রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রেমিক নজরুল

রণক ইকরাম

প্রেমিক নজরুল

গণমানুষের কবি, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) জীবন হাজার রকম বৈচিত্র্যে ভরা। প্রথম জীবনে আসানসোলে রুটির দোকানের কর্মচারী পরে সেনাবাহিনীর হাবিলদারের জীবন এবং তার সৃষ্টিশীল লেখক জীবন। নানা বৈচিত্র্য ও বর্ণাঢ্য জীবন তার। তার জীবনের নানা অংশজুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আগামীকাল নজরুলের জন্মবার্ষিক উপলক্ষে আজকের আয়োজন।

কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। মোট পাঁচবারে সেখানে প্রায় ১১ মাসেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কবি। তরুণ কবি নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। সেখানে বাড়ির পাশের কামরাঙা গাছতলায় বাঁশিতে সুর তুলে, আর পুকুরঘাটে বসে কবিতা লিখে লিখে সময় কেটেছে তার। নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে নার্গিসের মামা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নজরুলের। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতা) অফিসে আফজাল-উল হকের সঙ্গে থাকতেন। ওই সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতা থেকে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেইলে নজরুল কুমিল্লা এসে পৌঁছেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটিই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাওয়ার পথে তিনি 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতাটি লেখেন। ট্রেনে কুমিল্লা পৌঁছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। চার-পাঁচদিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওনা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশে। তবে সেই চার-পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজা দেবীর সঙ্গে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নজরুল তাকে 'মা' সম্বোধন করতেন।

দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্দীয়স্বজনের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের। কবিতা শুনিয়ে, গান গেয়ে তাদের তো বটেই দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসত কবির নৈকট্য লাভের আশায়। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুনশী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। আর সেই মেয়েটিই কবি নজরুলের প্রথম প্রেম নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে কবির আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। খাঁ বাড়ির মুরবি্বরা নার্গিসের বর হিসেবে নজরুলকে তেমন পছন্দ করতেন না। নজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউণ্ডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্রাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে খোদ নজরুলই বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন।

একদিন নার্গিস নজরুলের কাছে এসে বললেন, 'গত রাতে আপনি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি।' এভাবেই প্রেমের সূত্রপাত। আলী আকবর খান নজরুল-নার্গিসের বিয়ের আয়োজন করলেন জাঁকজমকের সঙ্গে। তার অতি আগ্রহ ও নার্গিসের কিছু আচরণ নজরুলকে এই বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা করে তোলে। ঘটনার আরও অবনতি হয় যখন কাবিননামায় আলী আকবর খান একটি শর্ত রাখতে চাইলেন- 'বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না, দৌলতপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।' এ অপমানজনক শর্ত মেনে না নিয়ে নজরুল ইসলাম বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে গিয়েছিল। তার মানে, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের সঙ্গে নজরুল ইসলামের 'আকদ' বা বিয়ে একেবারেই হয়নি। (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা- মোজাফফর আহমেদ পৃষ্ঠা-৬৭)।

১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। এরপর শুরু হয় নাটকীয়তা। আলী আকবর খান তার গ্রাম্য ভগিনীকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন। অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেন।

নার্গিস কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম বধূ নন, তিনি নজরুলের বাগদত্তা। প্রমীলাই কাজী নজরুলের প্রথম ও একমাত্র স্ত্রী।

১৩২৮ (ইংরেজি ১৯২১ সাল) বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ়

নার্গিস-নজরুলের আকদ হওয়ার কথা ছিল। কাজী নজরুল ৩ আষাঢ় রাতে দৌলতপুর ছেড়ে ৪ আষাঢ় সকালে কুমিল্লায়

এসে পৌঁছেন।

পরবর্তীতে নার্গিস তাদের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিলেন বিধায় ঘটনার প্রায় ১৫ বছর পর নজরুলকে একটি চিঠি লেখেন। ১৫ বছর পরে হঠাৎ একটি পত্র লেখা উপলক্ষের প্রয়োজন ছিল। নার্গিস নজরুলের 'দূত' পাঠানোর একটি বানানো কথাকেই নজরুলকে তার পত্র লেখার উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। চিঠির উত্তরে নজরুল একটি চিঠি ও একটি গান পাঠিয়েছিলেন, যাতে চিঠির উত্তরটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। নজরুল লিখেছিলেন-

"আমি কখনো কোনো 'দূত' প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার সেতু কোনো লোক তো নয়ই স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কি-না সন্দেহ।... তোমার ওপর আমার কোনো অশ্রদ্ধা নেই, কোনো অধিকারও নেই আবার বলছি।... তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে- তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি কোন অধিকারে তোমায় বারণ করব বা আদেশ দিব? নিষ্ঠুর নিয়তি সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী-মূর্তির মতো আমার হৃদয়-বেদিতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম।

সেদিনের তুমি সে বেদি গ্রহণ করলে না। পাষাণ-বেদির মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদি-পীঠ।"

নজরুলের এসব ভনিতা একেবারেই পছন্দ ছিল না, তিনি আলী আকবর খানকে তা জানালেও তিনি নজরুলকে পাত্তা দেন না। সেইসঙ্গে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, নিমন্ত্রণপত্রও অতিথিদের মাঝে বিলিয়ে ফেলেন। এসব ব্যাপার নজরুলকে পীড়া দেয়, আস্তে আস্তে তার মোহ ভাঙতে থাকে। এর ফাঁকে আলী আকবর খান সবার অগোচরে আরও একটি কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি নজরুলের জন্য কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের সব চিঠিই সরিয়ে ফেলতেন, সেইসঙ্গে নজরুলের পাঠানো চিঠিও পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিতেন।

এদিকে নজরুল বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরজাসুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনীত করেন। বিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রণপত্র পান বিয়ের পরে। এরপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ৩ আষাঢ়। যতদূর জানা যায়, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদও সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করার সময়ই ঝামেলা বাধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দেন যে, নজরুলকে ঘরজামাই থাকতে হবে। বাঁধনহারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। আকদ হয়ে যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ। তিনি ছুটে যান বিরজাসুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন, 'মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি'। বিরজাসুন্দরী দেবী বুঝতে পারেন এ অবস্থায় নজরুলকে ফেরানো সম্ভব নয়। তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সঙ্গে দিয়ে দেন। সেই রাতে দৌলতপুর থেকে কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌঁছেন।

পরিশ্রম ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস অধ্যায় সেখানেই শেষ হয়। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে সংগীতচর্চা এবং একটা সুসম্পর্ক ছিল কবির। সেই সূত্রে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়িতে ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করেন কবি। সেখানেই ইন্দ্রকুমারের ভাইয়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যা পরে পরিণয়ে রূপ নেয়।

 

সর্বশেষ খবর