বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডক কাহিনী

তানভীর আহমেদ

মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডক কাহিনী

৮৪ বছরে এসে চতুর্থ বিয়ে করেন মারডক। এবার পাত্রী অভিনেত্রী- মডেল ৫৯ বছরের জেরি হল।

রুপার্ট মারডক একজন মিডিয়া ব্যবসায়ী। ‘নিউজ করপোরেশন’-এর মালিক তিনি। বিশ্বব্যাপী কয়েকশ পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল রয়েছে তার। দৈনিক পত্রিকা, ট্যাবলয়েড, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল, চলচ্চিত্র, বই প্রকাশনা, শেয়ার ব্যবসা কোথায় নেই তিনি? মিডিয়া বাণিজ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া তার দখলে। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিকানাও তার। তার প্রকাশিত খবরেই নড়ে ওঠে গোটা বিশ্ব। কয়েকটি দেশে তার প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক চালে সরকার বদল হয়, যুদ্ধ বাধে। সে কারণেই রুপার্ট মারডককে মিডিয়া সাম্রাজ্যের বাদশাহ মানা হয়। সম্প্রতি চতুর্থ বিয়ে করে হঠাৎই বিশ্বব্যাপী আলোচনায় চলে আসেন। বর্তমানে নিউজ করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ও টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্সের এক্সিকিউটিভ কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ৮৪ বছর বয়সী এই মিডিয়া মুঘলকে নিয়ে আজকের রকমারি—

 

 

 

ব্যক্তিজীবনে যত কেলেঙ্কারি

সবারই একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে। সে তিনি সাধারণ দিনমজুর হোক বা হোক বিশ্ব মিডিয়ার বাদশাহখ্যাত রুপার্ট মারডক। আর এটা সহজেই অনুমেয় তাকে নিয়ে মুখরোচক খবর বেরোলে সেটা বাতাসের আগে ছুটবে। তবে বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর মালিক তিনি। তাকে নিয়ে কটুকথা বাজারে ছড়ানো একপ্রকার দুঃসাধ্য। অবশ্য এই উন্মুক্ত তথ্যের যুগে কেলেঙ্কারি ঢেকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সে কারণেই কেলেঙ্কারিতে জড়ানো মারডক বারবার শিরোনাম হয়েছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েন ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারিতে। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যক্তিদের ফোনকল হ্যাকিং করাসহ বিভিন্ন সময় ফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগে তুলাধোনা করা হয় তাকে। এই অভিযোগে একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পার্লামেন্টে জেরার মুখোমুখি হতে হয় রুপার্ট মারডককে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলে। হ্যাকিং কেলেঙ্কারি সম্পর্কে জেমসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়াও এ ঘটনায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয় তদন্তে। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে রুপার্ট মারডক নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। ১৬৮ বছরের পুরনো ট্যাবলয়েড হারিয়ে যায় এই কেলেঙ্কারির কারণে। দেশে শীর্ষ পত্রিকাগুলোয় এক পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষমা চান রুপার্ট মারডক। ব্রিটেনের সাতটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে আড়িপাতা কেলেঙ্কারির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন নিউজ ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুপার্ট মারডক। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড গুরুতর অপরাধ করেছে স্বীকার করেন তিনি। মারডক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, যে গুরুতর অনৈতিক ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমরা দুঃখিত। আমাদের কর্মকাণ্ডে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সে জন্য আমরা তাদের কাছে গভীরভাবে দুঃখিত।

প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি বলেন, প্যারিস হামলার জন্য মুসলমানরা দায়ী। তার এই বিতর্কিত মন্তব্যে বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

প্যারিসে কথিত হামলার তিন দিন পর ব্যাপকভাবে বিতর্কিত এ মিডিয়াব্যক্তিত্ব তার টুইটার অ্যাকাউন্টে এ মন্তব্য করে কার্যত ফেঁসে যান। তার মন্তব্যে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন সবাই। পরে অবশ্য তিনি মানুষের ক্ষোভের কাছে পরাজিত হয়ে এই বিতর্কিত মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেন। শুধু মুসলমানদের দায়ী করা নয়, তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বলে দাবি করেন। এটাই শেষ নয়। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও ছেড়ে কথা বলেননি। এই মিডিয়া মুঘল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা খাঁটি কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নন। এক টুইটার বার্তায় এ কথা বলে মার্কিন দুনিয়ায় তোলপাড় তোলেন। তবে এই বেফাঁস কথা বলেও টিকতে পারেননি। বিতর্কিত সেই টুইটের জন্য ক্ষমা চান মারডক। মূলত রিপাবলিকান প্রার্থী বেন কারসনের সমর্থনেই তিনি এই টুইট করেছিলেন। এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বের টুইট ১৩ হাজারেরও বেশি রিটুইট হয় এবং ১২ হাজার টুইটেই তার প্রতি সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেষে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি আরেকটি টুইট করেন। সেখানে বলেন, ক্ষমাপ্রার্থী, কোনোরকম ছোট করার উদ্দেশ্যে নয়। ব্যক্তিগতভাবে তারা দুজনই বেশ চমৎকার।

বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগ হয়ে গেছে রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য নিউজ করপোরেশন। কোম্পানিটির বিনোদন ও প্রকাশনা বিভাগ দুটি এখন আলাদা কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। বিনোদন বিভাগে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে একটি হলিউড স্টুডিও এবং ফক্স ব্র্যান্ডের টিভি চ্যানেলগুলো। ‘২১ সেঞ্চুরি ফক্স’ নামে চলছে এটি। অন্যদিকে প্রকাশনা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দ্য সান, টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউইয়র্ক পোস্ট। এগুলো চলছে নিউজ করপোরেশন নামেই।

 

বিশ্ব মিডিয়ার শাহেনশাহ

মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের সবচেয়ে বড় পরিচয় দেশে দেশে তার মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল ও শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো। অর্থবিত্তে তিনি শীর্ষ ধনীদের কাতারে। তবে খবরের যুগে খবরের সাম্রাজ্যে তার সমকক্ষ কেউ নেই। মারডকের কোম্পানির মালিকানায় আছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফক্স নিউজ চ্যানেল, দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট এবং দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। যুক্তরাজ্যে রয়েছে স্কাই নিউজ, দ্য সান এবং টাইমস। ইউরোপের দিকে তাকালেও মারডক রাজত্ব। ইতালির স্কাই ইতালিয়া তার হাতে রয়েছে। ২০১০ সালে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মিডিয়া ব্যবসায় ঢোকার অনুমতি পেয়ে যান। তারপর সেটি খুব ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নিউজ করপোরেশন সেখানে ডালপালা ছড়িয়ে বসে। এশিয়াতেও মারডক প্রভাব বজায় রেখেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি স্টার টিভি কিনে ফেলেন। ১ বিলিয়ন মূল্যের এই ব্যবসা দিয়ে এশিয়াতে তার রাজত্বে খুঁটি গাড়েন। ভারত, চীন ও জাপানের টেলিভিশন মিডিয়া ধীরে ধীরে নিজের মালিকানায় নিয়ে বসেন তিনি। এ ছাড়া সারা বিশ্বের বিনোদন ব্যবসায়ও তার বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করা আছে। চলচ্চিত্র, বই প্রকাশনা, সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় তিনি অঢেল মূলধন দিয়ে আজকের এই মিডিয়া সাম্রাজ্য নিজের করে ফেলেছেন। এই মিডিয়া মুঘলের জন্ম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। মারডক স্যার কিথ মারডক ও এলিজাবেথ জয়ের একমাত্র সন্তান। অর্থবিত্তের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন। তার পরিবারও ধনী ছিল। সম্পদের উৎস সংবাদপত্র ব্যবসা। তবে পত্রিকা ব্যবসার আগে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি করে দেন মারডক দম্পতি। রুপার্টের যখন ২১ বছর তখন তিনি বাবাকে হারান। সঙ্গত কারণেই এরপর তার উপার্জনের জন্য মন দিতে হয়। ১৯৫৩ সালের কথা। এডেলেইডের একটি সংবাদপত্র দিয়ে শুরু হলো তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন। তখনও কেউ ভাবতে পারেনি একদিন পুরো বিশ্ব দখল নেবেন তিনি। ভিত্তি মজবুত হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ার আরও দুটি সংবাদপত্রের মালিকানা কিনে নিল তার কোম্পানি নিউজ লিমিটেড। ১৯৭২ সালে মারডক সিডনির সকাল বেলার ট্যাবলয়েড দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কিনে নিলেন স্যার ফ্রাংক প্যাকারের কাছ থেকে। এটি একটি মাইলফলক ছিল তার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রে মারডক প্রথম টেলিভিশন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন ১৯৮৬ সালে। বর্তমানে তার ব্যবসার প্রসার ঘটে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায়।

 

বিশ্বরাজনীতিতে ‘মারডক ফ্যাক্টর’

রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝা মুশকিল। সাধারণ মানুষের কানে রাজনীতি নিয়ে যে খবরগুলো আসে তার বেশিরভাগই টেলিভিশন বা পত্রিকা মারফত। রুপার্ট মারডকের দুটিই হাতে আছে। তাই রাজনীতিবিদদের ব্যক্তি ইমেজ থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণা অনেকটাই মারডকের অদৃশ্য ইশারার ওপর নির্ভর করে। এটা যেন ওপেন সিক্রেট একটি বিষয়। তাই বিশ্বরাজনীতিতে মারডক-ফ্যাক্টর সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। রুপার্ট মারডককে নিয়ে কানকথার শেষ নেই। এই ফিসফাঁস কথার ভিত্তি একেবারেই ভঙ্গুর নয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র আর অস্ট্রেলিয়া সরকারের পালাবদলে রাজনৈতিক হাওয়া বদলে রুপার্ট মারডকের ভূমিকা গত কয়েক দশক ধরেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে পছন্দের প্রার্থীর জয়গান করে জনমানুষের কাছে হিরো করে তোলার পাশাপাশি নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ডুবিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্রোতগুলোর সঙ্গে মিশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের ভূমিকা। আর সেখানে অস্ট্রেলিয়াসহ এই দুটি দেশের রাজনীতিতে মারডকের এই পরোক্ষ কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব এড়িয়ে গেলে ভুলই হবে। ফক্স নিউজ, স্কাই নিউজ, স্টার গ্রুপসহ পুরো দুনিয়ায় তার মালিকানাধীন তিনশরও বেশি টিভি চ্যানেল রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দুইশর মতো পত্রিকা। মারডক প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেননি। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করায় তার ছিল আগ্রহ সব সময়ই। সব দলের রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে তার। মারডক নিজে রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন।

 

যেভাবে মারডক সাম্রাজ্যে ফাটল

২০১৩ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিন ধনী আমেরিকানদের তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে ৩৩ নম্বরে ছিল মারডকের নাম। অন্যদিকে বিশ্বসেরা ধনীদের তালিকায় তিনি ৯১ নম্বরে। বিষয়টি নজর এড়ায়নি অনেকের। এত প্রভাবশালী এই মিডিয়া মুঘলের অবস্থান নিয়ে খটকা লাগায় অনুসন্ধান চালায় বিশ্লেষকরা। আর তাতে বেরিয়ে আসে মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যের ফাটলগুলো। ইতিমধ্যে দেশে দেশে মিডিয়াবাজিতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছেন তিনি। আর ইমেজ নষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের পতন। ১৬৮ বছরের পুরনো ট্যাবলয়েড। প্রতাপের সঙ্গে প্রকাশনা চালিয়েছে এটি। কিন্তু ‘থ্যাংক ইউ অ্যান্ড গুডবাই’ জানিয়ে পাঠকদের বিদায় জানাতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় এটি। রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যে সবচেয়ে আলোচিত পতন। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকের টেলিফোনে আড়িপাতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে পত্রিকাটির শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত পত্রিকাটির শেষ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংখ্যার প্রচ্ছদ দিয়ে। এর প্রচ্ছদে লেখা ছিল— ‘১৬৮ বছর পর আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ৭৫ লাখ পাঠকের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। তবে এ বিদায় গর্বেরও।’ শিরোনাম ছিল ‘থ্যাংক ইউ অ্যান্ড গুডবাই’। সে সংখ্যায় এক পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা সম্পাদকীয়তে ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলা হয়েছে, ‘বাস্তবতা হলো আমরা লড়াইয়ে হেরে গেছি।’ পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যাটি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ ছাপা হয়। প্রথম সংস্করণের কপি বিক্রি ছিল জমজমাট। লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে এক হকার জানায়, ‘প্রথম পাঁচ মিনিটে ৫০ কপি বিক্রি হয়েছে।’ মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডক এ পত্রিকাটি অপরাধ আর যৌনবিষয়ক খবর প্রচার করে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পান। হিসাব কষে দেখা যায়, ছয় কোটি মানুষের যুক্তরাজ্যে প্রতি রবিবার নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের প্রচার সংখ্যা ছিল ৭৪ লাখ।

 

