শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

একজন স্যামসন এইচ চৌধুরী

লাকমিনা জেসমিন সোমা

একজন স্যামসন এইচ চৌধুরী

ছোটবেলা থেকেই নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বড় হয়েছেন। জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তার স্বপ্নের গণ্ডি। এক কথায় তিনি ছিলেন স্বপ্নচারী মানুষ। কৈশোরেই ভবিষ্যৎ গড়তে বাড়ি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন নেভিতে। সরকারি ডাক বিভাগেও চাকরি করেছেন তিনি। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানেননি কখনো। তিনি স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। ছোট্ট একটি ফার্মেসি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এই সফল উদ্যোক্তা। সেখান থেকেই আজকের স্কয়ার গ্রুপ।  বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ীকে নিয়ে রকমারির আজকের আয়োজন।

ছেলেবেলা

স্যামসন এইচ চৌধুরীর ছেলেবেলা কেটেছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। বলতে গেলে স্কুলে-স্কুলে। কখনো বাবার চাকরির সুবাদে, আবার কখনো বা উন্নত শিক্ষার জন্য পরিবারের ইচ্ছায় একের পর এক স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। জন্মস্থান গোপালগঞ্জ জেলার আরুয়াকান্দিতে। বাবা ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ছিলেন একজন মেডিকেল অফিসার। সহজ কথায় ডাক্তার। মায়ের নাম লতিকা চৌধুরী। বাবার পোস্টিং চাঁদপুর মিশন হাসপাতালে হওয়ায় শিশু স্যামসনের স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল চাঁদপুর মিশন স্কুলে। কিন্তু কয়েক বছর পরেই ইয়াকুব চৌধুরী ফের চাঁদপুর থেকে পাবনায় বদলি হয়ে যান। স্যামসন চৌধুরীকে এবার পাবনার আতাইকুলায় এক গ্রাম্য স্কুলে ভর্তি হতে হলো। ঠিক পরের  বছরই সুশিক্ষার জন্য বাবা-মা তাকে পাঠালেন ময়মনসিংহে। সেখানে ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন তিনি। সব মিলিয়ে ময়মনসিংহে দুই বছর পড়াশোনা করেছেন। এরপরই ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায় তার পরিবার। কলকাতা থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরত্বে বিষ্ণুপুরে শিক্ষাসংঘ হাইস্কুলে ভর্তি হন স্যামসন। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকাটা নিরাপদ মনে করেনি। ফলে নিজেদের সিদ্ধান্তে ১৯৪২ সালে নিজ গ্রামে ফিরে এলো স্যামসনের পরিবার। আতাইকুলা হাইস্কুলে নতুন করে পড়ালেখা শুরু করলেন স্যামসন। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

 

কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে নেভিতে

কৈশোর থেকে স্যামসন চৌধুরী অনেকটা স্বপ্নচারী মানুষ ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন ভালো কিছু করার। অল্প বয়স থেকেই তার চিন্তার গভীরতা ও পরিপক্বতা তাকে এক অনন্য মানুষ হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছিল। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কাউকে কিছু না বলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ছাড়েন স্যামসন। প্রথমে কলকাতার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন তিনি। পরে সেখান থেকে নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। যান মুম্বাই। চাকরির সন্ধানে ঘুরতে থাকেন বন্দরে বন্দরে। এরপর সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নৌবাহিনীতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। শুধু তাই নয়, কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণও হন।

কিশোর স্যামসনের সব সময় ঝোঁক ছিল নতুন প্রযুক্তির প্রতি। নেভিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে সিগন্যাল বিভাগে দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই সাড়া দিলেন না স্যামসন। উল্টো তিনি ‘রাডার অপারেটর’ হওয়ার জন্য আবেদন করলেন। সেই সময়ে নেভিতে রাডার একেবারেই নতুন ও আকর্ষণীয় একটি বিভাগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করত এই বিভাগ। যুদ্ধের সময় কীভাবে শত্রু জাহাজগুলো শনাক্ত করা হয় এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করা হয়, তা জানার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল স্যামসন চৌধুরীর। একসময় এই অদম্য আগ্রহই তার জন্য কাল হয়ে উঠল। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি কোনোভাবেই রাডার বিভাগ ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করতে চাইলেন না। তার এই একরোখা জেদের কারণে তাকে অবশেষে জেলে ঢুকতে হলো। সেবার চার দিন জেলে থাকতে হয়েছিল তাকে। সেখানে প্রতিদিন সকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে কিশোর স্যামসনকে জিজ্ঞাসা করতেন তার মন ঘুরেছে কিনা। কিন্তু না; কোনোভাবেই তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়লেন না। অবশেষে পঞ্চম দিনে কর্মকর্তারা তার অদম্য ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে তাকে রাডার বিভাগে নিয়োগ দিলেন।

