রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিস্ময়কর আকাশ গুহা

বিস্ময়কর আকাশ গুহা

নেপাল সীমান্ত। ভয়ঙ্কর স্রোতের নদী, উঁচু উঁচু পাহাড়ের আড়ালে ছিল মুসট্যাংগ রাজ্য। যেখানে সাধারণ মানুষের চলাচলই দুরূহ সেখানে পাহাড়ের বুকে গুহার সন্ধান। মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যায় এই গুহাগুলো। নিচে দাঁড়িয়ে মনে হবে, মানুষ বুঝি আকাশের গুহায় হারিয়ে গেল। আকাশ গুহায় মিলল মানুষ ও পশুর কঙ্কাল, মমি, মূল্যবান তৈজসপত্র, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এরা কারা, কেন এসেছিল মেঘের ওপরে এই আকাশ গুহায়? উত্তর খুঁজছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের কৌতূহলী দল। লিখেছেন- তানভীর আহমেদ

মাটিতে দাঁড়িয়ে খালি চোখে মেঘের উড়াউড়ি দেখা যায়। মেঘের উপরে আকাশ। আকাশের বিস্তৃতি অসীম। সেখানে বহু অমীমাংসীত রহস্য রয়েছে। মানুষ কৌতূহলী। অমীমাংসিত রহস্যগুলো তাই মানুষকে আকৃষ্ট করে। তেমনই এক রহস্য স্কাইকেভ বা আকাশ গুহা। অনেকেই ভাবতে পারেন, আকাশের বুকে গুহা আবার কী করে সম্ভব। আকাশের বুকে নয় এই গুহা। রহস্যময় এই গুহাগুলো মূলত উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত। এতটাই উঁচুতে যে, নিচে দাঁড়িয়ে তাকালে মনে হবে মেঘের উপরে লুকানো আকাশে ভেসে বেড়ানো গুহা এগুলো! এ জন্যই বছরের পর বছর মানুষ এই আকাশ গুহা নিয়ে বিস্ময়ে হতবাক। আকাশ গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে সেটা খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। যদিও এই গুহাগুলোর বয়স হাজার হাজার বছর কিন্তু এগুলো মানুষের অজানাই থেকেছে এতকাল। আকাশ গুহার খোঁজ পাওয়া যায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। একজন পর্বতারোহী এই গুহার খোঁজ পান। তারপর দলে দলে মানুষ সেখানে ছুটে গেছে। বাদ ছিল না বিশেষজ্ঞরাও। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল এ নিয়ে এক্সক্লুসিভ ভিডিও অনুষ্ঠান প্রচারের পর সাধারণ মানুষের আগ্রহ আকাশ ছুঁয়ে যায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনেও আকাশ গুহা নিয়ে ফিচার-আর্টিকেল ছাপা হয়। তারপর থেকে আকাশ গুহা নিয়ে নানা আলোচনা হয়ে আসছে। আকাশ গুহা নিয়ে বহু উত্তর না জানা প্রশ্নেরও কোনো মীমাংসা হয়নি।

আকাশ গুহা কোথায়? যারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তাদের জন্যই বলা- উত্তর মধ্য নেপালের তীব্বত এবং চীন সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে এটি। সে প্রাচীন আমলের কথা। এই অঞ্চলটায় একসময় মানুষের বসতি ছিল। এই রাজ্যের নাম ছিল মুসট্যাংগ। মুসট্যাংগ রাজ্য নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর মিথ চালু রয়েছে। এসব মিথের মধ্যে কয়েকটি রীতিমতো আপনাকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেবে। তেমনই একটি মিথ হলো মুসট্যাংগ রাজ্য সাধারণ মানুষের চোখে অদৃশ্য থাকত। তার মানে এখানে বাইরের রাজ্যের কোনো মানুষ এলে কিছুই দেখতে পেত না। যদিও এসব মিথের কোনো ভিত্তি নেই, তবুও মানুষ কিন্তু মিথ ধরেই এগিয়েছে। মুসট্যাংগে যাতায়াতের সহজ কোনো রাস্তা নেই। আর জায়গাটি এত বড় বড় পাহাড়ের আড়ালে রয়েছে যে, একেবারে পাহাড়ের সারির ভিতরে না ঢুকলে এই অঞ্চলটি চোখে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। হিমালয় পর্বত এবং গ্রান্ড ক্যানিয়নের মতো গভীর, পাহাড়ি গিরিখাত অঞ্চলটি ভয়ঙ্কর সুন্দর করেছে। এরই মাঝবরাবর বয়ে চলেছে কালী গান্দাকি নদী। সবমিলিয়ে প্রকৃতি এই স্থানটিকে পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রেখেছে ভাবলে ভুল হবে না। এছাড়া মুসট্যাংগের আরেকটি বিশেষ দিক হলো এখানকার আবহাওয়া। এত দ্রুত এখানকার আবহাওয়া পাল্টায় যে, তা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ছাড়বে। কয়েক ঘণ্টা পরের আবহাওয়া অনুমান করাও এখানে দুষ্কর। এখানে যে কোনো মুহূর্তে কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস এবং ধূলিঝড়। এই ধূলিঝড়ের কারণে মুসট্যাংগের দিকে কোনো মানুষ এবং পর্যটক যেতে চাইত না। কিন্তু রহস্য বিজয়ের নেশা মানুষের ছাড়ে না। সে কারণেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি কিছু বিজ্ঞানী এবং প্রত্নতত্ত্বববিদ এই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পাহাড়ি ঢালে প্রায় হাজার দশেক মানব সৃষ্ট গুহার সন্ধান পান। এই গুহাগুলো পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে মিশে রয়েছে যে, খুব সহজে কারও চোখে পড়বে না। আর গুহাগুলো এতটাই উঁচুতে যে, একটু পরপরই মেঘ এসে এগুলোকে ঢেকে দিয়ে যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে পৌঁছানো প্রায় দুঃসাধ্য বলা যায়। কেউ যদি এতটা উঁচুতে উঠে গুহার ভিতরে ঢুকে পড়ে তবে নিচে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে মনে হবে মেঘের উপরে কোনো গুহায় লোকটি হারিয়ে গেল। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখেই মানুষ এই গুহাগুলোকে আকাশ গুহা বলে নাম দিয়েছে। এই গুহাগুলোর ভিতরে পৌঁছানোর লোভ প্রত্নতাত্তি্বকরা ছাড়তে পারেননি। তারা বহু কষ্টে এই গুহাগুলোতে প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে ওঠেন। কারণ এর ভিতরে অনেক প্রাচীন বৌদ্ধ সাধুদের মৃতদেহ, নারী শিশুদের মমি, মূল্যবান তৈজসপত্র, পশুর কঙ্কাল এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। দুই হাজার বছর আগের বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিছু কঙ্কাল এবং প্রাকৃতিকভাবে মমি হয়ে যাওয়া কিছু লাশ সেখানে ছড়ানো ছিল। এই মমিগুলোর প্রায় সবগুলোই সুন্দর তামার গহনা আচ্ছাদিত কাঠের বাক্সে রাখা। গুহায় এমন সব তৈজসপত্র, গহনা এবং কাচের পণ্য পাওয়া গেছে যা তৎকালীন সময়ে মুসট্যাংগে প্রাপ্ত পণ্যের মধ্যে পড়ে না। দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান এসব গহনা ও অন্যান্য পণ্যের প্রাচুর্য দেখে বুঝা যায় একটা সময় কতটা সমৃদ্ধশালী ছিল এই নগরী। পরবর্তী সময়ে তারা ওই মৃতদেহগুলো পুনরায় পরীক্ষা করেন এবং নিশ্চিত হন যে, ধারালো