শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভালোবাসার তাজমহল

যে প্রেম তাজমহল গড়েছিল..

রণক ইকরাম

ভালোবাসার তাজমহল

মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রেমকে অমর করে রাখতে যে কীর্তি স্থাপন করেছেন তা যে সত্যিই কালোত্তীর্ণ এ কথা নতুন করে বলার নেই। সেই অনন্য কীর্তি তাজমহল আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম। যদিও তাজমহল তৈরির খরুচে বিলাসিতা, নির্মাণ শ্রমিকদের ভাগ্য আর মমতাজের চৌদ্দতম সন্তান ধারণ শাহজাহানের ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এরপরও তাজমহলের নির্মাণশৈলী মানুষকে মুগ্ধ করে। আজও মানুষ অবাক বিস্ময়ে জানতে চায় এর পেছনের লুকানো সত্য। আগামীকাল বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখেআজকের আয়োজন তাই তাজমহলকে ঘিরেই।

 

ইতিহাস কাঁপিয়ে দেওয়া প্রেম কাহিনী অনেক আছে। কিন্তু এমন প্রেম কাহিনী খুব কমই আছে যার সাক্ষী এখনো পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অমর সৃষ্টি তাজমহলের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে এমন নিদর্শন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ অনন্য কীর্তির পেছনে ছিল একটি প্রেমের গল্প। কিন্তু কী এমন প্রেমের গল্প ছিল যে প্রেম তাজমহল গড়ে দিয়েছিল?

শাহজাহান তখনো শাহজাহান হয়ে ওঠেননি। শাহজাদা খুররম হিসেবেই সবাই তাকে চেনে। বয়স মোটে পনের। আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ-ই তার চোখে পড়ে এক পরমাসুন্দরীকে। শুধু চোখে পড়ে বললে ভুল হবে, তাকে মনে ধরে যায় খুররামের। মেয়েটির নাম আরজুমান্দ বানু বেগম। তারও বয়স পনের। পরে তাদের দুজনের বিয়ে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এই বিয়ের আগেই পারস্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন শাহজাহান। তখনো আরজুমান্দকে ঘরে তোলেননি শাহজাহান। পরে শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে আসেন আরজুমান্দ। এই আরজুমান্দবানুই হলেন শাহজাহানের মমতাজ। তিনি ছিলেন শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয় বেগম। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে মমতাজের মোট ১৪ সন্তান হয়। চতুর্দশ সন্তানের জন্মের সময় মমতাজের মৃত্যু হয় আগ্রা থেকে বহুদূরে, বারহামপুরে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাত দিন সাতরাত শাহজাহান কিছু খাননি। ঘর থেকেও বের হননি। সাত দিন পর শাহজাহান বাইরে বেরোলেন। তখন তার চুলের রং ধূসর হয়ে গেছে, মুখ ফ্যাকাসে। তিনি এমন এক স্মৃতিসৌধ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। সেটাই আজকের তাজমহল।

এই তাজমহল দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ভিড় জমান হাজারো পর্যটক। বর্তমানে তাজমহলে বছরে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসে যার মধ্যে ২ লাখ পর্যটক বিদেশি। এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র।

মজার ব্যাপার হলো শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনী যতটা আলোচিত ততটাই আলোচিত যে, মমতাজ আসলে সম্রাট শাহজাহানের কততম স্ত্রী। কারও মতে মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোথাও বলা হয়েছে তৃতীয় স্ত্রী আবার কোথাও চতুর্থ। আসলে কততম স্ত্রী তা কোথাও সঠিকভাবে বলা নেই। বিতর্ক আছে তাদের প্রেম কাহিনী নিয়েও প্রফেসর পিএন অক ‘তাজমহল : দ্য ট্রু স্টোরি’ তে শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমকাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি দাবি করেন শাহজাহানের ভালোবাসার গল্প মূলত লোকমুখে সৃষ্ট। তিনি দাবি করেন তাজমহল শাহজাহানের সময়ের চেয়েও ৩০০ বছরের পুরনো স্থাপত্য। পরে অবশ্য তার এসব দাবি ধোপে টেকেনি।

সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীতে দেখা যায় শাহজাহান মমতাজকে বাজারে দেখতে পান এবং প্রথম দেখাতেই মমতাজকে পছন্দ করে ফেলেন। কিন্তু এও শোনা যায় শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল এবং সম্রাট শাহজাহান মমতাজের সেই স্বামীকে হত্যা করে তারপর মমতাজকে বিয়ে করেছিলেন। শুধু তাই নয় মমতাজের আগেও সম্রাট শাহজাহানের আরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন এবং মমতাজকে বিয়ে করার পরও সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন। এমনকি মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের আপন ছোট বোনকে বিয়ে করেন। তাজমহলের ডিজাইনারের নাম ছিল ঈশা মোহাম্মদ। তিনি তার স্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য একটি ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন। পরে সম্রাট শাহজাহানের পছন্দ হওয়ায় সেই ডিজাইনের আদলে বানানো হয় তাজমহল। সেই ব্যক্তির চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয় যাতে তিনি নতুন করে আর এই ডিজাইন তৈরি করতে না পারেন। শুধু তাই নয়, যে বিশ হাজার শ্রমিক দিনরাত খেটে এই মহলটি তৈরি করেছিলেন তাদের হাতও কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।

তবে এসব বিতর্ক বোধ করি চিরকাল বিতর্কই থেকে যাবে। সবকিছু ছাপিয়ে মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে তাজমহল। এত দ্বিধা আর সংশয়ের ভিড়ে মানুষ এখনো বিশ্বাস করতে চায় মুঘল সম্রাট শাহজাহান আর মমতাজ যে সৌধের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন, সেই সৌধটি আসলে তাদেরই ভালোবাসার নিদর্শন। সত্যিকার অর্থেই স্ত্রীর প্রতি অমর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছেন এই তাজমহল।

স্বপ্নের সমাধি

শাহজাহানের স্বপ্নের সমাধি তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৩১ সালে, শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। কথিত আছে, স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধির কাজও শুরু করেছিলেন শাহজাহান নিজেই। কিন্তু ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে আগ্রার দুর্গে বন্দী করে রাখায় সেই কাজ আর শেষ করতে পারেননি তিনি। দুর্গের জানালা দিয়ে দূর থেকে তাজমহল দেখতে দেখতে সেখানেই মারা যান শাহজাহান। ১৬৬৬ সালে মৃত্যুর পর শাহজাহানকেও স্ত্রী মমতাজ মহলের সঙ্গে একই সমাধিতে সমাহিত করা হয়।

তাজমহল নির্মাণের জায়গাটি মহারাজা জয় সিংহের সম্পত্তি। এই জমিটি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট শাহজাহান। তিনি মধ্য-আগ্রার একটি প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে ওই জমিটি অধিগ্রহণ করেন। তারপরই কার্যত নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেময় একযোগে কাজে নামে প্রায় ২২ হাজার নির্মাণ শ্রমিক। দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করতে এত বেশি শ্রমিক কাজে লাগানো হয়। নির্মাণ সামগ্রী টেনে নিয়ে যেতে এক হাজারের বেশি হাতিও কাজে লাগানো হয়।

অনেকেই হয়তো জানেন না, তাজমহলের জমিটি এখন যতটা উঁচু দেখা যাচ্ছে আসলে আগে এটি এমন ছিল না। তাজমহল যে জমির ওপর দাঁড়িয়ে সেই জমি ছিল খুবই নিচু। জায়গাটি এই বিশেষ সৌধ নির্মাণের উপযুক্ত করতে প্রচুর মাটি ফেলা হয়।  সেই নিচু জমিকে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০ মিটার বা প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু করা হয়। এজন্য  সেখানে অনেকগুলো পাতকুয়া খোঁড়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে এই কৌশল এখনো ক্ষেত্র বিশেষে আধুনিক স্থাপত্য নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়। তবে এই কুয়াগুলো অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পাথর, বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়।