চার বিয়ে কাণ্ড

মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের বয়স এখন ৮৪। তাই বলে বয়সের ভারে সংসার থেকে পিছুটার দিয়েছেন এমনটা ভাবলে ভুল হবে। সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন অভিনত্রী-মডেল জেরি হল। জেরি হলের বয়স (৫৯। তাদের বিয়েতে হল মহাধুমধাম। ধনকুবেরের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন রাজনীতিবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন পর্যায়ে সুপরিচিত তারকারা। লন্ডনে স্পেন্সার হাউসে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রুপার্ট-জেরি। এ সময় তার হাতে ছিল ২০ লাখ পাউন্ডের আংটি, পরনে ছিল নীল পোশাক। এগুলো রুপার্ট মারডক তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। দুজনের বয়সের ফারাক ২৫ বছরের হলেও এক বছর চুটিয়ে প্রেম শেষে তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এবারই প্রথম বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তার প্রথম স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার প্যাট্রিসিয়া বুকার। সে ছিল মেলবোর্নের এক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট। প্যাট্রিসিয়া তারও আগে কাজ করতেন এক দোকানে শপ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। তার সঙ্গে দশ বছর সংসার করার পর বিচ্ছেদ ঘটান মারডক। তারপর ধরেন দ্বিতীয় বিয়ের পথ। এবার বিয়ে করেন আনা টোর্বকে। আনা টোর্ব সাংবাদিকতা করতেন। ১৯৬৭ সালে টোর্বকে বিয়ের পরই মূলত মারডকের নাম-খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। দ্য টেলিগ্রাফের সেই সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের বিয়ে টিকেছিল ৩০ বছর। কিন্তু মানসিক দূরত্বের কারণে আর সংসার করা হয়নি। দ্বিতীয় স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে মারডক খরচ করেন ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল বিবাহ বিচ্ছেদের একটি। লোকজন তখন মারডককে নিয়ে মুখোরচক কথা বলছে। তবে তাদের কথায় কান না দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ বিচ্ছেদের মাত্র ১৭ দিন যেতে না যেতেই করেন তৃতীয় বিয়ে। ১৯৯৯ সালে মারডকের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি ওয়েনডি ডেংকে বিয়ে করেন। ওয়েনডি ডেং ছিল মারডকের চেয়ে ৩৮ বছরের ছোট। তার স্ত্রী চীনা বংশোদ্ভূত ওয়েনডি ডেংয়ের সঙ্গে  সংসার এক যুগ পেরোতেই আবার বিবাহ বিচ্ছেদ করেন মারডক। ২০১৩ সালে তৃতীয় স্ত্রী ওয়েনডি ডেংয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর তিন বছর প্রেম করেন জেরি হলের সঙ্গে। অবশেষে এ বছর করেন চতুর্থ বিয়ে। মারডকের চার বিয়ে সূত্রে সন্তান রয়েছে মোট ছয়জন। তার ছেলে জেমস মারডক বর্তমানে টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

 

মারডকের বিলাসী জীবন

সুপারইয়াট ভার্টিগো। ইন্টারনেটের বদৌলতে অনেকেই এই গুজবের সঙ্গে পরিচিত যে, ভার্টিগোতে করে ঘুরে বেড়ান মারডক। অনেকে আবার বলে বসেন এটির মালিকানাও তার। এ নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হলে শেষ পর্যন্ত রহস্যই থেকে গেছে কারণ নিউজিল্যান্ডের তৈরি এই সুপারইয়াট কর্তৃপক্ষ বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত কেউ এটি কিনছে বা ভাড়া না নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এটি মারডকেরই! সুপারইয়াটটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল  বিলাসবহুল বলে দাবি করা হয়। এ তো ইয়াটের কথা। নিউইয়র্কের পেন্ট হাউসে রুপার্ট মারডকের একটি বাড়ির দাম ওঠে ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাড়ি, গাড়ি আর বিমানের বহর দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, টাকা কোনো বিষয় নয় তার কাছে। ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অঢেল পরিমাণ সম্পদের হিসাবটা শুধু টাকার অঙ্ক নয়। এই টাকার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সব মিডিয়া ব্যবসা। তাই টাকার অঙ্কে বিশ্বসেরা ধনী না হলেও টাকার ক্ষমতায় তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যান। এই টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন তিনি। শুধু তার চাহিদামতোই বানানো হয় গাড়ি। মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, রোলস রয়েস সবই রয়েছে তার। এ ছাড়া রয়েছে ব্যক্তিগত ইয়ট। সেখানে সুইমিংপুল, সুপ্রশস্ত ডাইনিং সবই রয়েছে। তবে বিজনেস ইনসাইডে তার ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে বেশ বড় প্রতিবেদন ছাপা হয়। তার ব্যক্তিগত জেট বিমান রয়েছে দুটি। গালফস্ট্রিম ৫৫০, এসআর ২২। এই গালফস্ট্রিম অন্য যে কেনো স্ট্রিমের তুলনায় ব্যতিক্রম। বর্তমান বিশ্বের স্টাইলিশ এবং নান্দনিকতাময় বিজনেস জেট এটি। এ বিজনেস জেটটির গতি এবং কার্যক্ষমতা এতটাই যে, অনায়াসে নিউইয়র্ক থেকে টোকিও ভ্রমণ করা যায়। তার আরেকটি ব্যক্তিগত জেট বোয়িংয়ের বিজনেস প্রাইভেট জেট ৭৩৭। বর্তমানে জেটটির বাজারমূল্য ৬২ মিলিয়ন ডলার। এই জেটটি মারডক এখনো ব্যক্তিগত কাজেই ব্যবহার করে থাকেন।

সর্বশেষ খবর