স্যামসন চৌধুরী সব মিলিয়ে তিন বছর রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে চাকরি করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তিনি ও তার কিছু সহকর্মী মিলে মাদ্রাজের বিশাখাপত্তন বন্দরে ফিরে আসেন। সেখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নৌ-বিদ্রোহে অংশ নেন। ফের জেলে যান। পাঁচ দিন জেলে থাকার পর বিদ্রোহী নৌ-সেনাদের বাহিনীর সদর দফতর তালোয়ারে পাঠানো হয়। তবে সেখানে তাদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়। এরপর তাদের প্রশ্ন করা হয়— তারা এখানে সেনা হিসেবে চাকরি চালিয়ে যেতে চায় নাকি চাকরি ছেড়ে দিতে চায়। স্যামসন চৌধুরী নিজের অবস্থানে অটল থেকে সেখানেই থেকে যেতে চান। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ‘ভারমুক্ত’র সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে সরকারের অন্য কোনো প্রশাসনিক দফতর বা আইনশৃঙ্খলা বিভাগে নিয়োগের সুপারিশ করে নৌবাহিনী।

 

পোস্ট অফিসে চাকরি

নৌ-বাহিনী ছেড়ে ১৯৪৭-এ বাড়ি ফিরে এলেন স্যামসন চৌধুরী। পাবনায় ফিরে নতুন করে সরকারের ডাক বিভাগে যোগদান করলেন তিনি। ওই বছর ৬ আগস্ট ১৫ বছরের কিশোরী অনীতা চৌধুরীকে বিয়ে করেন স্যামসন। স্যামসন এইচ চৌধুরীর তিন ছেলে— অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী। একমাত্র মেয়ের নাম রত্না পাত্র। পোস্ট অফিসে চাকরির সময় ট্রেড ইউনিয়নে জড়িয়ে পড়েন চৌধুরী সাহেব। একবার এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বাগ-বিতণ্ডার জের ধরে শাস্তিস্বরূপ অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারসহ তাকে বদলি করে দেওয়া হলো। বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি স্যামসন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ফিরে আসেন বাড়িতে।

 

 

বাবার ফার্মেসিতেই ব্যবসার হাতেখড়ি

চাকরি ছাড়ার পর বাবার ইচ্ছায় তার ডিসপেনসারিতেই বসতে শুরু করলেন স্যামসন চৌধুরী। মূলত বাবার এই ওষুধের দোকানেই স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসার হাতেখড়ি। ওই সময় ইয়াকুব হোসেন চৌধুরীই ওই অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা ডাক্তার ছিলেন। তখন ওই এলাকায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল। ওই চিকিৎসালয়টি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের চিকিৎসাসেবার কথা চিন্তা করেই এই চেম্বার ও ওষুধের দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইয়াকুব চৌধুরী। দূর-দূরন্ত থেকে লোকজন সেখানে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ নিতে আসেন। ইয়াকুব হোসেন তার ছেলেকে যখন ফার্মেসি দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন তখন তিনি নিজেই বেশ ধন-সম্পত্তির মালিক হয়ে গেছেন। বিশেষ করে সেই সময়ে তার প্রচুর কৃষি জমি ও খামার ছিল। কিন্তু স্বপ্নচারী স্যামসন বাবার সম্পত্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি নিত্য-নতুন সমৃদ্ধির কথা ভাবতেন। পথ বের করার চেষ্টা করতেন। অবশেষে তিনি একটি ওষুধ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ কাজে ১৯৫৬ সালে স্যামসন তার বাবার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিলেন। কোম্পানির নাম রাখলেন ই-সনস (ইয়াকুব হোসেন অ্যান্ড সনস্)। সিরাপ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তিনি কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে এই কোম্পানির মালিক, শ্রমিক, পরিবেশক এবং বাজারজাতকারক ছিলেন তিনি একাই। আর তার এই ফ্যাক্টরির একমাত্র সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী অনীতা।