প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর

তাজমহল নির্মাণের মূল নকশা তৈরি করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহাউরী। সে সময় বেশিরভাগ মুঘল দালানই তৈরি হতো লাল বালু, পাথর দিয়ে। তেমন কিছু নমুনা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ, জামা মসজিদ, তৈমুরের স্মৃতিসৌধ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তাজমহলের একটি বিশেষ দিক রয়েছে। তাজমহল নির্মাণে শাহজাহান প্রথম শ্বেতপাথর ব্যবহার করেন। শ্বেতপাথরের সৌধ হিসেবে তাজমহলের গুরুত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করে। এটি শুধু এখনই নয় সে সময়েও  গোটা ভারতবর্ষের মানুষ কৌতূহলী হন। ১৬৪৮ সালে এই স্মৃতিসৌধের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ হয়। সে হিসাবে প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর। নির্মাণকাজ শেষ হলেও এর সৌন্দর্যবর্ধন চলতে থাকে। আশপাশের বাকি কাজুবাগান, তিন দিকের তিনটি প্রবেশদ্বার পুরোপুরি শেষ হতে আরও পাঁচবছর সময় লাগে। তাজমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দেখা মিললেও এই সৌধ নির্মাণে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। যেমন তাজের মাথার ত্রিশূলটি হিন্দুদের শিবমন্দিরের অনুকরণে, মুসলমানদের মসজিদের মতো করা হয় তাজমহলের চারটি মিনার ও মাথার গম্বুজ।

তাজমহল ছিল প্রকাণ্ড এক নির্মাণযজ্ঞ। এটির বিশেষত্ব ও গুরুত্ব দেখা যায় তাজমহলের নির্মাণ সামগ্রী আয়োজনে। তাজমহলের শ্বেত পাথর আনা হয়েছিল সুদূর রাজস্থানের মাকরানা থেকে। পান্না আসে পাঞ্জাব থেকে, চীন থেকে স্ফটিক, তিব্বত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসে নানা ধরনের নীলকান্তমণি। মোট ২৮ ধরনের দুষ্প্রাপ্য দামি পাথর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আনানো হয় শ্বেতপাথরের গায়ে বসানোর জন্য। তাজমহলের এই অসাধারণ কীর্তি শুধু  ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দ্বারাই নির্মিত হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞদেরও আনা হয়েছিল নানা কাজের জন্য। ভাস্কররা আসেন বুখারা থেকে, হস্তাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া এবং পারস্য থেকে, রত্নশিল্পীরা আসেন উত্তর ভারত থেকে, মণিকারেরা আসেন বালুচিস্তান থেকে।

 

ভূমিকম্পেও টলে না!

তাজমহল শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাজমহলের ভিতটি বড় ধরনের ভূমিকম্পেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ এটির নির্মাণকৌশল সত্যিই চমকপ্রদ। মাটি ভরাটের পর পাতকুয়াগুলোর ওপর এক বিশাল মঞ্চ তৈরি করে। তার ওপর সৌধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়। যে কারণে এর ভিত এতটা মজবুত। এর শীর্ষের দিকে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয় প্রকাণ্ড এক ইটের তৈরি ভারা।

সেই ভারা এতটাই বড় ছিল যে রাজমিস্ত্রিরা জানায়, ভারা ভাঙতে তাদের কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।  তখন শাহজাহান নির্দেশ দেন এই ভারার ইট যে কেউ নিয়ে যেতে পারে একেবারে বিনামূল্যে। এই ঘোষণার পর রাজ্যের হাজার হাজার গরিব কৃষক সেই ভারার ইট খুলে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের গৃহ নির্মাণের জন্য। তাতে রাতারাতি সেই প্রকাণ্ড ভারা অদৃশ্য হয়ে যায়।

তাজমহলের মূল আকৃতি অষ্টকোণী। তবে তাতে লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হয়নি। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে নির্মিত হয় এই সৌধ। যে কাউকে বিস্মিত করবে এর মাথার ওপরকার গম্বুজের কারুকাজ। এতেও কোনো লোহার কাঠামো নেই। ছোট একটি বৃত্তের মতো পাথর সাজিয়ে তার ওপর পাথর সাজিয়ে চলা এবং তার পরিধি প্রথমে ক্রমাগত বাড়িয়ে তারপর কমিয়ে গম্বুজটি নির্মিত। তাজমহলের মূল সৌধের চার ধারে প্রায় ৪০ মিটার বা ১৩০ ফুট উঁচু চারখানি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো একেবারে সমান মাপের। দেখলে মনে হয় মিনারগুলো তিন ভাগে বিভক্ত এবং প্রতি ভাগে একখানি করে বারান্দা রয়েছে।

