জীবনের ১৮ দিনের মধ্যে ৮/৯ দিন আমাদের বিল্ডিং ঘরে বন্দী রাখা হয়। বাকি দিন ও রাতগুলো কেটেছে খোলা মরূদ্যানে। দিনে উত্তপ্ত রোদ আর রাতে কুয়াশায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। দিনটা কোনোভাবে কেটে গেলেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রাত হয়ে উঠত দুর্বিষহ। মাঝে মধ্যে দেওয়া হতো একটি করে কম্বল। অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকতাম বালিভূমিতে। একরাতে মরুভূমির গর্তে শুয়ে আছি। দেখি জঙ্গিরা ছুটোছুটি করছে। আমাদের বলা হলো বিমান হামলা হবে। এখান থেকে সরে যেতে হবে। আমাদের গাড়িতে তুলে দ্রুত কনভয় ছুটল মরুপথে। কিছু দূর যাওয়ার পর মূল কনভয় থেকে বিচ্ছিন্ন হলো দুটি গাড়ি। এ দুটি গাড়ির প্রতিটিতে ৮/১০ জন জঙ্গি। আমাদের তিনজনকে দুই গাড়ির একটিতে তোলা হলো।

অবশেষে মুক্তি

কয়েকঘণ্টা পথ চলার পর সকালে পৌঁছলাম ক্যান্টনমেন্টের মতো দেখতে নতুন একটি ক্যাম্পে। সেখানে দরবার হলের মতো দেখতে একটি কক্ষে আমাদের নেওয়া হলো। এই কক্ষে জঙ্গিদের লিডার আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানাল তোমরা মুসলিম। নামাজ পড়। তাই তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। লিডার আমাদের ১০০ দিনার ধরিয়ে দিল পথ খরচের কথা বলে। এখান থেকে দুপুরে আমাদের গাড়িতে তোলা হলো। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি পৌঁছল সিরাত সিটির তিনতলা বিশিষ্ট একটি মাদ্রাসায়। আমরা তখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভাবনায় দুলছি।

সত্যিই কী আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে? সেখানে দেখা পেলাম কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্রের। এক মাদ্রাসা ছাত্রের ফোন নিয়ে দেশে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। স্ত্রীকে জানালাম আজই আমাদের ছেড়ে দিতে পারে। একই সময় ওমর মোহাম্মদ কোম্পানিতে ফোন করে আমাদের অবস্থান জানাল। বেলা ১১টার দিকে দেশটির সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ২৫ মার্চ মুক্তি পান লিবিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক জামালপুরের হেলাল উদ্দিন, নোয়াখালীর আনোয়ার হোসেন ও ঘানার ওমর মোহাম্মদ। ৬ এপ্রিল দেশে ফিরেন হেলাল উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন।

নতুন জীবন

এখনো দুঃস্বপ্ন পিছু ছাড়েনি। ঘোরের মধ্যে কাটে সময়। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে জীবন নিয়ে দেশে ফিরেছেন। স্ত্রী-পুত্র-সন্তান আর প্রিয় স্বজনদের হাসি মুখের মাঝে থেকেও ভুলতে পারছেন না মরুতে জিম্মি অবস্থার কথা। হেলাল জানালেন তিনি আর বিদেশ যেতে চান না। দেশেই কিছু একটা করে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চান।

 

 

 

সর্বশেষ খবর