শনিবার, ৫ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ক্রেমলিনের গোপন নেটওয়ার্ক

তানভীর আহমেদ

ক্রেমলিনের গোপন নেটওয়ার্ক

শুরুর দিকটা গল্পের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৯২ সালে সাংবাদিক ও লেখক ভ্লাদিমির গোনিক তার এক উপন্যাসে লিখলেন রাশিয়ার ভূ-গর্ভস্থ টানেলগুলো নিয়ে। সেই টানেলগুলো অনকেটাই বাঙ্কারের আদলে। যুদ্ধের সময় এ ধরনের বাঙ্কার নির্মাণ করা হয়ে থাকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। বিশেষ করে বোমা হামলা ঠেকাতে বাঙ্কারের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর কী হতে পারে। লেখকের উপন্যাস নিয়ে নাড়াচাড়া করার মানুষের অভাব নেই। কৌতূহল গিয়ে তাই রাশিয়ার কলিজা মস্কোর দিকে গড়িয়ে গেল। মস্কোর বুকের ভিতর দিয়ে নির্মিত এই বাঙ্কারগুলো জনমানুষের আলোচনায় জায়গা নিয়ে নিল। ম্যাগাজিনের ছাপানো এক গল্প নিয়ে তখন তোলপাড়। শুধুই কি গল্প এটি? নাকি সত্যিই মস্কোর গহিনে রয়েছে এমন নিরাপদ টানেল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে অধীর আগ্রহে বসে থাকা মানুষগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় আরও দুটি বছর। সেই ঔপন্যাসিক নিজেই একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেখানে তিনি সিরিজ লিখতে শুরু করলেন। নাম দিলেন মেট্রো-২। মেট্রো-২ শব্দটা দিয়ে বুঝাতে চাইলেন রাশিয়ার মাটির ওপরেই শুধু নয় আরও একটি গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে মাটির নিচেও। ভূ-গর্ভস্থ টানেল মোটেই চমকপ্রদ কিছু নয় ততদিনে। চমকটা ছিল আরও আড়ালে। এই টানেলগুলো রাশিয়া সামরিক কাজে ব্যবহার করার জন্য নির্মাণ করেছিল এমনটাই চাউর হয়ে গেল। প্রায় ২০ বছর ধরে এই গোপন টানেলসদৃশ বাঙ্কারগুলো নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা করেছেন গোনিক। অন্তত তার দাবি সেটাই। তার কথা ফেলা গেল না। সঙ্গত কারণেই তার মেট্রো-২ বিষয়টি দাঁড়াল এক ‘অতি গোপনীয়তা’ জনসমুখে ফাঁস করে দেওয়া। লেখকের মতে তিনি মস্কোর গহিনে লুকানো এই টানেলগুলো নিয়ে কাজ করেছেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। এই বাঙ্কারগুলো নিয়ে তিনি বহু গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তথ্যগুলোর বেশিরভাগই এতটাই গোপনীয় ছিল যা বৃহত্তর স্বার্থে তিনি শেষ অবধি আর প্রকাশ করেননি। কিন্তু ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো। অনেক দেরিতে হলেও এই টানেলগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত পাওয়া গেছে সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চপদস্থ সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের বক্তব্যে। কেউ কেউ প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তিও দিলেন। আসলে মেট্রো ২ কী? প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর আছে। খুব সহজভাবে জানার চেষ্টা করলে, এটি মূলত ক্রেমলিনের মাটির নিচে দিয়ে ছড়িয়ে থাকা গোপন টানেল। এ ধরনের টানেল দিয়ে ভারী মালামাল টেনে নেওয়া যায়। এজন্য রয়েছে রেললাইন। তবে পার্থক্য হলো ক্রেমলিনের টানেলগুলো অনেকটাই বাঙ্কারের মতো তৈরি। এখানে যোগাযোগ ছাড়াও বোমাবর্ষণের আঘাত সহ্য করার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটাই প্রধান। একটি নকশায় দেখা যায়,  ক্রেমলিন থেকে শুরু হওয়া এই টানেলগুলো মাটির নিচে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার গভীরে। তাদের তূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ছিল। ধারণা করা হয়, পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলে রাজনৈতিক ও সামরিক উচ্চপদস্থদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও তিনটি সুড় খোঁড়া ছিল। এগুলো  ক্রেমলিনের সঙ্গে সরকারি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন ছিল। মানচিত্রে দেখা যায়, প্রথম লাইনটি সবচেয়ে বেশি লম্বা ছিল। মস্কোর দক্ষিণে ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সামরিক বাহিনীর প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত। শীর্ষ সামরিক পদাধিকারী ও মন্ত্রীদের জন্য নির্মিত ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার পর্যন্ত। দ্বিতীয় লাইনটি ছিল মস্কোর দক্ষিণে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রকেট প্রতিরোধী ব্যবস্থার সদর দফতর পর্যন্ত।  তৃতীয় লাইনটি ছিল মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ভানুকোভা বিমানবন্দরের টার্মিনাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সুনির্দিষ্টভাবে ক্রেমলিনের বুক চিরে ছড়িয়ে থাকা গোপন টানেলগুলোর বিষয়ে তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু হয়। অনুসন্ধানী আমেরিকার মিডিয়াও এটি নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। ততদিনে সত্তর দশকের রাশিয়ার গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানও এই টানেলগুলোর বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কেজিবি নিজেই এই গোপন বাঙ্কারগুলো সরকারি সহায়তায় নির্মাণ করেছেন এমনটি দাবি করা হয়। সেই বাঙ্কারগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন অনেকে দাবি করেন সেখাকে ১৫ হাজার অথবা ২০ হাজার মানুষ অনায়াসে বসবাস করতে পারতেন। ক্রেমলিনের ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস এটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ারফিটে বাঙ্কার অত্যন্ত মজবুত ছিল। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে আরেকটি গবেষণায়। সেবারই জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের খেলা কখনোই হয়তো শেষ হওয়ার নয়। সেটি ভেবেই পারমাণবিক বোমা হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মতো বোকামিতে নেই রাশিয়া। সোভিয়েত যুগেই বিশ্ববাসী জেনেছে যুদ্ধ কতটা সহিংস ও নিমর্ম হতে পারে। বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার পৃথিবীবাসীকে হতবাক করেছিল। সেটি থেকে শিক্ষা নিয়েই এই বাঙ্কার নির্মাণের পরিকল্পনা ও গোপন বাস্তবায়ন। মেট্রো-২ ক্রেমলিনের বুকে লুকিয়ে ছিল। এমনই আরেকগুচ্ছ টানেলের দেখা মেলে মস্কোর কাছে রামেনকিতে। সেদিকে ছিল মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বেশ কয়েকটি দালানের নিচে গিয়ে থামে কয়েকটি টানেলের পথ। বিজ্ঞান বিভাগের সেই কক্ষগুলোর মেঝে খুঁড়ে নিচে নামলেই পাওয়া যেত সেই টানেলে প্রবেশের পথ। প্রায় ৬০০ ফুট গভীরে নেমে যাওয়া সম্ভব হতো বলে দাবি করেন কিছু গবেষক। এখানে গোপনীয় তথ্য জমা রাখা ও বিপদে সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এটার আয়তন দেখে অনুমান করা হয় এখানেও ১৫ হাজার মানুষ পারমাণবিক বোমা হামলায় নিরাপদ থাকতে সক্ষম। এটা দেখে অনেকে বলেছেন, এটি মাটির নিচে আস্ত এক শহর। মাটির নিচে এই টানেল বাঙ্কারের ব্যবস্থাগুলো সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের নিরাপত্তা ও পারমাণবিক বোমা হামলা ঠেকানোর জন্য। কিন্তু এটি নিয়ে বিস্তারিত কাজ করা সম্ভব হয়নি এখনো। যারা বিষয়গুলো নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন তারা সূত্র নিশ্চিত করতে পারেননি। অনেকে নাম পরিচয় গোপন রেখেছন। তাই টানেলগুলোর প্রকৃত অবস্থান, অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে। ক্রেমলিনের গোপন টানেলে আজও এক বড় রহস্য।

সর্বশেষ খবর