বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পানির নিচে বিস্ময়কর জাদুঘর

রণক ইকরাম

পানির নিচে বিস্ময়কর জাদুঘর

একবার ভাবুন তো পানির নিচে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগৎ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার নিচে। নীল পানির মায়াবী ভুবন। ৪০০ জন মানুষ সেই নীল পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। পানির নিচের এই জাদুঘরটির অবস্থান মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্রসৈকতের কাছে। জাদুঘরের নাম ‘কানকুন মেরিন পার্ক’। এখানে রয়েছে ৪০০টি ভাস্কর্যে নানা মানুষের প্রতিমূর্তি। সাগরের পানির নিচে নানা ভঙ্গিমায় প্রতিস্থাপিত ভাস্কর্যগুলো যেন চলমান জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আরও জানাচ্ছেন- রণক ইকরাম

 

পানির নিচে এ এক অদ্ভুত জগৎ। যেখানে ৪০০ মানুষের প্রতিকৃতি রয়েছে নানা ভঙ্গিমায়। হাতে হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক দল নারী কিংবা চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা টাইপ মেশিনে মনোযোগ দিয়ে টাইপ করে চলেছেন কেউ। কেউ একজন সাইকেল চালাচ্ছেন। আবার কোনো একজন বৃদ্ধ হয়তো মুখ কালো করে বসে আছেন। একটি শিশু হয়তো মাথা তুলে তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। কোনো কোনো মূর্তি আবার নগ্ন। আছে সন্তানসম্ভবা নারীর মূর্তিও। এক নারী শুয়ে আছেন কাত হয়ে। মাছের জন্য তো বটেই, মানুষের কাছেও এটা এক আজব জগৎ। সাগরতলের হাজার হাজার রঙিন মাছ বুঝতে পারে না এরা আদৌ সত্যিকারের মানুষ কিনা। এ যেন সত্যিই স্বপ্নলোকের গল্পের মতো। কিন্তু বাস্তবে সত্য। এটি আসলে একটি অভিনব জাদুঘর। পানির নিচের এই জাদুঘরটির অবস্থান মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্রসৈকতের কাছে। জাদুঘরের নাম ‘কানকুন মেরিন পার্ক’। এখানে রয়েছে ৪০০টি ভাস্কর্যে নানা মানুষের প্রতিমূর্তি। সাগরের পানির নিচে নানা ভঙ্গিমায় প্রতিস্থাপিত ভাস্কর্যগুলো যেন চলমান জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কানকুনের ইসলা মুজেরেস ন্যাশনাল মেরিন পার্কে সারা বছরই মানুষের ঢল লেগে থাকে। আর এর ফলে উপক‚লে প্রাকৃতিকভাবে যে প্রবাল-প্রাচীর গড়ে ওঠে, তা ব্যাহত হয় ভীষণভাবে। যার কারণে সেখানে জলজপ্রাণীর আগমন কমে গিয়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। মোট কথা, সমুদ্রের নিচের স্বাভাবিক পরিবেশ মেক্সিকোর পশ্চিম উপক‚লে ছিল না বললেই চলে! সে সমস্যা নিরসনেই কাণ্ডারি হিসেবে আবিভর্‚ত হন।

যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ভাস্কর জেসন দ্য ক্লেয়ার্স টেইলর। ৩৭ বছর বয়সী এই মানুষটি বহু দিন ধরেই মেতে আছেন ভাস্কর্য নিয়ে। মেক্সিকোর পশ্চিম উপক‚লের এই সমস্যা নিয়ে অনেক দিন ধরে মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি। টেইলরের চিন্তাভাবনার কথা জেনে মেক্সিকোর ‘দ্য মিউজিও সাব-অ্যাকুয়াটিকো ডি আর্তে’ এক সময় পাশে এসে দাঁড়ায় তার। এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় চিন্তাকে বাস্তব রূপ দেন টেইলর। এ প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছে ‘লাইফ কাস্টস’। শুধু অতিরিক্ত ভ্রমণকারীদের হটানোই যে লাইফ কাস্টস প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য, তা কিন্তু নয়। আশা করা হচ্ছে, বিলুপ্ত হতে চলা প্রবাল-প্রাচীর নতুন করে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে ভাস্কর্যগুলো।

 