যেভাবে ‘স্কয়ার’-এর যাত্রা শুরু

তৎকালীন পাবনায় একজন হিন্দু ফার্মাসিস্ট ছিলেন। তিনি ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরি করতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ইন্ডিয়ায় চলে যান। তার ফার্মেসিটি একজন লোক কিনে নেন এবং কোম্পানির নাম দেন ‘এডরুক’। মূলত এই কোম্পানিটিই স্যামসনকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি মনে করলেন, ‘ওরা যদি এমন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারে তবে আমি কেন পারব না।’ ডা. কাজী হারুনার রশিদ নামে তার একজন বন্ধু ছিল। স্যামসন চৌধুরীর অনুরোধে সেই ডাক্তার বন্ধুটি সপ্তাহে দুই দিন আতাইকুলাতে আসতেন। স্যামসনের ফার্মেসিতে বসে রোগী দেখতেন। একদিন এই বন্ধুর সঙ্গে তার নতুন পরিকল্পনার কথা বললেন। তাকে পার্টনার হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ডা. রশিদও আনন্দের সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এরপর আরও দুজন বন্ধু— ডা. পিকে সাহা এবং রাধা বিনোদ রায় পার্টনার হিসেবে যোগ দিলেন। স্যামসন চৌধুরী তাদের চারজনের এ ওষুধ কোম্পানির নাম দিলেন ‘স্কয়ার’। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে স্যামসন চৌধুরী নিজেই এই নামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যায় বলেছেন, আমরা চার বন্ধু  মিলে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করায় এর নাম দিই স্কয়ার। স্কয়ার নামের পেছনে আরও একটি তাত্পর্যের কথা বলতেন চৌধুরী সাহেব। তিনি বলতেন, চতুর্দিকে সমান হলেই কেবল তা বর্গক্ষেত্র বা স্কয়ার হতে পারে, যেটির অন্তরালে ‘সঠিকতা’ ও ‘পরিপূর্ণতা’ নিহিত। আর এ কারণেই এ কোম্পানির নাম স্কয়ার।

মাত্র ১৭ হাজার টাকা নিয়ে ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল স্কয়ার। যদিও যাত্রার শুরুতে প্রথম তিন বছর কোনো লাভের মুখ দেখেনি কোম্পানিটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই চার বন্ধু তাদের বিনিয়োগ বাড়ালেন। এরপর চতুর্থ বছরে তারা কিছুটা লাভের মুখ দেখলেন। ১৯৬২ সালে ঢাকায়  কোম্পানির প্রথম শাখা অফিস হলো। এভাবেই নানা চড়াই-উত্রাইয়ের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলল কোম্পানিটি।

 

দেশে-বিদেশে স্কয়ারের জয়জয়কর

মূলত স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল ছিল স্কয়ারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ওই বছর কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে স্কয়ারের চুক্তি হলো। এই চুক্তির আওতায় স্কয়ারকে সম্পূর্ণ আধুনিক রূপ দিলেন স্যামসন চৌধুরী। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ তৈরি হতে লাগল।

এরপর আশির দশকে নতুন ড্রাগ পলিসি স্কয়ারের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয় স্কয়ার। এরপর আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি চৌধুরী সাহেবের। আজও ওষুধ শিল্পে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে কোম্পানিটি। আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা দেশে নানা প্রান্তে ওষুধ রপ্তানি করছে তারা। ১৯৮৭ সালে স্কয়ার প্রথম তাদের তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে।

নব্বই দশকের শুরুতে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাজারে শেয়ার ছাড়ে। এর কয়েক বছর পরেই তারা ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি অর্জন করে। পরের বছর ১৯৯৮ সালে স্কয়ার আইএসও-৯০০১ সনদ লাভ করে।

ওষুধের পাশাপাশি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি আলাদা ব্যবসা শাখা হিসেবে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে ‘স্কয়ার টয়লেট্রিস’। স্যামসন চৌধুরী তার দূরদর্শী চিন্তা এবং ব্যবসায়িক দক্ষতা দিয়ে বাড়াতে থাকেন ব্যবসা। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড। এর কয়েক বছর পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘এগ্রো কেমিক্যালস ভ্যাটেরিনারি’ ইউনিট খোলা হয়। স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসায়িক দক্ষতায় কয়েক বছরের মধ্যেই একে একে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার স্পিনিং লিমিটেড, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস্্ লিমিটেড, স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্ট লিমিটেড, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স এবং স্কয়ার হসপিটালের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। স্যামসন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তার উত্তরসূরি ছেলেরা স্কয়ার গ্রুপকে আরও অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্য-নতুন ব্যবসা সম্প্রসারণে অবদান রাখেন তারাও। প্রতিষ্ঠিত হয় সান কমিউনিকেশন লিমিটেড, মিডিয়া কম লিমিটেড, রেডিও দিন রাত, ওরাকল ট্রাভেলস লিমিটেড, মাছরাঙা কমিউনিকেশনস লিমিটেড, স্কয়ার সিকিউরিটিস ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

 

যে স্বপ্নটি আজ সত্যি হওয়ার পথে

ব্যবসা ক্ষেত্রে স্যামসন এইচ চৌধুরীর একটি বিশেষ স্বপ্ন ছিল। শখ ছিল নিউইয়র্ক স্টক একচেঞ্জে তার কোম্পানির নাম লেখাবেন। অর্থাৎ নিউয়র্ক স্টক একচেঞ্জে স্কয়ারকে তালিকাভুক্ত করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করে যেতে পারেননি। আর সে কারণেই হয়তো আজ স্কয়ার গ্রুপ পরিবারের জন্য সবচেয়ে খুশির খবর হলো, তারা তাদের অভিভাবকের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন। জানা গেছে, খুব শিগগিরই কোম্পানিটি নিউইয়র্ক স্টক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হচ্ছে।

