শনিবার, ৩০ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর কঙ্কাল হ্রদ

তানভীর আহমেদ

ভয়ঙ্কর কঙ্কাল হ্রদ

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মাইল উঁচুতে অবস্থিত একটি হ্রদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে খুঁজে পাওয়া গেল ২০০টি মানুষের কঙ্কাল। বিশ্বজুড়ে খবরটি ছড়িয়ে গেল বাতাসের বেগে। কৌতূহলের কেন্দ্রে চলে এলো কঙ্কাল হ্রদ। গবেষক আর বিশ্লেষকদের একের পর এক তত্ত্ব আর মতামত ভুল প্রমাণিত হতে লাগল। পৃথিবীর সেরা রহস্যের একটি এখনো কোনো সমাধান খুঁজে পায়নি কেউ-

কঙ্কাল হ্রদ। কঙ্কাল ছড়িয়ে থাকা এক রহস্য। যে রহস্য আজো পৃথিবীর অমীমাংসিত রহস্য হয়ে টিকে আছে। ইন্ডিয়ান লেকে নবম শতাব্দীর মানুষের কঙ্কাল খুঁজে পাওয়ার কথা মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী জেনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ব্রিটিশ পেট্রোল বাহিনী এ পথ ধরে এগোচ্ছিল তখন হঠাৎ চোখ আটকে যায় তাদের। মানুষের খুলি আর শরীরের হাড় দেখতে পেয়ে থামে তারা। প্রথমে একটি কঙ্কাল তারপর আরেকটি। এক, দুই, তিন করে যখন কঙ্কালের বহর বাড়ছিল তখন পুরো দ্বীপ নিয়ে তারা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তারা সেবার ২০০ কঙ্কাল খুঁজে পেয়েছিলেন। এই দেহগুলো কাদের হতে পারে সে প্রশ্ন বুকে নিয়ে দ্বীপজুড়ে চালানো হয় গবেষণা। কিন্তু তখনো খুব বেশি জানা যায়নি। তারা ভাবল এই দেহগুলো জাপানি সৈন্যদের হতে পারে। কোনো দুর্যোগ, প্রাকৃতিক কারণে বা দস্যুদের হামলায় হয়তো তারা প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার যন্ত্র কাজে লাগিয়ে সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়। এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি এই মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে, নাকি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের প্রাণ গেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০। তখন কী এমন ঘটেছিল? সেটা জানতে এই কঙ্কাল হ্রদের কঙ্কালগুলো এখনো পৃথিবীবাসীর কাছে কৌতূহলের চূড়ান্তে রয়েছে। পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই। এখনো বহু রহস্যময় বিষয় রয়েছে যেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। কঙ্কাল হ্রদে পাওয়া কঙ্কালগুলো নিয়ে কৌতূহল নিরসন করতে গিয়ে পাওয়া গেছে বিচ্ছিন্ন কিছু উত্তর। ভারতীয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল দবি করে, রূপকুণ্ড হ্রদটিকে কেন্দ্র করে খ্রিস্ট জন্মের আগে থেকেই রহস্য চালু ছিল। তখন অনেক মুনি আর ঋষির নামে বিভিন্ন গল্প চালু ছিল হ্রদটিকে কেন্দ্র করে। তবে ১৯৪২ সালের দিকে একজন বনরক্ষী হঠাৎ হ্রদটি এবং অনেক গণকবর আবিষ্কার করেন। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, কঙ্কালগুলো ১২ থেকে ১৫ শতকের সময়কার। কিন্তু মানুষের মনে আজও ভাবনা ঘুরপাক খায় এই ভেবে, কেন ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে সেই নয় শতকের সময়ে একসঙ্গে এতগুলো মানুষের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলো এবং প্রাপ্ত গহনা পরীক্ষা করে জানান, এগুলো কোনো রাজকীয় বাহিনী বা একদল তীর্থযাত্রীর। এমনও হতে পারে, এই মানুষগুলো কোনো তীব্র তুষারঝড়ের কবলে মারা গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হাজির করেন একদল নৃতত্ত্ববিদ। তাদের ভাষ্যমতে, ওই অঞ্চলে বসবাসরত কোনো গোষ্ঠী গণহারে আত্মহত্যা করেছিলেন। এ হলো মূল রহস্য। পৃথিবীবাসীর সামনে এই রহস্যের আবির্ভাব খুব বেশি দিন আগে নয়। আরেকদল অবশ্য বলে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এই রাজকীয় বাহিনী বা তীর্থযাত্রী দলের মানুষগুলোর মৃত্যু হয়েছে। এ হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মাইল উঁচুতে অবস্থিত। অনেক পর্যটক এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ মানচিত্র ঘেঁটে এবং বছরের পর বছর অনুসন্ধান চালিয়েও হ্রদটির সন্ধান পায়নি। আবার এমনো হয়েছে, অল্প একটু চেষ্টাতেই অনেকে দেখতে পেয়েছেন হ্রদটিকে। সবচেয়ে বড় কথা- এটি সবাই দেখতেও পান না। এর আশপাশের এলাকাও ছিল অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। এতদিন পর্যন্ত কেউই এখানকার হ্রদটির কথা জানত না। কারও বর্ণনায় এই হ্রদের কথা পাওয়া যায়নি। এটি একটি হিমবাহ হ্রদ। এটির অবস্থান ভারতের উত্তরখণ্ডে। এ ছাড়া অনেকে বলেন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মানুষ জানত এই কঙ্কালগুলোর কথা। কারা এই হতভাগ্যরা? কীভাবে তারা মারা গেল? যুগের পর যুগ কৌতূহলী মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। এই হ্রদটির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ঠিক যে সময় থেকে এ হ্রদটি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হলো, তখন থেকেই এর সঙ্গে রহস্যের ব্যাপারটি একেবারে মিলেমিশে গেছে। ভারতে অবস্থিত এই হৃদটিকে মানুষজন রূপকুণ্ডের রহস্যময় অভিশপ্ত কঙ্কাল হ্রদ হিসেবেই চেনে। এখানে ৫০০-র মতো মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ কারণে রূপকুণ্ড হ্রদের নাম হয়ে যায় কঙ্কাল হ্রদ। ১৯৪২ সালে নন্দা দেবী রিসার্ভ পার্কের রেঞ্জার এইচ কে মাধওয়াল এই কঙ্কালগুলো প্রথম আবিষ্কার করেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এগুলো জাপানি সৈন্যদের কঙ্কাল যারা ওই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তারা মারা যায়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে দেখল কঙ্কালগুলো অন্তত এক শতাব্দী প্রাচীন। অনেকে ভাবলেন এটা জম্মু কাশ্মীরের রাজা জেনারেল জরাইয়ার সিংয়ের সেনাদের যারা বালিতস্তান আক্রমণের সময় হারিয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে ভারতীয় সরকার সেখানে সার্ভে টিম পাঠায়। তারা সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে রেডিও কার্বন ডেটিং করে জানা গেল এগুলো অন্তত ১২ থেকে ১৫ শতাব্দীতে হবে। তখন অনেকে ধারণা করলেন এরা মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সেনাবাহিনী হবে যারা তিব্বত দখল করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ১৯৫৬ সালের পদ্ধতি ছিল অনেক ত্রুটিপূর্ণ। অনেকে ধারণা করলেন এরা কোনো মহামারীর শিকার হয়েছে। এ অঞ্চলের নিচের জনপদগুলোতে লোককাহিনী প্রচলিত আছে যে, প্রাচীনকালে কনৌজের রাজা যসোয়াল এখানে আসেন নন্দ দেবীর উপাসনা করতে; কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসেন বাইজি। এতে এই স্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়। তাদের ওপর শিলাবৃষ্টি হয় এবং তারা হ্রদের ভিতর নিক্ষিপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ লোককাহিনীকে গালগল্প বলে ধরে নিলেও এর ভিতর ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, কনৌজের রাজা যশোয়াল, তার রানী ও পরিষদবর্গসহ নন্দী দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার জন্য গিয়েছিলেন। আজও প্রতি ১২ বছর পরপর রূপকুণ্ডে নন্দী দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়। তবে কোনো কিংবদন্তিতেই অদ্ভুতুড়ে এই হ্রদের কথা উল্লেখ নেই। স্থানীয় আদিবাসী তো বটেই গোটা বিশ্ববাসীর কাছেই রূপকুণ্ড একটি মৃত্যু বিভীষিকার নাম। ২০০৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের উদ্যোগে একদল গবেষক এই রহস্য ভাঙার উদ্যোগ নেন। এর নেতৃত্ব দেন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্। দলটিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তারা নানা হাড়গোড়ের নমুনা সংগ্রহ করেন। দলটি একটি বিশাল সাফল্য লাভ করে যখন তারা একটি অক্ষত দেহ উদ্ধার করে। হিমালয়ের বরফশীতল তাপমাত্রা দেহটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। এতে তারা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে সুবিধা পেলেন। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কঙ্কালের খুলিতে অগভীর আঘাতের চিহ্ন পেলেন। পুনের ডেকান কলেজের প্রফেসর ডা. সুভাষের মতে এই অগভীর আঘাতের কারণ কোনো তুষারধস নয় বরং গলফবলের মতো ছোট কঠিন বস্তুর আঘাতের ফলাফল। একই সঙ্গে কয়েকশ' মানুষ মাথায় একই রকম আঘাত পেল এবং মারা গেল এটা নিশ্চয়ই ওপর থেকে আঘাত করেছে। তাদের ধারণা এটা শিলাবৃষ্টি হবে। প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্ স্থানীয় একটি পালাগানের কথা স্মরণ করেন যেখানে বলা হয়েছে রুষ্ট দেবী পাপিষ্ঠদের উপর এমন শিলা নিক্ষেপ করেন যা পাথরের থেকেও ভারী। এ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা কাপড়, জুতা, কাচের চুড়ি, বাঁশের লাঠি উদ্ধার করেন। এ থেকে বোঝা যায় তারা তীর্থযাত্রী ছিলেন। সেখানে এখনো বরফের নিচে ৬০০ দেহ চাপা পড়ে থাকতে পারে। এই নমুনাগুলো ব্রিটেনের অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও কার্বন এক্সিলেটর ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানকার গবেষকরা জানান, নমুনাগুলো ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বের। যা ১৯৫৬ সালের রিপোর্টের আরও বহু আগে। হায়দরাবাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় লাশের হাড়ের নমুনা থেকে তিনটি এমন জিন পাওয়া গেল, যা মহারাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের আর কোথাকার মানুষের ভিতরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে আরও কিছু মানুষের চেহারা হিমালয়ের আশপাশের মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর। অতএব এটা বলা স্বাভাবিক যে, তীর্থযাত্রীরা স্থানীয়দের কুলি হিসেবে নিয়োগ করেছিল। রূপকুণ্ড থেকে স্থানীয় মানববসতির দূরত্ব ৩৫ কি.মি। তাই বাইরের লোকেরা স্থানীয়দের সহায়তা ছাড়া সেখানে যেতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটা ধারণা করা যায় আজ থেকে ১৩০০ বছর আগে এক হাজারের মতো লোক হিমালয়ের উপরে অজানা পরিবেশে চলছিল। তাদের সঙ্গে কুলি হিসেবে ছিল স্থানীয়রা। সেখানে পুরুষ, মহিলা এবং শিশু ছিল। হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। পালানোর কোনো উপায় ছিল না। শিলার আঘাতে একে একে মৃত্যুর মুখে পতিত হলো সবাই। কিছুক্ষণের ভিতর রূপকুণ্ড হয়ে গেল এক মৃত্যুপুরী। তাদের দেহ হ্রদের উপর পতিত হলো। কিছু বরফ চাপা পড়ল। দিন পেরিয়ে মাস হলো, মাস পেরিয়ে বছর, তারপর শতাব্দীও কেটে গেল।

