শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন

ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন

নাসির আলী মামুনের আত্মপ্রতিকৃতি, নিউইয়র্ক, ২০১০

কিংবদন্তিতুল্য আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন। চার দশকের অধিক তিনি দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি তুলেছেন। বাংলাদেশে পোট্রেট আলোকচিত্রের নিজস্ব শিল্পধারা তৈরি করেছেন। তার তোলা ছবিতে থাকে আলো-অন্ধকারের রহস্যময় শিল্পের খেলা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান

 

ছেলেবেলায় আপনি পত্রিকা থেকে বিখ্যাতদের ছবি কেটে রাখতেন?

আমাদের বাসায় ইংরেজি পত্রিকা আসত। আব্বায় রাখতেন। তিনি ইংরেজি কাগজ পড়তেন। পত্রিকা থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিখ্যাত লেখকের ছবি কাটতাম।

 

আপনি ফটোগ্রাফিতে আসলেন কীভাবে?

পাকিস্তান আমলে, মানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে আমার বন্ধু-বান্ধবদের পরিবারের কাছে ক্যামেরা ছিল। আমার এক বন্ধু ছিল, ওর দাদা ছিল ব্রিটিশ আমলের পুলিশ অফিসার। তার একটা ক্যামেরা ছিল। আমার বন্ধু তার দাদার ক্যামেরা চুরি করে মাঝে মাঝে আমারে দিত। সেই ১৯৬৭/৬৮ সাল থেকে আমি ছবি তুলি।

 

আপনি প্রথম জীবনে যে ছবি তুলতেন ওইগুলো ডেভেলপ বা প্রিন্ট করতেন কোথায়?

প্রথমে স্টুডিওতে করতাম, পরে নিজে করতাম। ফিল্মও নিজে ডেভেলপ করতাম বাথরুমে বসে। যে প্লেটে খেতাম ওই প্লেটের মধ্যেই ডেভেলপ করতাম। গ্রীণ রোডে 'নেহার স্টুডিও' ছিল। এর মালিক ছিলেন আবুল সাহেব। ওনার বিহারি কর্মচারীদের একজন ছিল শওকাত। সে থাকত নবাবপুরে। তার কাছ থেকে আমি ডেভেলপের কাজ শিখেছি। নেহার স্টুডিও থেকে আমি ক্যামেরা ধার নিতাম ১/২ ঘণ্টার জন্য। ছবি তুলে যথা সময়ে ফেরত দিতাম।

পোট্রেট ফটোগ্রাফির চিন্তাটা কখন মাথায় এলো?

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তিনজন নভোচারী ঢাকায় এসেছিলেন। তাদের একজন রাস্তায় একটা ছবি তুলছিল। তেজগাঁ এয়ারপোর্ট থেকে ওরা আসছিল হোটেল শেরাটনে। তারা একটা খোলা জিপে বসা, ওই ছবিগুলো আমারে দেখাল যে, 'এরিয়েল ফটোগ্রাফি' নামেও একটা ফটোগ্রাফি রীতি আছে। তখন আমি জানলাম যে, ছবিও তোলা যায় আকাশ থেকে! এটা তো অদ্ভুত ব্যাপার আমার কাছে। তখন জানতে পারি, মানুষের ছবি তুললে ওটা 'পোট্রেট ফটোগ্রাফি'। ১৯৬৮-৭০ সালের দিকে বন্ধু-বান্ধব আর ভাই-বোনদের ছবি তুলেছি ঘরের মধ্যে। সেগুলো অলমোস্ট স্টুডিওর পাসপোর্ট ছবির মতো আরকি। আমি দেখলাম, বাংলাদেশের আলোকচিত্রে তখন প্রধানত প্রকৃতি-নির্ভর ছবি। প্রকৃতিকে বিষয়বস্তু করে বাংলাদেশের সব ফটোগ্রাফার আলোকচিত্র চর্চা করেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন একটা দিকে যাব যেদিকে নতুন একটা পথের সূচনা হবে। এই পোট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা করলাম ১৯৭২ সালে। ছয় বছর আমার কোনো ক্যামেরা ছিল না। 'ক্যাওয়া' নামে জাপানি একটা ক্যামেরা কিনেছিলাম, যা ৩২ বার নষ্ট হয়েছিল। যখন ৩৩ বার নষ্ট হয় তখন আর সেটা দোকান থেকে ফেরত আনিনি। ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি কবি শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কমরেড মনি সিংয়ের ছবি তুলেছি।

 

ছবির সাবজেক্ট হিসেবে বিখ্যাত মানুষের মুখ বেছে নিলেন কেন?

