শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রণীত 'ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার' লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদসংখ্যা-২০১৫ তে ছাপা হয়। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি পুনঃমুদ্রিত হলো।

জয় বাংলা ও বিত্তবান হোক না কেন, মুসলমান পরিচয়ে কলকাতা শহরে বাসা ভাড়া পাওয়াটা যুদ্ধের সময়েও খুব সহজ ছিল না। মুজিব বাহিনীর স্বনামধন্য চার সংগঠক কলকাতাতে হিন্দু নাম ধারণ করেই উপস্থিত হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারগুলো বিবিধ হতে পারে কিন্তু অনিবার্য বৈকি। একাত্তরে ভারত সরকারকেও উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছিল। কেবল যে এক কোটি শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হয়েছে বলে তা নয়, শরণার্থীদের ভিতর শতকরা ৮০ জনই যে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সে-কারণেও। পূর্ববঙ্গে হিন্দু নিধন চলছে, সেখানে হিন্দুরা আর ফিরতে পারবে না, থাকতেও পারবে না, এই ধারণা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বোধকে উসকানি দেবে, এটা অস্বাভাবিক ছিল না। উসকানি দিচ্ছিলও। কোথাও কোথাও দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ওদিকে আবার ভারতে তখন সাত কোটি মুসলমানের বসবাস, তাদের অধিকাংশের কাছেই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়াটা পছন্দের ঠেকেনি। উত্তেজনাটা এদের মধ্যেও ছিল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সদস্যরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে তাদের সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার বিধি চালু হয়েছে। আগে ছিল শত্রু সম্পত্তি, এখন হলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ওইটুকুই যা তফাৎ। নামেরই। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিন্দু সম্পত্তি দখলের চেষ্টা যে কমেছে তা বলা যাবে না। একাত্তরের পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতে হয়েছে, বাংলাদেশেও হয়েছে। ভারতে বিপুল উত্থান ঘটেছে বিজেপির; বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কংগ্রেসের বিরোধিতাটা ছিল উগ্র, কমিউনিস্ট পার্টি এ ব্যাপারে নরম ছিল, তারা মৃদু সমর্থন পর্যন্ত জানিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল কংগ্রেস নিষিদ্ধ হয়নি, তাদের নেতারা একজনও গ্রেফতার হননি; নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের নেতারা হয় আত্দগোপনে গেছেন, নয়তো গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ কেউ চলে গেছেন দেশ ছেড়ে, কয়েকজন নিহত হয়েছেন জেলের ভিতরেই, অনশনরত অবস্থায়। ভারতেও একই ঘটনা; সেখানেও অতিপরিচিত শত্রু মুসলিম লীগ কখনোই নিষিদ্ধ হয়নি, মাঝে মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি, জেল খেটেছেন পার্টির নেতারা।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের অভ্যাসটা পাকিস্তান আমলে কেটে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না, কেটে যায়ওনি, উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, সেখানে দাঙ্গা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র কমিউনিস্টদেরই নিকৃষ্টতম শত্রুজ্ঞানে সম্মানিত করা অব্যাহত রেখেছে। তাদের নাস্তিক বলে চিহ্নিত করে সরল ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে শয়তানের অনুচর হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। একেবারে যে ব্যর্থ হয়েছে তাও নয়।

ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল এককেন্দ্রিক এবং দূরের প্রভুদের দ্বারা শাসিত। স্থানীয় শাসকরা ছিল সরকারি আমলা। আদতে প্রভুরা থাকত বিলেতে। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্র এককেন্দ্রিকই রইল। পূর্ববঙ্গের বেলায় স্থানীয় শাসকরা ছিল আমলা, গোমস্তা; প্রভুরা থাকত করাচিতে, নয়তো রাওয়ালপিন্ডিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রটি আগের দুটির তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু একই রকমের এককেন্দ্রিক। কেবল এককেন্দ্রিক নয়, ক্ষমতার চাবিকাঠি এই রাষ্ট্রেও রয়ে গেছে একব্যক্তির হাতে; তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, সামরিক, আধা-সামরিক ব্যবস্থায় তিনি রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রের দৃশ্যমান শাসকরা স্থানীয়, কিন্তু তাদের অদৃশ্য মুরব্বিরা থাকে বিদেশে, বিশেষভাবে ওয়াশিংটন ও দিল্লিতে। স্থানীয় শাসকরা বিদেশি মুরব্বিদের রাগ-অনুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ব্রিটিশ শাসকদের রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কংগ্রেস ও লীগ ছিল প্রধান প্রতিপক্ষ, কিন্তু তাদের চেয়েও বিপজ্জনক ছিল কমিউনিস্টরা। সংক্ষেপে বলতে গেলে কংগ্রেস-লীগ ছিল শাসকদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কমিউনিস্টরা ছিল শাসকদের শত্রু। ওদিকে বিবদমান কংগ্রেস ও লীগ উভয়ের চোখেই কমিউনিস্টরা ছিল জাতশত্রু। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, দেশপ্রেমিক কংগ্রেস এবং লীগ, পুঁজিবাদী এই তিন পক্ষই একমত ছিল এই জরুরি প্রশ্নে যে, আর যাই করা হোক না কেন সমাজ কাঠামোতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যাবে না, পরিবর্তন বরঞ্চ ঠেকাতে হবে। অপরদিকে কমিউনিস্টরা তো ছিল সমাজ বিপ্লবের স্বঘোষিত কর্মীবাহিনী। দুই পক্ষের শত্রুতাটা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র বদলেছে, প্রথমে হয়েছে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ হয়েছে, কিন্তু সমাজ বিপ্লব-বিরোধিতার রাজনীতি মোটেই ক্ষান্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয় কর্তারা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে কেবল যে বহন করে চলেছেন তাই নয়, নিজেদের প্রয়োজনে তাকে আরও শক্তিশালী ও ব্যবহার উপযোগী করে তুলেছেন।

স্মরণীয় যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অত দ্রুত শেষ হতো না যদি না কুশীলবদের মনে এমন শঙ্কা থাকত যে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে চরমপন্থিরা (অর্থাৎ কমিউনিস্টরা) মূল শক্তি হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে নতুন একটি ভিয়েতনামেরই জন্ম দিয়ে ফেলবে। যুদ্ধ শুরুর আগেই শেখ মুজিবুর রহমান পুঁজিবাদী বিশ্বকে এই মর্মে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তারা যেন বুঝতে ভুল না করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তিনিই শেষ রক্ষাপ্রাচীর। তার পতন ঘটলে বিপদ আছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব যে সেটা জানত না, তা নয়, কিন্তু তাদের ধারণা হয়েছিল যে, বামভাবাপন্ন তরুণরা মুজিবকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে যে, শেষ পর্যন্ত তাদের তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। সে জন্য শেষ মুহূর্তে তার প্রতি সমর্থন তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

আপসপন্থিদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ যখন কোনোমতে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্রের জন্য তখন শত্রু কারা? শত্রু হওয়ার কথা হানাদারদের চিহ্নিত দোসর আল-বদর-রাজাকাররাই। কিন্তু তারা শত্রু বলে বিবেচিত হলো না, বরঞ্চ কিছুটা ধীরে ধীরে হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে গেল। শত্রু হয়ে দাঁড়ালো সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসীরা (অর্থাৎ কমিউনিস্টরা)। তবে এরা তখন দুই ভাগে বিভক্ত, নরমপন্থি ও চরমপন্থি। নরমপন্থিরা ভারতে গেছে, তারা যুদ্ধ তৎপরতায় শামিল হতে চেয়েছে, কিন্তু ভারত সরকার কমিউনিস্টদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি, এমনকি তাদেরও নয় যারা নরমপন্থি। [চলবে]

 

সর্বশেষ খবর