বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাচারে বন্দী মানবতা

সাঈদুর রহমান রিমন ও শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

পাচারে বন্দী মানবতা

৩৪ দেশে বিশ লক্ষাধিক বাংলাদেশি পাচার

স্থল, জল ও আকাশপথে দেদার পাচার হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ বাংলাদেশি। উন্নত জীবন, ভালো চাকরি, মোটা অঙ্কের বেতনের লোভসহ বিদেশ নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটছে মানুষ ছুটছে। আইনি বেড়াজাল, পদে পদে হয়রানি, বেশুমার নিপীড়ন-নির্যাতন, কোনো কিছুই বিদেশমুখী মানুষজনকে বাধা দিতে পারছে না। ফসলি জমি, ভিটামাটি, গরু-ছাগল বিক্রি করেও স্বেচ্ছায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, পাচার হচ্ছে। বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নেই, ওয়ার্কিং ভিসা নেই, থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই; তবুও মানুষ হাজির হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সেখানে দালাল চক্রের সহায়তায় বিমানবন্দর পেরিয়েই পলাতক জীবন বেছে নিতে হয়।

বছরের পর বছর ধরে পলাতক জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে চলে পাচার হওয়া মানুষের দিনাতিপাত। এভাবেই গত ১০ বছরে ৩৪টিরও বেশি দেশে পাচার হয়ে গেছে ২০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি। শুধু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই ৬ লক্ষাধিক বাংলাদেশি অবৈধভাবে বসবাস করছে। ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোতেও বিপুলসংখ্যক মানুষ পাচার হয়ে গেছে। তাদের অনেকেই কর্মদক্ষতার মাধ্যমে নিজেদের জীবন সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলেও বেশির ভাগ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা আর নানা নির্মমতা তাদের নিত্যসঙ্গী।

বাংলাদেশের লোকজন যখন মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে আদম ব্যাপারীদের মাধ্যমে যেতে শুরু করে তখন গ্রামেগঞ্জে একটা কথা চালু হয় 'ফ্রি ভিসা'। বলা হতো এই ফ্রি ভিসায় বিদেশ গেলে যে কোনো কাজ করা যায়। আদম ব্যাপারীদের জালিয়াতির কিন্তু এখান থেকেই শুরু। কারণ ফ্রি ভিসা বলে কোনো ভিসা কোনো দেশে চালু নেই। এটি আসলে ট্যুরিস্ট ভিসা। ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে কেউ কোনো দেশে কাজ করতে পারেন না। এরপর শুরু হয় গলাকাটা পাসপোর্ট। একজনের পাসপোর্টের ছবিতে ফটোশপের মাধ্যমে গলা লাগিয়ে ইমিগ্রেশন পার করার ব্যবস্থা। আজকের দিনে সেটিও এখন আর সম্ভব নয়। সিলেট অঞ্চলে একবার হুজুগ শুরু হয়েছিল 'পেটিকোট ভিসা'র! ব্রিটিশ নাগরিক কোনো মেয়েকে বিয়ে করে স্পাউস হিসেবে বিলাত যাত্রার ব্যবস্থা। আগে আদম ব্যাপারীদের টার্গেট ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। এখন নিম্নবিত্তের লোকজনকে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের লোভ দেখিয়ে অজ্ঞাত যাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে মানব পাচারকারীরা। শুধু নৌকায় নয়, ইমিগ্রেশনের লোকজনকে হাত করে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়েও পার করা হচ্ছে। যাদের কিছুসংখ্যক এখন সাগরে ভাসমান বলে অনেকের নজরে এসেছে। এভাবে বিদেশযাত্রা মানে নিশ্চিত জেল-জীবন। আর এর ধাক্কায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বৈধ সব শ্রমবাজার। জাতিসংঘ সংস্থাগুলো যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, গত বছর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ৮৮ হাজার মানুষকে ভয়ঙ্কর সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই পাচার করা হয়েছে ২৫ হাজার। এই সমুদ্রযাত্রায় গত ১৫ মাসে এক হাজার মানুষের মৃত্যু এবং সমপরিমাণ মানুষ নির্যাতন, ধর্ষণ এবং নৌকা থেকে ফেলে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

বৈধপথে মালয়েশিয়ায় যেতে না পেরে বিপুলসংখ্যক বেকার মানুষ স্টুডেন্ট, প্রফেশনাল ও ফ্রি ভিসায় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে। তারা মালয়েশিয়া গিয়েই চাকরি পাচ্ছেন।

এ খবরটি গ্রামগঞ্জে বাজিয়ে বেড়াচ্ছেন দালাল চক্র। যে কোনো পথে মালয়েশিয়ায় গেলেই ভালো বেতনের চাকরি নিশ্চিত- এমন লোভ দেখিয়ে গ্রামের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষগুলোকে কম টাকায় অবৈধপথে তথা সাগরপথে ট্রলার বা নৌকায় তুলছে পাচার চক্র। গভীর সমুদ্র বা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে তাদের আটকে রেখে পরে বিপুল টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে পরিবারের কাছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা থেকেও অনেকে অবৈধপথে মালয়েশিয়ামুখী হচ্ছেন বলে জনশক্তি খাত বিশ্লেষকরা মনে করেন।

 

সর্বশেষ খবর