বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

সুন্দরবনের শিলা কাঁকড়া

আহসানুল করিম, বাগেরহাট

সুন্দরবনের শিলা কাঁকড়া

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের নদ-নদী ও জেলার এক হাজার ৪০৪টি কাঁকড়া খামারে প্রতিবছর গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া। সুন্দরবন ও বাগেরহাটের খামারে উৎপাদিত এই কাঁকড়ার ৯০ ভাগই রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। কাঁকড়া থেকে দেশ আয় করছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
সরকার খামারিদের (চাষি) সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে, বিশ্বজোড়া সুনামের এই শিলা কাঁকড়া চাষে অগ্রাধিকার দিলে দ্রুত বর্ধনশীল এই রপ্তানি পণ্য মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সহজেই চিংড়িশিল্পকে টপকে যেতে পারে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, ডলফিন, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের কারণে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের খ্যাতি রয়েছে তা নয়, শিলা কাঁকড়ার জন্যও রয়েছে এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বাংলাদেশের ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের এই জলভাগের ৪৫০টি নদ-নদী ও খালসহ বিশাল প্লাবনভূমিতে পাওয়া যায় ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া। প্রতিবছর ‘কাঁকড়ার খনি’ সুন্দরবন থেকে আহরিত হয় তিন হাজার ৬০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া ও চিংড়ি। বন বিভাগের হিসাবমতে, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে কাঁকড়া। এই ১৩ প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে রপ্তানি পণ্য শিলা প্রজাতির কাঁকড়া আর শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এর প্রতিটির ওজন ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম। শিলা কাঁকড়া জীবিতাবস্থায় প্লাাস্টিকের ঝুড়িতে রপ্তানি হচ্ছে বিশ্ববাজারে।
বাগেরহাটের মংলার কাঁকড়াঘেরের মালিক মো. কামরুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রজনন মৌসুমে তিনি সুন্দরবনের নদ-নদী ও খাল থেকে লবণাক্ত পানির শিলা প্রজাতির কাঁকড়ার পোনা জেলে-বনজীবীদের কাছ থেকে প্রতি হাজার কিনে থাকেন ৩০০ টাকা দরে। এক একরের লবণাক্ত পানির ঘেরে বাঁশের চটার বেড়া দিয়ে ঘিরে এতে তিনি ছেড়ে দেন প্রায় দেড় লাখ কাঁকড়ার পোনা। নিয়মিত খাবার দিয়ে পোনাগুলোকে বড় করে বিক্রির উপযোগী ভালো গ্রেডে আনতে তার সময় লাগে চার থেকে পাঁচ মাস। এ ছাড়া তিনি বছরের বাকি সময় জেলে-বনজীবীদের কাছ থেকে ২০০ গ্রামের নিচের ‘গ্রেড লেস’ কাঁকড়া কম দামে কিনে খামারে বড় করে বিক্রি করেন। নিয়মিত খাবার ও সঠিক পরিচর্যা করলে একেকটি শিলা কাঁকড়ার ওজন ৫০০ গ্রামের বেশি হয়ে থাকে। কখনো কখনো একেকটি শিলা কাঁকড়ার ওজন এক কেজির বেশিও হয়। ৫০০ গ্রাম গ্রেড সাইজের কাঁকড়া তিনি আড়তদারদের কাছে কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন। মৎস্য বিভাগের পরামর্শ নিয়ে কামরুজ্জামান বিজ্ঞানসম্মতভাবে এক একরের কাঁকড়া খামার থেকে খরচ বাদে বছরে সাত থেকে আট লাখ টাকা আয় করছেন। লবণাক্ত পানির এ কাঁকড়া প্রায় রোগবালাইমুক্ত। পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও নষ্ট না হলে খামারের কাঁকড়া মারা যায় না। বাগেরহাটের লবণাক্ত এলাকার চিংড়িঘেরগুলোতে রোগ-বালাই লেগে থাকায় আর্থিকভাবে খামারিরা লোকসান দিয়ে থাকেন। ফলে অনেক খামারি এখন চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন। বিগত বছরগুলোতে এ জেলায় লাভজনক কাঁকড়া খামারের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করেন কাঁকড়া-খামারি কামরুজ্জামান। প্রায় একই গল্প এ জেলার অধিকাংশ কাঁকড়া-খামারি ও আহরণকারী জেলেদের। তারা জানান, সরকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চিংড়ি চাষকে যেভাবে উৎসাহিত করছে একইভাবে কাঁকড়া চাষে খামারিদের সুযোগ দিলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে খুব সহজে রপ্তানি বাণিজ্যে শীর্ষস্থান দখল করতে পারে এ শিল্প।