বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট

শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট

মানব পাচার সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়মানমারে রয়েছে। তারা সংকেত শব্দের মাধ্যমে মানব পাচার করে। এদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী থাকেন মালয়েশিয়া, সাদ্দাম থাইল্যান্ডে এবং মিয়ামনমারে থাকে আরেকজন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার ১১ ইউনিয়নের তৃণমূল থেকে সমাজের বড় পর্যায়ের মানুষ এখন এই মানব পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মানব পাচারের পেছনে রয়েছে স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ মোড়ল শ্রেণির কয়েকটি পেশাদার দুর্বৃত্ত। এসব মানব পাচারকারী দালালদের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, মোড়ল প্রকৃতির মানুষরা সরাসরি মদদ দিয়ে আসছেন। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় মানব পাচার হচ্ছে। আর এসব পাচারের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রসহ ৭৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তালিকায় খোদ টেকনাফ-উখিয়া আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ ও এমপি বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, শাহপরীর দ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহসভাপতি মো. শরীফ হোসেন, এমপি বদির ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু, বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী আজিজ, টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি নূর মোহাম্মদ মেম্বার, এমপি বদির আত্দীয় সাবরাং ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আক্তার কামাল, এমপি বদির আত্দীয় শাহেদ কামালসহ অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার-পাঁচ বছর আগেও কক্সবাজার জেলার লোকজন পাচারকারীদের ২০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেত। যাত্রাপথে ট্রলারসহ যেসব যাত্রী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধরা পড়ত তাদের মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ যাত্রীই মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা। তখন মালয়েশিয়ায় সমুদ্রপথে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো ফিশিং ট্রলার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনারপাড়া থেকে মনখালী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় সাগরপথ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাসহ ৩ শতাধিক স্থানীয় ও বহিরাগত দালাল। একই এলাকার ফয়েজ আহামদ সহস্রাধিক মানুষ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন। আর এর আয় থেকে তিনি উখিয়া সদর গার্লস স্কুলসংলগ্ন বটতলী এলাকায় কোটি টাকার জমি কিনেন। আরও কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। অপহরণকারী চক্রের মধ্যে রয়েছে লেঙ্গুরবিল এলাকার ডাকাত মোস্তাকের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ, কায়ুকখালীপাড়া এলাকার চোরা সাইফুলের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ। এ ছাড়া গোদারবিল এলাকার সাদ্দাম, শামসু, তারেক, গফুর আলম বাইট্টা, আমির হোসেন অন্যতম। এদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে বাস স্টেশনকেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক বেবিট্যাঙ্ ি(সিএনজি) চালক। এরা ট্যাঙ্েিত অপহৃতদের উঠিয়ে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়।

এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা টেকনাফে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের নিয়ে সাগরে থাকা বড় ট্রলারে উঠিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট। এক সময় শুধু কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দালালরা সিন্ডিকেটের হাতে কর্মীদের তুলে দিত। কিন্তু এখন গোটা বাংলাদেশ থেকে দালালরা পাচারের উদ্দেশ্যে যুবকদের সংগ্রহ করে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপসহ উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ট্রলারে করে লোক পাচার করে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পাচারের ঘটনা-

সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রথমে ওত পেতে থাকে টেকনাফ বাস স্টেশনে। এখানে নাইট কোচগুলো চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে ভোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই বেবিট্যাক্সি,  মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে মালয়েশিয়াগামীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোনো কোনো সময় অপহরণের শিকার হচ্ছেন বেড়াতে আসা অপরিচিত সাধারণ মানুষজন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা একটি অপরিচিত মুখ দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে যায়। দালালরা তাদের হাত-পা বেঁধে তুলে দেয় মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে। পরে থাইল্যান্ড পৌঁছার পর পরিবারকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করতে হয় তাদের। কিছুদিন আগে টেকনাফে মোবাইল টাওয়ারের কাজ করতে আসা বাংলালিংকের এক প্রকৌশলীকে সাবরাং এলাকা থেকে অপহরণ করে মালয়েশিয়ার ট্রলারে উঠিয়ে দেয়।

এলাকাবাসী সূত্রে জনা গেছে, টেকনাফ থেকে দেশজুড়ে ২০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মানব পাচার পরিচালিত হয়ে আসছে। সারা দেশে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে যুক্ত রয়েছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গডফাদাররা। এসব দালাল সিন্ডিকেট কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়া-মহেষখালী-চকরিয়া-চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ১০টি মানব পাচার ঘাট আলাদাভাবে পরিচালনা করে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্কে কাজ করছে সহস্রাধিক দালাল। কাটাবুনিয়া, কচুবনিয়া ও হারিয়াখালী এলাকার মানব পাচারকারীরা সাধারণত কাটাবুনিয়া ঘাট ব্যবহার করে। দুর্গম এলাকা ও যাতায়াত সমস্যার কারণে এই অঞ্চলে সহজেই পৌঁছতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই ঘাট দিয়েই প্রতি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানব পাচার হয়।

 

সর্বশেষ খবর