নান্দনিক ভাস্কর্য

তাজমহলের প্রতিটি ভাস্কর্য এবং তার নকশা একেবারে সমান মাপের। অথচ তখন সব কাজই করা হতো হাতে। এমনকি ছাঁচের ব্যবহারও ছিল না। তাও সব নকশাই সমান। এ ছাড়া তাজমহলের চারদিকে অনেকগুলো আর্চিংয়ের কাজ করা খিলান রয়েছে। যাকে বলা হয় ইয়ান। এই ইয়ানের চারপাশে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম প্রচারের নানা বাণী খোদাই করা আছে। সাধারণভাবে আমরা কাছের জিনিস আমরা বড় দেখি আর দূরের জিনিস ছোট। কিন্তু তাজমহলের ইয়ানের একেবারে মাথার ওপরের শিলালেখ যা ছোট হওয়া স্বাভাবিক ছিল তাও কিন্তু সমান আকারে নজরে পড়ে। এর কারণ তলার হরফের তুলনায় উপরের হরফ বেশ বড়। সেগুলো এমনভাবেই ক্রমাগত নিচ থেকে উপরে বড় করা হয়েছে যে তলায় দাঁড়িয়েও সব কটি হরফ এক মাপের বলে মনে হয়।

তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ধনে এই শিলালিপিতে ব্যবহূত হয় পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃত বাণী। এই শিলালিপি কিন্তু রং দিয়ে লেখা নয়। প্রথমে শ্বেতপাথরের ওপর হরফাকৃতি খোদাই করা। তারপর সেই খোদাই করা জায়গায় সমান মাপের কালো পাথর কেটে বসিয়ে সেই বাণী লেখা।  তাজমহলের অন্তর্সজ্জাও দারুণ।  পাথরের পলিশ এতই উঁচুমানের যে, তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়। সমাধির ঠিক উপরের তলায় একটি কৃত্রিম সমাধি আছে। লোকে সেই সমাধিই দেখে।

স্থাপত্যশৈলী

পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বাই ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের ওপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ বাই ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।

 

সম্রাট শাহজাহান

মুঘল সম্রাট পরিচয় ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তিনি তাজমহলের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার পুরো নাম শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান। শাহজাহান নামটি এসেছে মূলত ফার্সি ভাষা থেকে যার অর্থ ‘পৃথিবীর রাজা’। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর, এবং জাহাঙ্গীরের পরে পঞ্চম মুঘল সম্রাট। ৫ জানুয়ারি ১৫৯২ সালে জন্ম নেওয়া এই মুঘল সম্রাট ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি পরলোক গমন করেন। তিনি ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন।

তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তার হিন্দু রাজপুত স্ত্রী তাজ বিবি বিলকিস মাকানির সন্তান ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত শাহজাহান শাহাজাদা খুররাম নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার শাসনামলকে স্বর্ণযুগ বলা হয় এবং তার সময়ে ভারতীয় সভ্যতা সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। তার রাজত্বের সময়কালের মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ ছিল। এসব স্থাপত্যের মধ্যে আগ্রার তাজমহল সবচেয়ে বিখ্যাত।

 

 

 

মমতাজ মহল

মুঘল সম্রাট যদি তাজমহলের স্বপ্নদ্রষ্টা হন তাহলে তার স্ত্রী মমতাজ মহল সেই স্বপ্নের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। কারণ তার জন্যই আসলে তাজমহলের সৃষ্টি।

তার সাধারণ ডাকনাম আরজুমান্দ বানু বেগম। নামের অর্থ হচ্ছে ‘প্রাসাদের অলঙ্কার’। তার জন্ম ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে ভারতের আগ্রায়। মমতাজের বাবা ছিলেন পারস্যের মহানুভব আবদুল হাসান আসাফ খান। আসাফ খানের আরেকটি পরিচয় হলো তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূর জাহানের ভাই। মমতাজ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে যুবরাজ খুররমের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট শাহজাহান নামে তাখত ই তাউস বা ময়ূর সিংহাসনে বসেন। মমতাজ শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন এবং তিনি শাহজাহানের পছন্দের ছিলেন। নিজেদের চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত বুরহানপুরে ১৬৩১ সালের ১৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়া শাহজাহান স্ত্রীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নির্মাণ করান তাজমহল। এখানেই শুয়ে আছেন মমতাজ।