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল জানান, কাঁকড়া লবণাক্ত পানিতে জন্মে থাকে। বঙ্গোপসাগর উপকূল ও সুন্দরবন হচ্ছে কাঁকড়ার প্রকৃত আবাসস্থল। জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর থেকে খোলস পাল্টানোর মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে কাঁকড়া। যত খোলস পাল্টায় ততই বড় হয়। কাঁকড়া ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক হয়ে ডিম পাড়ে। ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে কাঁকড়ার। এসব বাচ্চাকাঁকড়া পুরুষ, মহিলা ও হিজড়া হয়ে থাকে। পরে হিজড়াগুলো খোলস পাল্টে একপর্যায়ে পরিণত হয় মহিলা ও পুরুষ কাঁকড়ায়। একেকটি কাঁকড়া অনুকূল পরিবেশ পেলে সাড়ে তিন থেকে চার বছর বেঁচে থাকে। তিনি জানান, বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন ছাড়াও গত বছর জেলার ছয়টি উপজেলার লবণাক্ত প্লাবনভূমির প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন শিলা কাঁকড়া উৎপাদন করেন খামারিরা। এ খামারের সংখ্যা এক হাজার ৪০৪টি। এর মধ্যে রয়েছে মংলা উপজেলায় ৫৬৪টি, রামপালে ৪৩২, শরণখোলায় ১৯৮, সদরে ৯৩, মোরেলগঞ্জে ৭৫ ও কচুয়া উপজেলায় ৪২টি। সারা বছরই এ জেলায় শিলা কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের নদ-নদী থেকে জেলেদের আহরিত ও জেলার খামারিরা সব মিলিয়ে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন শিলা কাঁকড়া উৎপাদন করে থাকেন। এ বছর উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিবছর বাগেরহাট জেলায় কাঁকড়ার খামার বাড়ছে।
বাংলাদেশ লাইফ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবমতে, সাত হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করে দেশ আয় করেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে প্রায় সারা বছর মংলা, রামপাল, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, দাকোপ, কয়রাসহ সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার বিপুলসংখ্যক জেলে-বনজীবী সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব জেলে-বনজীবীরা সরকারি রাজস্ব দিয়ে বন বিভাগের কাছ থেকে বৈধ পারমিট নিয়ে সুন্দরবনের কাঁকড়া ধরেন। চলতি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাস কাঁকড়ার ভরা প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এ সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে কাঁকড়া আহরণ নিষিদ্ধ। প্রজনন মৌসুমে গভীর সমুদ্র ও বড় নদী থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য কাঁকড়া সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে দলে দলে চলে আসে। এ কারণে সুন্দরবনে এ দুুই মাস বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি কাঁকড়া পাওয়া যায়। এ সময় বেশি লাভের আশায় অসাধু মহাজনেরা গরিব জেলেদের অগ্রিম টাকা দিয়ে সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে কাঁকড়া আহরণ করতে পাঠান। আর ওই অসাধু মহাজনেরা সুন্দরবন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে দেদার ডিমঅলাসহ সব ধরনের কাঁকড়া শিকারের ব্যবস্থা করেন। মংলার কয়েকজন আড়তদার জানান, তারা ডিমঅলা কাঁকড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে কিনে থাকেন। এসব কাঁকড়া ঢাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে নির্বিচারে কাঁকড়া শিকারের ফলে হুমকিতে রয়েছে শিলা প্রজাতির কাঁকড়া।

সর্বশেষ খবর