পানির তলের অভিনব এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। কানকুন মেরিন পার্ক কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ শিল্পীর শিল্পকর্ম দিয়ে জাদুঘর সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কেননা, আগে থেকেই সমুদ্রের নিচে ইনস্টলেশন করার অভিজ্ঞতা ছিল তার। কানকুন নটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবার্টো ডিয়াজ বলেন, জেসনের শিল্পকর্ম প্রথমে আমি ইন্টারনেটে দেখেছিলাম। সেটা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। নান্দনিক দিক থেকে চিন্তা করলে এটা আসলেই অসাধারণ। অন্যান্য ভাস্কর্যের চেয়ে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে এটা করা হচ্ছে। কেননা, সমুদ্রের পানির উপরে কখন কতটা আলো পড়ছে তার ওপর নির্ভর করে পানির নিচের ভাস্কর্যের রং বদলে যাচ্ছে। আর এর ধরনও পানির উপরের ভাস্কর্যের চেয়ে আলাদা। ব্রিটিশ শিল্পী জেসন টেইলর এই ভাস্কর্যমালার নাম দিয়েছেন ‘দ্য সাইলেন্ট এভোলিউশন’। ভাস্কর্যগুলো তৈরির ক্ষেত্রে টেইলর ব্যবহার করেছেন বিশেষ ধরনের সিমেন্ট। আর এই সিমেন্ট সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ শক্তিশালী। তা ছাড়া এ ধরনের সিমেন্ট প্রশমিত পিএইচ মাত্রার গুণে সেটি দারুণ প্রবালবান্ধব। এতে ভাস্কর্যগুলোতে খুব সহজেই প্রবাল দানা বাঁধতে পারছে এখন। প্রথম দিকে প্রায় দুশ’র মতো ভাস্কর্য স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন টেইলর। কিন্তু কিছুদিন পরই তার ধারণা পাল্টে যায়। তিনি ভাস্কর্য সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি করার চিন্তা করলেন। শেষে ৪০০টি ভাস্কর্যে সেজেছে কানকুন মেরিন পার্ক। প্রশ্ন আসতে পারে, সমুদ্রের নিচে কীভাবে প্রতিস্থাপিত হলো নানা ভঙ্গিমার এত বিপুলসংখ্যক ভাস্কর্য? আসলে বিশেষ এক ধরনের শক্ত ফাইবার গ্লাসের সাহায্যে মূর্তিগুলোকে পানির নিচে দাঁড় করানো হয়েছে। সেটিও তৈরি হয়েছে ভাস্কর্যে ব্যবহৃত উপাদানগুলো দিয়েই। সেগুলো বসানোর জন্য প্রথমে বিশেষ ক্ষমতাধর ড্রিল মেশিন দিয়ে সমুদ্রতল ফুটো করে নেওয়া হয়েছিল। তারপর একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের সৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে মূর্তিগুলোর ভাস্কর টেইলর বলেন, ‘আমরা চেয়েছি এ প্রকল্পটিকে অন্যরকম, খুব উঁচু দরের রোমাঞ্চকর করতে। আর মূল কাজটি করতে গিয়ে আমি চেষ্টা করেছি মানুষ আর পানির নিচের পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ঘটানোর। সেই মিথস্ক্রিয়ায় সবাই যেন একই ছন্দে বাঁধা থাকতে পারে।’ টেইলরের সেই চেষ্টা অবশ্য সফল হতে চলেছে। ভাস্কর্যগুলোর আশপাশে এখন বাহারি রঙের মাছ ও জলজপ্রাণী ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি দানা বাঁধছে প্রবালও! সব মিলিয়ে ভাস্কর্যগুলোর ওজন প্রায় ১২০ টনেরও বেশি। তবে ভাস্কর্যগুলোর বড় শত্র“ সেখানকার আবহাওয়া। প্রায়ই সেখানে হ্যারিকেন ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাণ্ডব চলে! আর এই তাণ্ডবে যে কোনো মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে স্বপ্নের এই জাদুঘরটি। তবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের আশা, ভাস্কর্যগুলো যে কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারবে।

তবে ডুবুরি বা ডাইভারদের জন্য কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা নেই, অবাধে সাঁতার কাটা যাবে। জায়গাটার বিশেষত্ব বোঝাতে গিয়ে ভাস্কর টেইলর বলেন, ‘কানকুনের এই উপকূলে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখের বেশি মানুষ বেড়াতে আসে। কারণ, এখানকার সমুদ্রের নিচে আছে ইসলা মুজেরেস ন্যাশনাল মেরিন পার্ক। পানির নিচের এই পার্কটি দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা দিন দিন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে এখানকার পরিবেশকে। বিশেষ করে, এখানকার প্রাকৃতিক শৈলপ্রাচীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাই এই অতিরিক্ত ভ্রমণকারীদের হটাতে ভাস্কর্যগুলো বসানো হয়েছে এখানে।’ অদ্ভুত সৌন্দর্যমণ্ডিত এই স্থানটি ইতিমধ্যেই ভ্রমণপিয়াসীদের নজর কেড়েছে।

সর্বশেষ খবর