 

এক ঝলক

>> তাজমহল তৈরি করতে ২২ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে শ্রমিক, রঙমিস্ত্রি, সূচিকর্ম শিল্পী, পাথর কাটার শিল্পীসহ অন্যান্যদের নির্মাণ সময় লেগেছে ১৭ বছর।

>> তাজমহল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রঙ ধারণ করে। সকালে গোলাপি বর্ণের, বিকালে দুধের মতো সাদা বর্ণের এবং রাতে চাঁদের আলোতে সোনালি বর্ণ ধারণ করে। অনেকের মতে, মেয়েদের মন যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তার ওপর নির্ভর করে তাজমহলের রঙ করা হয়েছে। এটি সম্রাট শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিল।

>> মমতাজের মৃত্যুতে সম্রাট এত বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তার সব চুল এবং দাড়ি পেকে যায়।

>> তাজমহলের চারদিক এমনভাবে ডিজাইন করা যে একদিকে তাকালে অন্যদিকে আয়না দেওয়া আছে বলে মনে হয়।

 

 সত্যিই কি কালো মার্বেলের আরেকটি তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন শাহজাহান? শিল্পীর চোখে কালো তাজমহল

কালো তাজমহল

তাজমহলকে ঘিরে মিথের কোনো শেষ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় মিথ হচ্ছে অসমাপ্ত দ্বিতীয় তাজমহলের গল্প। মুঘল সম্রাট শাহজাহান নাকি যমুনার অন্য পাড়ে কালো মার্বেল পাথরে আরেকটি তাজমহল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন?

প্রথম এই গল্পের বীজ বুনেন ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যাপটিস্ট টাভারনিয়ার। ১৬৪০ ও ১৬৫৫ সালে মুঘল রাজধানী আগ্রায় ভ্রমণ করেছিলেন টাভারনিয়ার। তার ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি লিখেন, সম্রাট শাহজাহান যমুনার অপর পাড়ে নিজের সমাধিক্ষেত্রের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলেদের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্থানীয় লোককথায় এর কিছুটা প্রমাণ মেলে। শাহজাহান নাকি যমুনার ওপর একটি সেতু বানিয়ে নদীর দুই পাড়ে নিজের ও স্ত্রীর সমাধিকে সংযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। কালো তাজমহলের মিথ আরও ঘনীভূত হয় ১৯ শতকে এসিএল কারলেইলি নামের এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ যমুনার পাড়ে একটি পুকুরে কালো মার্বেল খুঁজে পাওয়ার দাবি করার পর। পরে অবশ্য দেখা যায় এটি আসলে সাদা মার্বেলই ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়ায় কালো হয়ে গেছে।

গবেষকদের মতে, শাহজাহান তার প্রপিতামহ সম্রাট বাবরের তৈরি মাহতাব বাগকে সংস্কার করে তাজমহল কমপ্লেক্সের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে স্থপতিদের অনুরোধ করেছিলেন। এটাই নাকি পরিকল্পিত দ্বিতীয় বা কালো তাজমহল নির্মাণের স্থান।

তাজমহলের মধ্যে শাহজাহানের সমাধিটির অবস্থান বিবেচনা করলেও এটা বোঝা যায় যে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে একই সমাধিতে সমাহিত হতে চাননি। কেননা, পুরো তাজমহলের নকশায় চূড়ান্ত রকমের প্রতিসাম্য থাকলেও শাহজাহানের সমাধিটি সমাধিঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে বানানো। কিন্তু মমতাজ মহলের সমাধি ওই ঘরের ঠিক মাঝখানে।

এসব তথ্য-উপাত্ত আর বর্ণনায় মনে হতেই পারে যে শাহজাহান আরেকটি কালো তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন নিজের সমাধির জন্য। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। কেননা, কেবল ফরাসি পর্যটক টাভারনিয়ারের লেখা ছাড়া আর কোথাও এমন দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলেনি।

কিন্তু ইতিহাস যা-ই বলুক না কেন, কালো তাজমহলের ধারণাটি অনেক শিল্পীকেই অনুপ্রাণিত করেছে। অনেক শিল্পীই কালো তাজমহলের ছোট্ট অনুকৃতিও বানিয়েছেন এই গল্পের অনুপ্রেরণা থেকেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর