বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মহাকর্ষ-তরঙ্গ উদঘাটনের মানে

মুহাম্মদ ইব্রাহীম

মহাকর্ষ-তরঙ্গ উদঘাটনের মানে

অতি সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বড় খবরটি হলো আইনস্টাইন ১০০ বছর আগে তাত্ত্বিকভাবে যে মহাকর্ষ-তরঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন তা বিজ্ঞানীদের হাতে সত্যি সত্যি ধরা পড়েছে। এর ফলে আইনস্টাইনের অতি গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বটি নতুন করে আরও শক্তভাবে হাতে-কলমে প্রমাণিত হলো। শুধু তাই নয়, মহাবিশ্বের সুদূর প্রদেশের খবর আমাদের কাছে আনতে আমরা একটি নতুন বার্তাবাহকের সন্ধান পেলাম; এতদিন আলো, রেডিও-তরঙ্গ এসবই ছিল সেই বার্তাবাহক। এই লেখায় আমরা যথাসম্ভব সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করব আইনস্টাইন যে মহাকর্ষ-তরঙ্গের কথা বলেছিলেন সেটি আসলে কী। তারপর দেখব এটি এতদিন পর এখন বিজ্ঞানীদের হাতে কেমন করে ধরা পড়ল।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বটি খুবই জটিল ও গাণিতিক একটি তত্ত্ব। তবে আমরা উপমার আশ্রয় নিয়ে এক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয় অংশটি সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা পেতে পারি। মহাকর্ষের তত্ত্বটি প্রথম দিয়েছিলেন প্রায় ৩০০ বছর আগে নিউটন। নিউটনের তত্ত্বে ভরযুক্ত সব বস্তু একে অন্যকে আকর্ষণ করে— সেটিই মহাকর্ষ। এটি এখনো চমৎকারভাবে ফল দিলেও এর সূক্ষ্ম কিছু দুর্বলতার কারণে আইনস্টাইন মহাকর্ষের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সাধারণ তত্ত্বে। এতে তিনি গাণিতিকভাবে দেখালেন ভরযুক্ত সব বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বিকৃত করে দেয়। ভর যত বেশি এই বিকৃতির পরিমাণও তত বেশি। স্থান-কাল জিনিসটিও আইনস্টাইনেরই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি আগেই দেখিয়েছিলেন, যেই স্থান (স্পেস) ও কালকে (টাইম) আমরা আমাদের সব কিছুর আধার বলে গণ্য করে আসছি তারা দুটি পৃথক সত্তা নয়— একই সত্তার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা (ডাইমেনশন)— যেই একীভূত সত্তাকে বলা হলো স্থান-কাল (স্পেস-টাইম)। ভরযুক্ত বস্তু চারদিকের স্থান-কালকে যেভাবে বিকৃত করে তার পূর্ণ জ্যামিতিক রূপ আইনস্টাইন তার সমীকরণে ধরতে পেরেছিলেন। আমরা শুধু একটি উপমার মাধ্যমে এটি দেখতে পারি। শিশুপার্কে বা বাড়িতে আমরা ট্রাম্পোলিন নামে একটি খেলার জিনিস দেখি যার ওপর খুব ছোট শিশুরা লাফালাফি করার জন্য রাবার বা এমন কিছুর চাদরকে টান টান করে মেলে রাখা হয়। তার মাঝখানে যদি একটি ছোট শিশুকে বসিয়ে দিই তাহলে চাদরটি ওখানে আর সমতল থাকবে না, কিছুটা বিকৃত হয়ে পড়বে। উপমাটিতে শিশুটি ভরযুক্ত কিছুর এবং চাদরটি স্থান-কালের প্রতিনিধিত্ব করছে। ওই অবস্থায় ওই চাদরের কোথাও একটি টেনিস বল রাখলে ওটি বিকৃত চাদরের কারণে গড়িয়ে শিশুটির দিকেই যাবে। আমাদের তখন মনে হবে একটি ভর (শিশু) অন্য ভরকে (টেনিস বল) আকর্ষণ করছে। এভাবেই যে মহাকর্ষ নিউটনের কাছে ভরের আকর্ষণ ছিল, আইনস্টাইনের কাছে তা হয়ে পড়ল ভরের কারণে বিকৃত স্থান-কালের ফল।