ছুরি দিয়ে মৃত্যুর পরই ওই ব্যক্তিদের শরীর ফালি ফালি করে কাটা হয়েছে এবং তারপর হাত পা কেটে তাদের বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওই বাক্সে যে মুখোশ পাওয়া গেছে সেগুলো ছিল মৃত্যু-মুখোশ। তাছাড়া পাওয়া যায় পাণ্ডুলিপি। তাদের পাণ্ডুলিপিগুলো লিখে রাখার পদ্ধতি বেশ রহস্যজনক। পাহাড়ের অভ্যন্তরে গুহাগুলো অনেকটা যেন সুড়ঙ্গের মতো। অনেক গুহা এসে একটা বড় হলরুমে মিলিত হয়েছে। এই গুহার গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বুঝতে বাকি থাকে না এখানে মানুষের বসবাস ছিল। তবু একজন দুজন নয়, একটি ছোট সমাজ ছিল এখানে। এত উঁচুতে যেখানে মানুুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, পানি কিছুই সহজলভ্য নয়, সেখানে এই মানুষগুলো কেন বসবাস করছিল এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তারা খুঁজে পাননি। তাছাড়া এই গুহাগুলোর সবই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, সেটা মেনে নিতেও নারাজ অনেকে। কারা এই গুহা খনন করেছে বা ঠিক কি উদ্দেশ্যে খুঁড়েছে এসব নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য জানা যায়নি। এমন কি এই গুহাগুলোতে প্রবেশের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু গুহা পাহাড়ের এমন সব স্থানে তৈরি করা হয়েছে যেখানে যাওয়া অসম্ভব বলা যায়। সেসব গুহায় পায়ে হেঁটে যাওয়া তো দূরের কথা, বেয়ে ওঠার কোনো রাস্তা নেই। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে সেখানে উঠতে হলে পাখি হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এই আকাশ গুহাগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রত্নতাত্তি্বক রহস্যের অন্যতম। পরে এই অঞ্চলের ইতিহাস ঘাঁটেন ইতিহাসবিদরা। মুসট্যাংগ ছিল এক ব্যস্ত জনপদ। এখানে একসময় বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা, দর্শন, চিত্রকলার চর্চা ছিল। এই অঞ্চলটি লবণ ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলে মনে করেন অনেকে। এখানের লবণ খাঁটি ও দামি একটি ব্যবসায়িক পণ্য। নৃতত্ত্ববিদ চার্লস র‌্যাম্ব্বল দাবি করেন, মুসট্যাংগ ছিল তিব্বতের লবণ খনিগুলোর সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের যাতায়াতের সহজ পথগুলোর একটি। বলা হয়ে থাকে এই বিপজ্জনক পাহাড়ি অঞ্চল দিয়েই লবণ এবং অন্যান্য দামি পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করত। সম্ভবত সতেরশ শতকের শুরুর দিকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো মুসট্যাংগের এই একচেটিয়া উত্থানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানারকম কূটপরিকল্পনা শুরু করে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা মুসট্যাংগের ওপর বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে মুসট্যাংগের বিখ্যাত ধর্মীয় মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে এই অঞ্চলের বিপর্যয়ের আরও দুটি কারণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। এক ধর্মান্তরিত হয়ে একদল মানুষ এখানে এসে জীবনযাপন শুরু করে দিয়েছিলেন। এছাড়া বলা হয়ে থাকে মুসট্যাংগে কোনো মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়ে যা থেকে বাঁচতে এই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাহাড়ের গুহায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে এসবের কোনোটিরই সঠিক ভিত্তি নেই। সবই ইতিহাস থেকে ধারণাপ্রসূত নয়তো প্রত্নতাত্তি্বকদের বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে সম্ভাবনার আলোকে বলা হয়ে থাকে। তবে যে কারণেই হোক এই বিখ্যাত জনপদটি একসময় হারিয়ে যায়। রহস্যময় সুউচ্চ হিমালয় পর্বতের আড়ালে পরে থাকে আকাশ সমান উঁচুতে এক রহস্য।

 

সর্বশেষ খবর