শিরোনাম
শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

এ বি এম মূসার \\\'মুজিব ভাই\\\'

রোবায়েত ফেরদৌস

এ বি এম মূসার \\\'মুজিব ভাই\\\'

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে সবাই তাঁর শোকাবহ স্মৃতি নিয়ে কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। সে পথে না গিয়ে আমি বরং বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখেছেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের অগ্রসর পাঠকের কাছে সেটা তুলে ধরি। এ বি এম মূসা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে দারুণ বইটি লিখেছেন, তার নাম, 'মুজিব ভাই'। বইটি দারুণ। বইয়ের ভূমিকা আরও দারুণ। বইটির ভূমিকা লিখেছেন মূসা ভাইয়ের বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। মুজিব ভাই - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বর্ষীয়ান সাংবাদিক এ বি এম মূসার অনন্য সাধারণ এক বই। প্রায় দুই দশক ধরে বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে প্রকাশিত এগারটি প্রবন্ধের সংকলন এটি। একশ পৃষ্ঠার ছোট্ট-গভীর-মিষ্টি এক বই!

বইটি সম্পর্কে গাফ্ফার চৌধুরীর যথার্থ মন্তব্য: "মুজিব ভাই বইটি আমি এক নিঃশ্বাসে পড়েছি। মনে হয়েছে, বইটি পড়ার সময় লেখক বন্ধুবর মূসার চেয়েও বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্য পেয়েছি বেশি। তরুণ প্রজন্মের যেসব পাঠক বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে দেখার সুযোগ পাননি, তাঁরাও বইটি পাঠের সময় বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্য অনুভব করবেন। ছোট চৌবাচ্চার পানিতে যেমন সূর্যের মতো বিরাট গ্রহের প্রতিবিম্ব ধরে রাখা যায়, তেমনি এ বি এম মূসার মুজিব ভাই নামের ছোট বইটিতে এক মহানায়কের বিশাল চরিত্রকেও তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।"

বইয়ের ফ্ল্যাপ মূলত বইয়ের বিজ্ঞাপন, কাটতি বাড়াতে বাড়তি কথার ঠাটবুনোন; কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, মুজিব ভাই বইটি যেন এর সরাসরি ব্যতিক্রম; ফ্ল্যাপের লিখা সত্যিকার অর্থেই বইটির প্রাণভোমরাকে এক টানে অাঁকতে সক্ষম হয়েছে : একেবারে ঘরোয়া আটপৌরে ভাষায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানা দিক এই বইয়ে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, এক কথায় যাকে বলা যায়, অতুলনীয়। একজন মানুষ যখন সাধারণ থেকে অসাধারণ বা সবিশেষ হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহত্তম ব্যক্তিত্ব, তখন তাঁর ঘরোয়া জীবন আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। লেখক এ বি এম মূসা তাঁর টগবগে যুবা বয়স থেকে শেখ মুজিবকে দেখেছেন। কালক্রমে তাঁর 'মুজিব ভাই'য়ের নিবিড় সানি্নধ্যে এসেছেন। ফলে তাঁর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর ঘরোয়া জীবনের এমন সব দিক এই বইয়ে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে, যা এত দিন আমাদের জানার বাইরে ছিল। আর শুধূ বঙ্গবন্ধু কেন, তাঁর জীবনের সর্বাত্দক প্রেরণাদাত্রী সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেসা এবং তাঁর তিন পুত্রের কথাও মূসা তাঁর অনন্য সাধারণ মুন্সিয়ানায় এমনভাবে তুলে ধরেছেন, পাঠককে যা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে।

বিশেষ কীভাবে হয়ে ওঠে নির্বিশেষ? 'ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা' কেমন করে 'সবার অভিজ্ঞতা' হয়ে ওঠে? - এ বই তার বড় প্রমাণ। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক বইকে মূসা তাঁর মুন্সিয়ানা আর তীক্ষ্ন লেখক সত্তা দিয়ে এমনভাবে 'ফাইন টিউনড' করেছেন তা নিছক বঙ্গবন্ধুর ঘরোয়া জীবনের কথায় আটকে থাকেনি, হয়ে উঠেছে একটি নির্দিষ্টকাল পরিসরে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অমূল্য দলিল।