মানুষ পৃথিবীতে আসে অল্প সময়ের জন্য। যারা সৃজনশীল মানুষ তারা কাজ করে ২০ কিংবা ৪০ বছর, তারপর হারিয়ে যায়। ক্যামেরার সামনে তাদের আর পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে এত রূপ এত রঙ এগুলো সারা পৃথিবীতেই আছে। আমি দেখলাম আমার দেশের শিল্পী এস এম সুলতান, কবি শামসুর রাহমান, প্রফেসর ইউনূস তারা একজনই। এরা শুধু এ দেশেই আছে, এদেরকে অন্য কোথাও গেলে পাওয়া যাবে না। যারা সৃজনশীল তারা অনেক কাজ করে একসময় উধাও হয়ে যায়। আর ফেরে না। এসব মানুষকে ধরে রাখা, তাদের কষ্ট-দুঃখ-যন্ত্রণা আমি ক্যামেরায় ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।

 

ছবি তোলার জন্য অর্থনৈতিক সাপোর্ট কীভাবে পেতেন?

আমি না খেয়ে থেকেছি, রাস্তায় ঘুরেছি। দরিদ্রতা এড়ানোর জন্য ১৯৮৮ সালে গেলাম আমেরিকা। সেখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। আমি জানি আমেরিকায় গেলে আমার ফটোগ্রাফির ক্ষতি হবে। কিন্তু গেছি শুধু কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে, ভালো একটা ক্যামেরা কিনতে পারব। সেখানে অনেক কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমেরিকায় ছিলাম ১১ বছর।

শান্তিতে নোবেল জয়ী মাদার তেরেসা বা ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁর ছবি তুলতেও নাকি আপনাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল।

শান্তিতে নোবেল জয়ী মাদার তেরেসা ঢাকায় আসেন ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে। এই মহীয়সী নারী কোনো প্রেস এলাউ করছিলেন না। কোথায় তার কী অনুষ্ঠান কিছুই জানা যাচ্ছিল না। শুধু শুনেছিলাম তেজগাঁও চার্চে তিনি আসবেন। আমি ওই চার্চের গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন তিনি ওই চার্চে আসেন। কিছুক্ষণ পরই দেখি তিনজন নান আর সঙ্গে মাদার তেরেসা চার্চ থেকে বেরিয়ে মাইক্রোতে উঠছেন, তিনি যাবেন পুরান ঢাকায়। আমি তার গতিরোধ করলাম, আমার সঙ্গে ছিলেন ওই সময়ের ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মস্তান। আমি বললাম, ছবি তুলতে দিতেই হবে। মাদার তেরেসা খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি বললেন, 'তোমরা কি জানো অনেক শিশু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমরা কি অনুতপ্ত নও।' আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। পরে মাদার তেরেসা ছবি তুলতে দিলেন। অনেক ছবি তুললাম।

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ ঢাকায় আসেন ২০০০ সালে। তিনি যে কয়দিন ঢাকায় ছিলেন প্রতিদিনই আমি চেষ্টা করছিলাম তার পোট্রেট ছবি তোলার, কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না। পরে যেদিন তিনি ঢাকা ছাড়বেন সেদিন তার বড় ছেলেকে গিয়ে বললাম আমার মা তো 'শিয়া'। বললাম, তোমরা তো শিয়া, এখানে তো শিয়া কম, একটা ছবি যদি না তুলি তাহলে কেমন হয় ব্যাপারটা। শিয়া বলার পর দেখলাম, মুহূর্তের মধ্যে তার বড় ছেলে কেমন যেন হয়ে গেল। তিনি বললেন, 'কোনো চিন্তা কর না, আমার বাবার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।' তার ছেলে আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিসমিল্লাহ খাঁ সবসময় অজু করা অবস্থায় থাকতেন। আমি তার সঙ্গে কিছু কথা বললাম। কিছু ছবি তুললাম। 'শিয়া' পরিচয় দেওয়াটা ছিল আমার একটা টেকনিক।