উপমাটি যদি আমরা চালিয়ে যাই এবং শিশুটিকে এখন চাদরের মাঝখানের ওপর লাফালাফি শুরু করতে বলি তা হলে চাদরটির বিকৃতি এখন নিয়মিত হারে কাঁপাকাঁপিতে পরিণত হবে। এই চাদরটি যদি অনেক অনেক বড়ও হয় এই কাঁপুনির একটি তরঙ্গ চাদর বেয়ে তার কেন্দ্র থেকে কিনারার দিকে ছড়িয়ে পড়বে— অবশ্য যত দূরে যাবে তত দুর্বল হয়ে পড়বে। তবলায় চাঁটি দিলে তারও টান করা চামড়ায় যে এরকম তরঙ্গ হিল্লোল ছড়িয়ে পড়ে তা তো আমরা ওখানে আলগোছে হাত রাখলেই টের পাই। এ চাদরের তরঙ্গও সে রকমেরই। এখন আমরা উপমা ছেড়ে আসল ব্যাপারে যাই। ট্রাম্পোলিনের চাদরটি নেহাতই দুই মাত্রার একটি ধরাছোঁয়ার জিনিস। অন্যদিকে আমাদের ওই স্থান-কাল চার মাত্রার একটি ভিন্ন রকম সত্তা, যা ধরাছোঁয়া-দৃষ্টির আওতায় নেই— স্থানের তিন মাত্রা ও কালের এক মাত্রা। কিন্তু ভরযুক্ত কিছুর উপস্থিতি একেও বিকৃত করবে। বিকৃতির চেহারাটি এক্ষেত্রে অনেক জটিলতর হলেও আইনস্টাইন তার জটিল গাণিতিক সমীকরণে তা ঠিক ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। ওই সমীকরণের সমাধান থেকে এও তিনি দেখাতে পেরেছিলেন যে স্থান-কালের কোথাও ভরযুক্ত বস্তুর কাঁপুনির ফলে স্থান-কালের মধ্যে একটি তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে যাবে যা এর প্রত্যেক বিন্দু দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানকার স্থানকে তরঙ্গাকারে বিকৃত করতে করতে যাবে— এটিই আইনস্টাইনের তত্ত্বের মহাকর্ষ-তরঙ্গ। যেমন উদাহরণস্বরূপ তরঙ্গ যেখান দিয়ে যাবে সেখানে কোনো নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যায়ক্রমে ওই তরঙ্গের ভঙ্গিতে ছোট-বড় হতে থাকবে। সেখানে এরকম দূরত্বের বাড়া-কমা ধরতে পারার মাধ্যমে মহাকর্ষ-তরঙ্গ উদঘাটিত হতে পারে। আর ঠিক সেভাবেই শেষ পর্যন্ত এটি উদঘাটিত হয়েছে। বস্তুর ওই ভর যদি অত্যন্ত বেশি হয় এবং তা যদি দারুণভাবে তোলপাড় করে কাঁপে তাহলে স্থান-কাল বেয়ে আসা সে তরঙ্গ অনেক দূরে গিয়েও অনুভূত হবে যদিও বা তার সেখানে যেতে শত কোটি বছরও লেগে যায়। মহাবিশ্বের সুদূর প্রদেশে সৃষ্টি হওয়া এমনি তরঙ্গ পৃথিবীতে আসতে আসতে এত দুর্বল হয়ে যায় যে আইনস্টাইনের কালে অথবা তার শত বছর পরেও এমন সংবেদনশীল কোনো উপায় ছিল না যার মাধ্যমে সেই তরঙ্গ উদঘাটন করা যায়। তাই এটি শুধু তত্ত্ব হয়েই ছিল, প্রমাণিত হতে পারেনি।

 

অবশ্য ১৯৭৪ সালে রাসেল হাল্স এবং জোসেফ টেইলর — এই দুজন বিজ্ঞানী পরোক্ষভাবে মহাকর্ষ-তরঙ্গের এক রকম প্রমাণ দিয়েছিলেন। তারা দেখলেন যে ২১ হাজার আলোক-বর্ষ দূরের (যার থেকে আলো আসতে ২১ হাজার বছর লাগে) দুটি খুবই ভারী তারা একে অপরের চারদিকে ঘুরছে। কিছু বড় তারা শক্তি উৎপাদনের বয়স শেষ করে বৃদ্ধ হলে নিজের ওপর নিজে এমনভাবে ধসে পড়ে যে তার পরমাণুগুলো পর্যন্ত আর টেকে না। তখন এগুলো শুধু নিউট্রনে গড়া অতি ঘনভরের ছোট নিউট্রন-তারায় পরিণত হয়ে— যার ছোট অবয়বের মধ্যে অবশ্য মূল তারার সব ভরই থাকে। এভাবে খুব কাছাকাছি থেকে ওই পরস্পরের চারদিকে ঘোরা তারা দুটি ছিল এমনি নিউট্রন-তারা যাদের মধ্যে মহাকর্ষ বল তাই প্রচণ্ড। হালস ও টেইলর এদের ঘোরার আচরণ থেকে হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে এরা একটি বিশেষহারে শক্তি হারিয়ে পরস্পরের কাছে চলে আসছে। এই হারানো শক্তিটি যেভাবে বিকীর্ণ হচ্ছে বলে বোঝা যাচ্ছিল তার হিসাবটি আইনস্টাইনের সমীকরণ বর্ণিত মহাকর্ষ-তরঙ্গের সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছিল। পরোক্ষভাবে মহাকর্ষ-তরঙ্গ প্রমাণে এই সাফল্যের জন্য ওই বিজ্ঞানী দুজন ১৯৯৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

কিন্তু এবার যে সাফল্য এসেছে সেটি পরোক্ষ প্রমাণ নয়— একেবারেই হাতেকলমে প্রমাণ। এটি অবশ্য অনেক বিজ্ঞানীর কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে সম্মিলিত গবেষণার ফলেই সম্ভব হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও আরও ১৪টি দেশের মোট এক হাজারের বেশি বিজ্ঞানী কাজ করেছেন বটে কিন্তু এ গবেষণার প্রাণ হলো লিগো নামের দুটি যন্ত্র, যার একটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের একটি রাজ্য লুজিয়ানার লিভিংস্টোনে আর অন্যটি রয়েছে উত্তরের একটি রাজ্য ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ডে। এই যন্ত্র দুটিতেই একেবারে হাতেনাতে উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে অতি অতি দুর্বল হয়ে পৃথিবী দিয়ে যাওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ— এতই সংবেদনশীল এই যন্ত্র। দেখা গেছে মহাকর্ষ তরঙ্গটির উৎস হলো পৃথিবী থেকে ১০০ কোটি আলোকবর্ষের বেশি দূরে, যার মানে সেখান থেকে আলো আসতেই ১০০ কোটি বছরের ওপরে লেগে যায়। এত দূর থেকে আসার কারণেই মহাকর্ষ তরঙ্গ এখানে অতি অতি দুর্বল— এটি স্থানীয় স্থান-কালকে যেটুকু কাঁপিয়ে যায় উদঘাটন করার জন্য তা খুবই অপ্রতুল।

কিন্তু লিগো যন্ত্রটি তাই করতে পেরেছে। লিগো নামটি আদ্যাক্ষরে গঠিত— পুরো কথাটি হলো ‘লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিট্যাশন্যাল-ওয়েভ অবজারভেটরি। এতে ইংরেজি খ অক্ষরের মতো সাজানো দুটি বাহুর প্রত্যেকটি চার কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রত্যেক বাহুর দুই প্রান্তে রয়েছে পরস্পর মুখোমুখি আয়না যার মধ্যে একটি লেজার আলোর রশ্মি বার বার প্রতিফলিত হয়ে আসা-যাওয়া করে। দুই বাহুতে আলোর দুটি রশ্মি এভাবে এসে এক জায়গায় পরস্পরের ওপর উপরিপাতিত হলে দুটির আলোক তরঙ্গের একের শীর্ষবিন্দু যেখানে অন্যটির শীর্ষবিন্দুর ওপর পড়ে সেখানে উভয়ে একত্রিত হয়ে জোরালো আলো দেয়, আর যেখানে একের শীর্ষবিন্দু অন্যটির পাদবিন্দুর ওপর পড়ে সেখানে একটি অন্যটিকে নষ্ট করে অন্ধকার সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারটিকে বলা হয় আলোর ইন্টারফেরেন্স। এভাবে খুব সরু সরু ফালির আলো-অন্ধকারের প্যাটার্নে সূক্ষ্ম কোনো পরিবর্তন দেখা গেলে তা বলে দেয় যে, দুই আয়নার মাঝের ওই দুই বাহুর তুলনামূলক দৈর্ঘ্যে অতি অতি সামান্য কোনো হেরফের হয়েছে কিনা, কারণ ওই দৈর্ঘ্যের ওপরেই উভয়ের আলোক তরঙ্গের শীর্ষ অন্যের শীর্ষে পড়বে না পাদবিন্দুতে পড়বে তা স্থির হয়। এটিই স্থানের সূক্ষ্ম পরিবর্তন মাপার বেশ পুরনো একটি কৌশল— ইন্টারফেরোমেট্রি। অদ্ভুত রকম অধিক সংবেদনশীলতাটাই অবশ্য লিগোর ইন্টারফেরোমেট্রির নতুনত্ব। হিসাবে দেখা যায় যদি মহাকর্ষ তরঙ্গ ওখান দিয়ে যায় তা হলে খ-এর বাহুর দৈর্ঘ্যে হেরফের ঘটার পরিমাণ ১০-১৮ মিটার, অর্থাৎ একের পিঠে ১৮টি শূন্য দিলে যে বিশাল সংখ্যা হয় তত ভাগের এক মিটার! লিগো এটুকু হেরফের মাপতে পারার মতো সংবেদনশীলতা রাখে বলেই এই বিশেষ মহাকর্ষ তরঙ্গটি উদঘাটিত হতে পেরেছে প্রথম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর আরও ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সবকিছু মিলিয়ে দেখে অবশেষে মহাকর্ষ তরঙ্গ হাতেনাতে পাওয়ার ঘোষণা এসেছে।