একটি লেখার শিরোনাম 'রঙ্গরসে বঙ্গবন্ধু' - এখানে বঙ্গবন্ধুর 'সেন্স অব হিউমার'র অসাধারণ কিছু নমুনা তুলে ধরেছেন লেখক; সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানি এসেছে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য। তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন প্রধানমন্ত্রী, খনিজ সম্পদমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন; বৈঠক শেষে বিকালে গণভবনের বারান্দায় খোশগল্পের নিয়মিত আসরে বঙ্গবন্ধু মজা করছেন এই বলে যে, 'বিদেশি কোম্পানিদের বলেছি, শুধু গ্যাস নয়, আমার দেশে তেলও আছে। তেল পেতে হলে একটি দেশের দুটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। এক. মুসলিম দেশ হতে হয় আর দুই. ইট মাস্ট বি হেডেড বাই শেখ- রাষ্ট্রপ্রধানকে শেখ হতে হয়। আমার দেশে দুটিই আছে!' এ বি এম মূসা লিখেছেন, 'কথাগুলো বলে দিলখোলা বঙ্গবন্ধু হো-হো করে হেসে উঠলেন।'

ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে লেখক যেভাবে চিত্রিত করেছেন এক কথায় তা বিস্ময়কর! ফজিলাতুন্নেসা কখনো 'ফার্স্ট লেডি' হতে চাননি; কারণ, সুদূর গ্রাম থেকে যে গ্রাম্য কিশোরীর ছাপটি মুখে নিয়ে স্বামীর হাত ধরে শহরে এসেছিলেন, সেটি কোনো দিন তিনি মুছতে দেননি; ৩২ নম্বর বাড়ির দোতলায় বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন, মুখে পান, হাতের ওপরে চুন - এই ছিল মুজিব-গিনি্নর ঘরোয়া রূপ। ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলে বঙ্গবন্ধু খোশামোদ করে জীবনে প্রথম বেগম মুজিবকে বাইরে, মানে ইন্দিরার সঙ্গে মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন। মূসা লিখেছেন, বেগম মুজিব এক হাতে কাতান শাড়ি সামলাচ্ছেন, অন্য হাতে পানের বাটা ধরে আছেন। বঙ্গবন্ধু মৃদুস্বরে ধমকে উঠলেন, 'ওটা আবার নিয়ে আসলা ক্যান?'

১৯৬৯ সাল। গণঅভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। প্রস্তাব দিলেন শেখ সাহেবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগ দেওয়ার। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে তখন রোজ রাতে লাখো মানুষের ঢল নামছে আর তিনি কি-না মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাবেন? এ নিয়ে দেশের মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত। মূসা লিখেছেন, মুচলেকা নাকি নিঃশর্ত মুক্তি- এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না, কিন্তু নিজের স্বামীকে বুঝতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দী স্বামীকে খবর পাঠালেন, 'হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন; কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।' কে আছেন পাঠক এটা পড়ে যার চোখে জল আসবে না? মূসা দাবি করেছেন, কস্তরবা যেমন গান্ধীর সঙ্গে চরকা কেটেছেন, জেলে গিয়েছেন, নেহরুর কারাসঙ্গিনী যেমন কমলা, দেশবন্ধুর সহধর্মিণী যেমন বাসন্তী দেবী তেমনি ইতিহাসে ফজিলাতুন্নেসার নামও উচ্চারিত হওয়া উচিত। জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি যে নারীর জীবন থেকে বারবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, স্বামীর জন্য তাঁর ত্যাগের কথা মানুষ হয়তো একসময় ঠিকই জানবে।

সাংবাদিকতার সঙ্গে রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পেশাগত সম্পর্ক তৈরি হয়- এটা সবারই জানা; কিন্তু পেশাগত সম্পর্কের ছোট্ট বৃত্তের বাইরে বঙ্গদেশের সাংবাদিকতার তিন পথিকৃত- ফয়েজ আহমদ, এ বি এম মূসা আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার কিছু চমকপ্রদ কথকতা আছে বইটিতে; বঙ্গবন্ধু আদর করে এই তিন সাংবাদিকের নাম দিয়েছিলেন - আপদ, বিপদ, মুসিবত; ফয়েজ আহমদ 'আপদ', এ বি এম মূসা 'বিপদ' আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু ডাকতেন 'মুসিবত' বলে। এ রকম মজার মজার তথ্য আছে বইটিতে কিন্তু আর বেশি বলা যাবে না, তাতে বইটি কেউ আর কিনে পড়বেন না; কিন্তু আমি বইটির গ্রন্থালোচনা করছি এই উদ্দেশ্যে যেন সবাই বইটি পড়েন।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সর্বশেষ খবর