ভারতবর্ষে এখনো বিশাল ভূকুণ্ড ভারত বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা সৌন্দর্য ধারণ করে আছে। দেশটিতে আছে ঊষর মরুভূমি, আছে বরফাচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলও। আছে রহস্যঘেরা কয়েকটি স্থানও। ককেশীয় অঞ্চলের মানুষদের কাছে ভারত ছিল তান্ত্রিকদের পুণ্যভূমি। আবার ইউরোপবাসীর কাছে জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল, বুনো মানুষের বসবাস। কিন্তু যুগের হাওয়ায় এসব রহস্য এখন আর হালে পানি পায় না। কিন্তু তার পরও ভারতের কয়েকটি অঞ্চল ঘিরে মানুষের মধ্যে আজো রহস্য ঘুরপাক খায়। তেমনি একটি অঞ্চল হিমালয়ের রূপকুণ্ড হ্রদ। এই রূপকুণ্ড সত্যিই রূপের আধার। রহস্যের শেষ নেই যেন। কোথাও শুনতে পাওয়া যায় এই হ্রদে এমনো কিছু স্থান আছে, যেখান থেকে মানুষ আর কখনো ফিরে আসে না। সে রহস্য বুকে নিয়ে কঙ্কাল হ্রদ চির রহস্যের এক আধার হয়ে রয়েছে।

 

 

সর্বশেষ খবর