মহাকর্ষ তরঙ্গ যখন লিগো যন্ত্রকে অতিক্রম করে তখন ওখানে স্থান-কালে অতি সূক্ষ্ম বিকৃতি ঘটিয়ে যায়। তাতে খ-এর দুই বাহুর দৈর্ঘ্যে যে অতি সূক্ষ্ম টানাপড়েন ঘটে ইন্টারফেরোমিটারে সেটির পরিমাপই মহাকর্ষ তরঙ্গের ইলেকট্রনিক সিগন্যালটি সৃষ্টি করে। এই সিগন্যাল পর্দায় তরঙ্গকার গ্রাফের রূপে দেখে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা গেছে। আবার একে শব্দে রূপান্তরিত করে তরঙ্গের ‘শব্দ’ শোনাও গেছে। এ তরঙ্গের প্যাটার্নকে কম্পিউটারে থাকা গাণিতিক মডেলে বিশ্লেষণের জন্য ফিট করানো হয়েছে। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী এই মডেল বলে দেয় যে, কী রকম তরঙ্গ প্যাটার্ন হলে মহাবিশ্বের গহিনে কতদূরে কী রকম প্রচণ্ড তোলপাড়ের শক্তি বিকিরণে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে। এভাবেই কম্পিউটার মডেল থেকে আমরা জেনেছি যে, পৃথিবী থেকে ১.৩ শত কোটি আলোকবর্ষ দূরে অতি ঘন ভরের কারণে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়া প্রত্যেকটি ৩০টি সূর্যের সমান ভরের দুটি তারা ক্রমাগত পরস্পরকে আবর্তন করতে করতে পরস্পরের কাছে থেকে শক্তি বিকিরণ করেছে। মহাবিশ্বের ইতিহাসে আদিতে এক সময় এটি ঘটছিল। শেষ পর্যন্ত উভয়ে খুবই কাছে এসে আলোর গতির প্রায় অর্ধেক গতিতে পরস্পরকে আবর্তন করেছে এবং একসঙ্গে মিশে গিয়ে গিয়ে দুটির বদলে একটি ব্ল্যাক হোল হয়েছে। সেই বিশেষ সময়েই মিলিত ব্ল্যাক হোলের ভরের একটি বড় অংশ ঊ=গপ২ ফরমুলা অনুযায়ী শক্তিতে পরিণত হয়ে সেই প্রচণ্ড তোলপাড়টি সৃষ্টি করেছিল। এরই সৃষ্ট তরঙ্গ শতকোটি আলোকবর্ষ দূরে এসে এত দুর্বল হয়েছে যে, এখানকার লিগো যন্ত্র অতিক্রম করার সময় স্থানের ওইটুকু অতি অতি সামান্য বিকৃতি ঘটিয়ে যাচ্ছে। সিগন্যালের ওই শব্দটিতে যেন আমরা মহাবিশ্বে সুদূরে ব্ল্যাক হোল দুটির এক হওয়ার ওই প্রচণ্ড তোলপাড়ের আভাসটিই শুনতে পাচ্ছি এত দূর থেকে। তোলপাড়টি এত প্রচণ্ড না হলে হয়তো লিগোর বর্তমান সংবেদনশীলতায় কুলাত না, মহাকর্ষ তরঙ্গ উদঘাটন করতে তাকে আরও সংবেদনশীল হতে হতো।

তবে একবার যখন মহাকর্ষ তরঙ্গ উদঘাটিত হয়েছে এখন আমরা আশা করতে পারি যে, সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে এই মহাকর্ষ তরঙ্গের মাধ্যমে এখন থেকে মহাবিশ্বের ছোট বড় বহু ঘটনার খবর আমরা পাব যা এতদিন মহাবিশ্ব থেকে আসা আলোক তরঙ্গের মাধ্যমে পাচ্ছিলাম না— রেডিও তরঙ্গ, এক্স-রে তরঙ্গ ইত্যাদির মাধ্যমেও পাচ্ছিলাম না। এই শেষোক্তগুলো সবই বিদ্যুৎ চৌম্বক তরঙ্গের নানা রূপ। কিন্তু নতুন আবিষ্কৃত ও উদঘাটিত মহাকর্ষ তরঙ্গ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির একটি নতুন তরঙ্গ— এটি ওই দলেই পড়ে না। এর উদঘাটনে মহাবিশ্ব সংক্রান্ত বিজ্ঞান একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা পেল। সেই সঙ্গে এটি ১০০ বছর আগে তাত্ত্বিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা এই তরঙ্গ হাতেনাতে ধরতে পেরে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার শক্তি আবার প্রমাণ করল। এ জন্যই একে আমাদের কালের একটি অন্যতম প্রধান আবিষ্কার বলা হচ্ছে।

কিন্তু একটি বিষয় আমাদের এখনো দেখা হলো না। এতই সামান্য দুর্বল যে সিগন্যাল— বুঝলাম কি করে যে এটি কোনো ইলেকট্রনিক নয়েজ নয়, বা অন্য কোনো কারণে সৃষ্ট কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়? ওপরে সিগন্যালগুলোর ছবির দিকে তাকালে তার তাত্পর্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কিছু প্রমাণ পাওয়া যাবে। সিগন্যালের ওঠানামাটি লিগোর বাহুর দৈর্ঘ্য বড় ছোট হওয়া বোঝাচ্ছে, আর এর ডানদিকে এগোনো অক্ষটি অতিক্রান্ত সময় বোঝাচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ছবিতে যথাক্রমে হ্যানফোর্ডে এবং লিভিংস্টোনে থাকা দুটি লিগোর সিগন্যাল দেখা যাচ্ছে— যার প্রত্যেকটির সঙ্গে রয়েছে আইনস্টাইনের তত্ত্বের হিসাব অনুযায়ী ভবিষ্যদ্বাণী করা মহাকর্ষ তরঙ্গের তাত্ত্বিক সিগন্যাল। দেখা যাচ্ছে উদঘাটিত জটিল এই তরঙ্গ-সিগন্যাল তাত্ত্বিক সিগন্যালের সঙ্গে প্রায় মিলে যাচ্ছে— কাজেই এটি অন্য কিছু হতে পারে না। পরস্পর থেকে শত শত মাইল দূরে থাকা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি লিগো থেকে প্রায় একই সময়ে পাওয়া সিগন্যাল তৃতীয় ছবিতে একসঙ্গে দেখানো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, দুটি হুবহু মিলে যাচ্ছে— কাজেই এরা একই তরঙ্গের সিগন্যাল হতে বাধ্য কারণ উভয়টিতে একই কাকতালীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। দেখা যাচ্ছে দক্ষিণের লিগোতে সিগন্যালটি দেখা যাওয়ার ৭ মিলি সেকেন্ড পর উত্তরের লিগোতে একই সিগন্যাল দেখা গেছে। উভয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব অতিক্রম করতে মহাকর্ষ তরঙ্গের এই সময়ই লাগার কথা।এ জন্য তৃতীয় ছবিতে হ্যানফোর্ডের সিগন্যালটি অন্যটির ওপর পড়ার জন্য বামদিকে ৭ মিলি সেকেন্ড সরিয়ে দেখানো হয়েছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে, সিগন্যালটি লিভিংস্টোনের বা হ্যানফোর্ডের স্থানীয় কোথাও থেকে আসছে না, সুদূর মহাবিশ্ব থেকে আসা মহাকর্ষ তরঙ্গই এটি সৃষ্টি করছে। দক্ষিণের লিগোতে আগে আসাতে বোঝা গেল এটি মহাকাশের খণ্ড গোলকের দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে আসছে। সবদিক থেকে নিশ্চিত হয়েই এই ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা এসেছে মহাকর্ষ তরঙ্গ উদঘাটনের।

[ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক।]

সর্বশেষ খবর