শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বহমান কপোতাক্ষের কবি

বহমান কপোতাক্ষের কবি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শনিবার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজ নারায়ণ দত্ত ছিলেন তৎকালীন সময়ে কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন সুখ্যাত আইন ব্যবসায়ী। মাতা জাহ্নবী দেবীও ছিলেন সে সময়ে কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন আইন ব্যবসায়ী। মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত কাঠিপাড়ার বিখ্যাত জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা। এমনিতেই এই মহাকবির কর্মজীবন কুসুমশোভিত ছিল না। উপার্জনের তুলনায় ব্যয়ের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কারণে তার সংসার জীবনে আর্থিক দৈন্য কোনোদিনই কাটেনি। তিনি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, শিক্ষকতা করেছেন, পুলিশ কোর্টের কেরানি ছিলেন সাংবাদিকতা করেছেন, আইন ব্যবসা করেছেন, অনুবাদকের কাজও করেছেন, কিন্তু কোনোভাবেই কবির সংসার জীবনে আর্থিক অসচ্ছলতা কাটেনি। শিশুকালে মধুসূদনের হাতেখড়ি হয়েছিল তাদের বাড়ির চণ্ডী মণ্ডপে। এরপর শেখপুরা গ্রামের এক মৌলভী শিক্ষকের কাছে ফারসি শিখতেন। ১৮৩৭ সালে মধুসূদন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে ইংরেজি ও ফারসি অধ্যয়ন করেন। ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কবি মধুসূদন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। মধুসূদন যেদিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন, সেদিন মিশন রো-তে গির্জার চারদিকে উত্তেজিত জনতার দৃশ্য কল্পনা করা যায়। কারণ দীক্ষা গ্রহণের আগেই তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে গির্জায় আসেন। এ সময় তিনি হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরের বিশপস্ক কলেজে ভর্তি হন এবং চার বছর সেখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে অধ্যয়নকালে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, ফারসি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ত করেন। ১৮৪৪ সালে কলকাতার মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় তার অনূদিত পারস্যের কবি শেখ সাদীর একটি গজল অডি নামে প্রকাশিত হলে ইংরেজি রচনায় তার প্রতিভার স্বাক্ষর পরিলক্ষিত হয়। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় মাইকেল পিতার অর্থ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ১৮৪৭ সালে পরিবার ত্যাগ করে মাদ্রাজের পথে পাড়ি জমান। অকূলে ভাসতে ভাসতে মাদ্রাজ বন্দরে এলেন। বিলেত যাওয়া হলো না। বিলেতে যেতে হলে জাহাজে ভাসতে হয়। মাদ্রাজ বন্দরে জাহাজে চার দিন কাটালেন। সমুদ্র যাত্রায়-দুঃখ, যাতনা ও হতাশায় তার জ্বর এলো। অবশেষে বন্দর থেকে মাদ্রাজ পৌঁছে গেলেন তিনি। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। মাদ্রাজের পথে পথে মধু ঘুরছেন ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু ভাগ্য তার বড় একটা সহায় হলো না। এসে উঠলেন ব্লাক টাউনে। অসুস্থতা আরও বাড়ল। ব্লাক টাউনের মেডিকেল অফিসার মিস্টার ডেভিডসনের চিকিৎসায় এবং দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় তিনি ধীরে ধীরে নিরাময় হয়ে উঠলেন। মাদ্রাজে গমনকালে তিনি বসন্ত রোগেও আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় তিনি এখানে অনাথ আবাসিক হাইস্কুলে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে মাদ্রাজ সার্কুলেটর জেনারেল ক্রনিকাল, এথেনিয়াম এবং স্পেকটেটর পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ নেন। তারপর 'এথেনিয়াম' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাদ্রাজের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আরবুথনট কোম্পানির কুডাপ্পা জেলার অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট নিলকর ডুগালড ম্যাকটাভিস এরন আশ্রিত সুন্দরী কন্যা রেবেকা ম্যাকটাভিসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৮৪৯ সালে এপ্রিল মাসে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ইংরেজিতে লিখিত 'দ্য ক্যাপটিভ লেডি' প্রকাশ হয়। এরই মধ্যে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে কলকাতায় আসেন। সেবার গোপনে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। ১৮৫৪ সালের ডিসেম্বর। মধুসূদন মাদ্রাজের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা 'স্পেকটেটর' এর সাব-এডিটর নিযুক্ত হলেন। তখন কলম হলো আয়ের উৎস। ১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কবির পিতা পরলোক গমন করেন। রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পিতার সম্পত্তি রক্ষার্থে কলকাতায় আসেন তিনি। তিনি এলেন কপর্দকহীন অবস্থায়। চার-চারটি সন্তানসহ রেবেকা জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। মধুসূদন গৌরদাসের বাড়িতে থাকলেন কিছুদিন। তারপর বছর ছয়েক চলল। ১৮৫৭ সালে পুলিশ আদালতে দোভাষীর পদে নিযুক্ত হন তিনি। ৪০ টাকা মাইনে তখন। ১৮৫৮ সাল। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগান্তর সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। এ বছর তিনি হর্ষের 'রত্নাবলী' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। বাংলা নাটকের দুর্দশা মোচনে 'শর্মিষ্ঠা' নাটক লিখে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং নাট্যান্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এ সময় মহারাজ যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এবং প্রতাপ চন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ১৮৫৯ সালে তার শর্মিষ্ঠা নাটক পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে নাটকটি বেলগাছিয়া রাজাদের মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়। এরপর আরও নাটক রচনায় মনোনিবেশ। 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং তার অল্প দিন পরেই 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নামে দুটি প্রহসন রচিত হয়। ১৮৬১ সালের জানুয়ারিতে 'মেঘনাদ বধ কাব্য' প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এর আগেই ১৮৬০ সালে তার 'পদ্মবতী, নাটক প্রকাশিত হয়। মে মাসে বাংলা ভাষায় প্রথম আমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা 'তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য' প্রকাশিত হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে পাদ্রী জেমস লং সাহেবের ভূমিকা সংবলিত 'বাই এ নেটিভ' ছদ্ম নামে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণ' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। জুলাইতে 'মেঘনাদ বধ' কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড ও 'আত্দবিলাপ' কবিতা এবং ব্রজাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ করেন। ১৮৬২ সালের জানুয়ারি মাসে পৈতৃক সম্পত্তির যথোপযুক্ত বিলি ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহায্য প্রার্থনা এবং সহযোগিতা লাভ করেন। ১৮৬৩ সালে পত্তনির ও প্রতিভূগণের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অর্থ না পেয়ে অর্থ সংকটে নিপতিত হন। অন্যদিকে স্ত্রী হেনরিয়েটার পুত্র-কন্যাসহ কোনো প্রকারে পাথেয় সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। নিদারুণ আর্থিক অনটনে ইংল্যান্ড ছেড়ে প্যারিসে যেতে হয়। সেখানকার ভার্সাই নগরীতে দৈন্যাবস্থায় দিন-যাপন শুরু। ১৮৬৪ সালে ২ জুন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে অর্থ সাহায্য কামনা করে পত্র প্রেরণ করেন। এরপর পুনরায় ইংল্যান্ড আসেন এবং ব্যারিস্টারি শিক্ষা আরম্ভ করেন। ১৮৬৯ সালের মে মাসে স্ত্রী হেনরিয়েটার ও পুত্রকন্যাসহ কলকাতায় আসেন এবং লাইডন স্ট্রিটের প্রশস্ত বসতবাড়িতে রাজকীয় সমারোহে বসবাস শুরু করেন। ১৮৭০ সালের জুন মাসে ব্যারিস্টারি ছেড়ে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিলের আপিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। ১৮৭২ সালে জানুয়ারি মাসে মোকদ্দমার তদারকি উপলক্ষে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৮৭৩ সালের এপ্রিল মাসে মধুসূদন ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখার্জির সাদর আহ্বানে উত্তরপাড়া লাইব্রেরি ভবনের দ্বিতীল-এ বসবাস করতে শুরু করেন। মে মাসে স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটে। স্ত্রী হেনরিয়েটাও নিদারুণ জ্বরে আক্রান্ত হন। জুনের ২৬ তারিখে স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যু হয়। জুনের ২৯ তারিখ রবিবার বেলা ২টায় পুত্র-কন্যা, জামাতা, বন্ধুজনের উপস্থিতিতে মধুসূদন দত্ত পরলোক গমন করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাহিত্যিক জীবনে স্বদেশে খ্যাতি ও যশ লাভ করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। দুর্বার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অপরিতৃপ্ত বাসনা তার শৈল্পিকসত্তাকে স্বদেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। যে আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাসে তিনি বিলেত যাত্রা করেন, অচিরেই তা ভঙ্গ হয়। এই দুর্দিনেও তিনি সৃষ্টিবিমুখ ছিলেন না।

রকমারি ডেস্ক

 

সর্বশেষ খবর