 

সফলতার রহস্য

স্যামসন চৌধুরীর সঙ্গে ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছেন এমন কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। চৌধুরী সাহেবের সফলতার পেছনে তারা প্রথমত যে দক্ষতার কথা বলেন, সেটি হলো দূরদর্শিতা। দ্বিতীয়ত, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা। খুব দ্রুত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি। নিজের কোনো প্রতিষ্ঠানে কখনো শ্রমিক অসন্তোষ হতে দেননি তিনি। জানা যায়, স্যামসন চৌধুরী তার সহকর্মীদের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। তাদেরকে নিজের পরিবারের সদস্যই মনে করতেন। কেবল অফিসিয়াল কাজ নয়, শ্রমিকদের ব্যক্তিগত জীবনেরও খোঁজখবর নিতেন তিনি। অফিসে বা ব্যক্তিগত জীবনে কখনো কাউকে সরাসরি তিরস্কার করতেন না। অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে এমন কৌশলী আচরণ করতেন যাতে পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি নিজেই তার কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করতেন তিনি। ব্যবসা ক্ষেত্রে নিজের সন্তান ও সহকর্মী— সবার সিদ্ধান্ত বা মন্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা।

 

অনুপ্রেরণার মূলে যে মহীয়সী নারী

যুবক স্যামসন চৌধুরীর বয়স তখন ২২। সবেমাত্র ডাক বিভাগে চাকরি শুরু করেছেন। এরই মধ্যে হঠাৎ বিয়ের কথা উঠল। স্যামসন নিজেও এক কিশোরীকে পছন্দ করতেন। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে ভালোবাসতেন। বাড়ির পাশেই বাড়ি তার। নাম- অনীতা। এই অনীতাকেই জীবনসঙ্গী করেছেন স্যামসন চৌধুরী। কেবল জীবনসঙ্গী নন, অনীতা চৌধুরী ছিলেন তার ছায়া সঙ্গী। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে সারাক্ষণ স্যামসন চৌধুরীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন এই মহীয়সী নারী। ভালোবাসার আঁচলে আগলে রেখেছেন নিজের স্বামী-সন্তান ও পরিবারকে। স্যামসন চৌধুরী ১৯৫৬ সালে তার বাবার কাছ থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে যখন নিজের বাড়িতে সিরাপ তৈরি শুরু করেছিলেন তখন তার সেই ‘ই-সনস’ কোম্পানির মালিক, শ্রমিক, সরবরাহকারক কিংবা বাজারজাতকারক বলতে ছিলেন তিনি একাই। আর এসব কাজের একমাত্র সহায়ক ছিলেন অনীতা। তার ভালোবাসার এমন অনেক দৃষ্টান্তই মেলে স্যামসন চৌধুরীর পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকে। আজও একান্নবর্তী পরিবারের জন্য মডেল হয়ে আছে এই চৌধুরী পরিবারটি। এখনো চৌধুরী পরিবারের অভিভাবক কিংবা মধ্যমণি অনীতা চৌধুরী। বার্ধক্যের কারণে কিছুটা শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়ে সবাইকে নিয়ে বেশ ভালোই আছেন তিনি। সবাই বলে, আলোয় ভরা সংসার তার!

 

নীরবে-নিভৃতে সমাজসেবা

সমাজসেবার ক্ষেত্রে এক অনন্য মানুষ ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। নীরবে-নিভৃতে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এমনকি তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করলেও এ বিষয়ে খুব একটা কিছু বলতেন না। পরবর্তীতে নানা ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা তার এই নীরব সমাজসেবার কথা জানতে পারতেন। আত্মপ্রচার একেবারেই পছন্দ করতেন না চৌধুরী সাহেব। অথচ তার কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে অগণিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর সে কারণেই মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা একই পথে হাঁটছেন। একইভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানাভাবে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করলেও নিজেদের নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণেই স্কয়ার গ্রুপ সেগুলো প্রচার করতে চায় না।

 

 

চলে গেলেন, তবু থেকে গেলেন দৃষ্টান্ত হয়ে

ব্যবসায়ীদের মাঝে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ তাকে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার’ ঘোষণা করে। সফলতার ঝুলিতে এমন অনেক স্বীকৃতিই জমা আছে তার। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থা ও সংগঠনের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অত্যন্ত ধর্মানুরাগী স্যামসন চৌধুরী তার নিজের খ্রিস্টান ধর্মের জন্যও অনেক কিছু করে গেছেন। সেখানেও মানুষের অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছেন। আর এভাবেই তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনন্য হয়ে উঠেছেন। দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন মহাকালের যাত্রায়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে তিনি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর