শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রণীত 'ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার' লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদসংখ্যা ২০১৫-তে ছাপা হয়। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি পুনঃমুদ্রিত হলো।

যে-সব দেশ এক সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল, সেখান থেকে ঔপনিবেশিক কর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পাততাড়ি গোটালেও স্থানীয় পর্যায়ে উত্তরাধিকার ও উত্তরাধিকারীরা থেকে যায়। উত্তরাধিকারটা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের; উত্তরাধিকারীরা হচ্ছে রাষ্ট্রের স্থানীয় শাসক। উত্তরাধিকারের এই তৎপরতাটা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চালু থাকে, বাংলাদেশে যেমনটা রয়েছে। আগামীতেও থাকবে, যদি না মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের দাপট রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রকট। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেল, আমরা ভাবলাম আপদটা নেমে গেছে ঘাড়ের ওপর থেকে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া গেল যে গেছে বটে, তবু যায়নি। তাদের গড়া রাষ্ট্রব্যবস্থাটা ঠিকই রয়ে গেছে। পাকিস্তান নামের যে নতুন রাষ্ট্রটি আমরা পেলাম সেটি আয়তনে ছোট অবশ্যই, নামেও আনকোরা নতুন, কিন্তু চরিত্রে মোটেই পৃথক নয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে রাষ্ট্র ছিল পুরোপুরি ঔপনিবেশিক, পাকিস্তান স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় শাসনটা দাঁড়াল ছদ্ম ঔপনিবেশিক। তাকে নব্য-ঔপনিবেশিক বলাটা অন্যায্য নয়। রাষ্ট্রের ভিতরকার যন্ত্রপাতি, তার বিভিন্ন বাহিনী, আইন-কানুন, শাসনপ্রণালি সব কিছুই আগের মতো রয়ে গেল। ব্রিটিশের দ্বারা প্রশিক্ষিত অসামরিক ও সামরিক আমলারা দেখা গেল আগের মতোই কর্তৃত্ব করছে। বিশেষভাবে দুরন্ত হয়ে উঠল সামরিক বাহিনী। ব্রিটিশ রাষ্ট্রের আদত শক্তিটা ছিল ওই সেনাবাহিনীতেই। সেনাবাহিনী রয়ে গেছে এবং থেকে থেকে শাসনক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সব কিছুর অন্তরালে শাসন ও শোষণ সমানে চলল, তবে যন্ত্রপাতিগুলো যেহেতু অতিরিক্ত ব্যবহারের দরুন কিছুটা জীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং নতুন চালকরা যেহেতু আগেরগুলোর মতো দক্ষ ছিল না, তাই শাসিত জনগণের যন্ত্রণা বরঞ্চ বেড়েই গেল। আওয়াজ উঠল জাতি গঠনের ও রাষ্ট্র গঠনের, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যা চলতে থাকল তা হলো শ্রেণি সংহতকরণ।

ব্রিটিশ শাসকরা বিদেশি ছিল। পাকিস্তানি শাসকদের আমরা দেশি মনে করেছিলাম, অনতিবিলম্বেই টের পাওয়া গেল যে, তারা নামেই যা আপন, নইলে ভাষায় তো অবশ্যই আচরণেও বিদেশি ভিন্ন অন্যকিছু নয়। আমরা ঠিক করলাম এদের তাড়াবো এবং ঠিকই তাড়িয়ে দিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র তৈরি হলো। এখন আর দুর্বৃত্ত বিদেশিরা নেই, এখন আমরা এবং আমাদের মামারাই সর্বেসর্বা। তবে মামারা ছিলেন কিছুটা অগ্রসর, তাদের বিত্ত ছিল, হাতে ছিল নানাবিধ অস্ত্র; দেখা গেল অত্যাশ্চর্য দ্রুততায় তারা পরিত্যক্ত গদিগুলো সব দখল করে নিয়েছেন। মামারা শাসক হয়ে গেছেন, একটি শাসক শ্রেণি গড়ে তুলেছেন। দেশের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন এবং বিদেশে পাচারও করে দিচ্ছেন। পাকিস্তানি শাসকদের মতোই তারা নিঃসংকোচে লুণ্ঠন ও অত্যাচার করছেন। এই মামারা দেশেরই সন্তান, কিন্তু তারা ক্রমাগত এবং আমাদের চোখের সামনে বিদেশি হয়ে উঠেছেন। আগের দিনে জমিদাররা ছিল, তারা ছিল সামন্তবাদী; এখানকার শাসকরাও সামন্তবাদী আনুগত্য চায় ঠিকই, কিন্তু তাদের পুঁজিবাদী চোখ নগদ মুনাফা ও স্থায়ী ক্ষমতার দিকে।

আমরা আশা করেছিলাম, স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র পাব। যা পাওয়া গেছে তা হলো বিভিন্ন পোশাকে স্বৈরতন্ত্র। নির্বাচিত সরকার আসে, অনির্বাচিত সরকার তাদের দিয়ে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়, আবার দেখি নির্বাচিতরা এসে গেছে, কিন্তু এদের কারোরই বিন্দুমাত্র দায় থাকে না জবাবদিহিতার। ব্রিটিশের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রটি ছিল নির্ভুলরূপে আমলাতান্ত্রিক, বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রটিও তা-ই। আমলাতন্ত্র জবাবদিহিতার ধার ধারে না, আমাদের রাজনৈতিক শাসকরাও একই রকমের, তারা যা ইচ্ছা তাই করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের ভিতর দিয়ে। একাত্তরে এটা অকল্পনীয় ছিল যে, এই রাষ্ট্রে আবার সামরিক শাসন আসবে। অথচ সেটাই ঘটেছে। একবার নয়, বার বার। পাকিস্তানে যেমন বাংলাদেশেও তেমনি সামরিক বাহিনীকে ক্রমাগত শক্তিশালী করা হয়েছে, সংখ্যা সুযোগ-সুবিধা ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা অতি দ্রুতগতিতে বেড়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা চলেছে। ব্রিটিশ আমলে ব্যবস্থাটা এমন ছিল যে লোকে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হওয়ার তুলনায় সরকারি অফিসের পিওন হওয়া ঢের বেশি পছন্দ করত। অত্যন্ত কঠিন মূল্য দিয়ে দুই দুইবার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও সম্মানের সেই কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে এমনটা বলার কোনো উপায় নেই।

নাগরিকদের জান ও মালের নিরাপত্তাদানের দায়িত্ব কী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কী পাকিস্তানি নব্য-ঔপনিবেশিক কোনো সরকারই নেয়নি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারেরাও নিচ্ছে না। যে সব অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে বাস্তবে তাদের কোনো কার্যকারিতা দেখতে পাই না। বরঞ্চ সত্য থাকে এটাই যে, রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি মাত্রায় নিপীড়নকারী হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা আগে শুনিনি, এখন তা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক। রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলার যে অভ্যাস ব্রিটিশ শাসকদের মজ্জাগত ছিল, পাকিস্তানি দুঃশাসনের চড়াই-উতরাই পার হয়ে এসে বাংলাদেশের শাসকরা তা থেকে মুক্তি পায়নি। অভ্যাসটি ব্যবস্থার প্রয়োজনে ও প্রশ্রয়েই তৈরি হয়েছিল। ব্যবস্থাটি নিত্যই নতুনভাবে প্রমাণ দিচ্ছে যে সে বদলায়নি।

আর আছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। ব্যবহারের এই কাজটা ইংরেজরা সরাসরি করেনি, তবে আড়াল থেকে উৎসাহ দান তৎপরতায় বিরাম দেয়নি। লোকজনকে ধরে ধরে খ্রিস্টান বানানোর ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল না ঠিকই, কিন্তু লোকজন হিন্দু মুসলমানে ভাগাভাগি হয়ে যাক এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতাকে ভুলে গিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহে লিপ্ত হোক, দাঙ্গা বাধাক, গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাক, এটা তারা খুবই চেয়েছে। বিভক্ত কর এবং শাসন কর- সাম্রাজ্যবাদী শাসনের এই শেয়ানা কৌশলকে তারা হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করা এবং পরস্পরের ঘোরতর শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মহোৎসাহে কাজে লাগিয়েছে।

এই বিভক্ত করাটা তাদের দিক থেকে খুবই জরুরি ছিল। নইলে জাহাজে চেপে সাতসাগরের ওপার থেকে ভেসে এসে অল্প কিছু মানুষ আয়তনে বিশাল ও জনসংখ্যায় বিপুল এই উপমহাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখল কী করে? অতদিন ধরে? ধর্মকে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার শান্ত সীমা থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সৃষ্টিতে ব্যবহার করে তারা সুফলও পেয়েছে বৈকি, নগদানগদি।

[ চলবে ]

 

সর্বশেষ খবর