শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

একাত্তরের সেই সাংবাদিকরা

তানভীর আহমেদ

রঘু রায়

রঘু রায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্রেমবন্দী করার দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন তিনি। ছবিগুলোকে এক অসামান্য মহাকাব্য করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সৃষ্টি করতে পারঙ্গম খুব কম ফটোগ্রাফারই। ছবির সিরিজ দিয়ে গল্প তৈরি করার তেমন প্রয়োজন হয়নি রঘু রায়ের। তার একেকটা ছবিই একেকটা গল্প। একটি ছবি যে কত গল্প বলে যায়, যা ছবিতে আছে, যা নেই। রঘু রায়ের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি যেন একেকটা ছোট গল্প। অগণিত লাশের মিছিল আর সম্ভ্রম হারানো লাখো বীরমাতার রক্তাক্ত শরীরের বিনিময় অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। হূদয়ে রক্তক্ষরণ ও অশ্রুজলের ছোঁয়া দিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছবি তুলেছেন ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তরুণ আলোকচিত্রী রঘু রায়। ৫ মাস তিনি ভারত ও তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে ছুটে বেড়িয়েছিলেন এসব ছবির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হারিয়ে যায় ছবিগুলোর নেগেটিভ। বহু বছর পর তিনি খুঁজে পান নেগেটিভগুলো। তার সেই ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ : দ্য প্রাইজ অব ফ্রিডম’ বা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্য’। রঘু রায় দুইটি ভাগে বিভক্ত করেছেন প্রদর্শনীর ছবিগুলোকে ‘শরণার্থী’ ও ‘বিজয়ের পর’। ছবিগুলো প্রসঙ্গে রঘু রায় বলেন, ১৯৭১ সালে আমার বয়স ২৮ বছর। স্টেটসম্যান পত্রিকার কর্তৃপক্ষ মাত্র ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমাকে সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতির ছবি তুলতে পাঠানো হয়। সেখানে আমি মূলত নারী ও শিশুদের ছবি বেশি তুলি। আমি তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে এক সময় পাগলের মতো হয়ে পড়ি। এভাবে কী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।’ তার তোলা আলোচিত একটি ছবি অশ্রুসিক্ত ক্ষুধার্থ এক শিশুর কান্না। ছবিটি প্রসঙ্গে রঘু রায় বলেছিলেন, এই ছবিটি সে সময় আমার ছেলে দেখে। তখন তার বয়স মাত্র তিন। সে অবর্ণনীয় কষ্টের ছবি দুইটি দেখে অশ্রুসজল চোখে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাবা, ওরা কাঁদছে কেন?।’ সে সময় আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। এখন আমি বলতে পারি, ওরা নিজ দেশের স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে কাঁদছিল।

তার তোলা সব ছবিই সাদাকালো। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনের ভিতর এ ধারণা জন্মাতেই পারে সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে চলেছেন আপনি।


 

সায়মন ড্রিং

পর্যাপ্ত ছবি নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’

 

কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।

একাত্তর সালে সাইমন ড্রিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন সাংবাদিক। তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর ৪০ জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। সেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে এলেন সায়মন ড্রিং। ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর। ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলো। চারদিকে মৃত্যুর বিভীষিকা। একসময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশ ত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। ঢাকার বুকে তখন হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের চিহ্ন। কিন্তু পুরো বিশ্ববাসী তখনো অন্ধকারে। পর্যাপ্ত ছবি আর প্রত্যক্ষ ছবিগুলো নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। শেষ পর্যন্ত এ নিধনযজ্ঞের কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সায়মন ড্রিং। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তিনি তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসল পুরো বিশ্ব।


 

মার্ক টালি

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ বিশ্ববাসীর সামনে প্রচারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্ক টালি। একাত্তরের বিবিসি বলতে তত্কালীন সবাই মার্ক টালিকেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর এরিয়াল তুলে শর্টওয়েভ স্টেশনের নব ঘুরিয়ে স্থির হয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে কী বলছেন মার্ক টালি, তা শোনার জন্য উত্কণ্ঠিত থাকত পুরো দেশ। নিত্যদিনের প্রাণবন্ত খবরের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হতেন মার্ক টালি। একদিন বাংলাদেশে স্বাধীন হলো। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া উপহার পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি। এ বিরল উপহারটিকে তিনি তার জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেন।


 

কিশোর পারেখ

কিশোর পারেখ ভারতীয় ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশের মুক্তিদ্ধের যে কজন সফল ক্যামেরাযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সেলুলয়েডবন্দী করেছিলেন তাদের একজন কিশোর পারেখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পারেখ ছিলেন ব্যতিক্রম, যিনি কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন।  ঢাকায় অবস্থানকালীন একজন সিভিলিয়ান হয়ে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই তিনি পাকিস্তান আর্মির পোশাক জোগাড় করে ঐতিহাসিক কাজগুলো সাহসিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। ছবি তুলতে গিয়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তার তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি ‘বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ’ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন।


 

ছবিটির শিরোনাম ‘দ্য বুট অন দ্য রোড’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা । ছবি : কিশোর পারেখ


 

যুদ্ধে লণ্ডভণ্ড সব। মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন ভাগ্যহত এক মা। ছবি : রঘু রায়


 

অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে যুদ্ধরত  মুক্তিবাহিনীর একজন গেরিলা যোদ্ধা। ছবি : কিশোর পারেখ


 

যুদ্ধ চলাকালীন হিউম পাইপে বসবাসরত বাংলাদেশি শরণার্থীদের দুর্দশার জীবন। ছবিটি কাঁদিয়েছে বিশ্ব বিবেককে। ছবি : রঘু রায়

সর্বশেষ খবর