 

আপনার সঙ্গে বিটগুরু অ্যালেন গিন্সবার্গের দেখা হয়েছিল। তার সাক্ষাৎ নিয়ে কিছু বলুন।

'দেশ' পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখায় তার সম্পর্কে আমি পড়েছিলাম এবং তার ছবি দেখেছিলাম। সামনাসামনি গিন্সবার্গের দেখা পাই আমেরিকায় ১৯৮৯ সালে। তখন নিউইয়র্কে টমকিন স্কয়ার পার্কে মে দিবসের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ওই পার্কে আমি ঘোরাঘুরি করছি। হঠাৎ দেখি যে দাড়িওয়ালা এক লোক ছবি তুলছে। আমি গিন্সবার্গকে জিজ্ঞেস করলাম- 'এঙ্কিউজ মি, আর ইউ অ্যালেন গিন্সবার্গ?' আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি দ্রুত হাঁটা ধরলেন। আমি তার পিছে পিছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'ডু ইউ নো সুনীল? আই অ্যাম ফরম ক্যালকাটা, হি ইজ মাই ভেরি গুড ফ্রেন্ড।' গিন্সবার্গ আমার মুখের দিকে তাকালেন। তিনি আমাকে বললেন, 'হ্যাঁ, সুনীলকে তো আমি চিনি। সুনীল কেমন আছে?' আমি বললাম, ভালো আছে। আমি গিন্সবার্গের কয়েকটা ছবি তুললাম। পরেও ছবি তুলেছি।

 

কবি জসীমউদ্‌দীন তো আপনার ফুপা।

জসীমউদ্‌দীনের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে নয়, এমনিতেই আমি যেহেতু বিভিন্ন সৃজনশীল মানুষের ছবি তুলতাম, এ কারণেও তার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তার স্ত্রী আমার ফুফু অসাধারণ একজন মহিলা। ২০০৩ সালে জসীমউদ্‌দীনের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সম্পাদনা করি জসীমউদ্‌দীন স্মারক গ্রন্থ। আমার মধ্যে জসীমউদ্‌দীন বাস করত বলেই আমি এ কাজটি করতে পেরেছিলাম। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও এরকম একটি কাজ করা সম্ভব হয়নি।

 

শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে আপনার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

সুলতান সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম ১৯৭৬ সালে মুনতাসীর মামুনের একটি লেখা থেকে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত ওই লেখার শিরোনাম ছিল- 'যে জীবন যার'। সেখানে তার একটা ছবিও ছিল, তিনি খালি গায়ে ছবি অাঁকছেন। ওই লেখাটা পড়ে এত উজ্জীবিত হয়েছি যে, আমি শিল্পকলায় তার ছবি দেখতে যাই, তাকে সেখানে দেখি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি। তার সঙ্গে নাকি বেজি ও সাপ থাকে। পরে সুলতানের সঙ্গে অবশ্য সখ্য গড়ে ওঠে। সুলতান আমাকে পছন্দ করত। সুলতানের ওপর আমি একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। তার ওপর 'গুরু' নামে একটি বইও করেছি।

 

আপনি একটি মিউজিয়াম করতে চেয়েছিলেন?

গত চার দশকে আমি দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি তুলেছি। তাদের ছবিসহ দুর্লভ অনেক ডকুমেন্ট আমার সংগ্রহে আছে। সেগুলো নিয়ে 'ফটোজিয়াম' নামে একটি মিউজিয়াম করতে চাই। এটা ব্যয়সাপেক্ষ। ইতিমধ্যে মিউজিয়ামের জন্য সাভারের জোরপুরে পাঁচ কাঠা জমি ক্রয় করা হয়েছে। সবার সহযোগিতা পেলে মিউজিয়ামটি দাঁড় করাতে পারব।

 

 

সর্বশেষ খবর