শিরোনাম
বুধবার, ১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
ভারত থেকে নিখোঁজ সনুকে ফেরত দিতে বাংলাদেশি জামাল ইবনে মুসার বিস্ময়কর লড়াই

বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান

রণক ইকরাম

বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান

গতকাল যশোরের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে অভিরূপ সনু সিং। বাঁয়ের ছবিতে মায়ের পাঠানো টি-শার্ট পরে ফুটবল খেলছে। ডানের ছবিতে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে। যশোর থেকে ছবিগুলো তুলে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধি শফিউল ইসলাম সজল

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে বাংলাদেশের বরগুনায় পাচার হয়ে আসে ছোট্ট সনু। এখানে আসার পর থেকে পাঁচ-ছয় বছরে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেই শিশুটিকে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নয়াদিল্লিতে সনুর বাবা-মাকে খুঁজে বের করেছেন। ছুটে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও। এতসব করে মানবিকতার অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন বরগুনার জামাল ইবনে মুসা। ইতিমধ্যে ভারত-বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলিউডের সেই দর্শকনন্দিত সিনেমার নায়ক ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ আখ্যা পেয়েছেন তিনি। ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ সিনেমায় এর নায়ক সালমান খান পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুকে চরম প্রতিকূলতা পেরিয়ে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের বিশেষ আয়োজন।

 

 

জামাল ইবনে মুসার

ভাইজান হয়ে ওঠা

মানুষের জীবনের ঘটনা কখনো কখনো হার মানায় সিনেমার গল্পকেও। বলিউডের সাড়া জাগানো ছবি ‘বজরঙ্গি ভাইজানের’ গল্প কিন্তু সত্যি ঘটনা থেকেই নেওয়া। এমনই আরেকটি ঘটনার জন্ম দিয়ে সমগ্র ভারত কাঁপিয়ে এসেছেন বাংলাদেশি জামাল ইবনে মুসা। বাস্তবে হারিয়ে যাওয়া সনু সিংকে ভারতীয় বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিতে সিনেমার সালমান খানের থেকেও বেশি কষ্ট, যন্ত্রণা ও হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের জামাল ইবনে মুসাকে। মামলার শিকার হওয়া, কারা জীবনযাপন ও চাকরি হারানোর পরও থেমে থাকেননি মুসা। সম্প্রতি ভারতে গিয়ে দেখা করেছেন সনুর বাবা-মার সঙ্গে। মুসা দেখা করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও। সব মিলিয়ে মুসার চার বছরের কষ্ট এখন অনেকটাই সফল হওয়ার পথে। জামাল ইবনে মুসার এই কষ্টকর অভিযাত্রাকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দারুণ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হচ্ছে। মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করা এই মানুষটিকে বহুল আলোচিত ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘বজরঙ্গি ভাইজান’র প্রেরণায় ডাকা হচ্ছে ‘বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান’। এই নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় চালু হয়েছে একটি ট্রেন্ডও। মুসাকে নিয়ে ভারতজুড়ে চলছে তোলপাড়।


‘‘    আমি নিজেও জানতাম বিষয়টি সহজ নয়। প্রথম দিকে আগ্রহ আর মানবিক কারণেই এর সঙ্গে যুক্ত হই। পরবর্তীতে যখন জেল খাটলাম চাকরিচ্যুত হলাম তখন বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নিল। আমিও হাল ছাড়তে চাইনি। সনু যখন দিল্লিতে দিলশাদ গার্ডেনের কথা জানাল, আমি তখনই সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখনো আমি একেবারেই আশা করিনি যে, সত্যি সত্যি সনুর বাবা-মাকে খুঁজে পাব। কিন্তু মনে মনে কেবল ভেবেছি, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? যদি অবুঝ শিশুটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! এগুলো ভাবলেই আমার ঘুম আসত না। আমি কোনো মতেই হাল ছাড়তে চাইনি। প্রথম দিকে পরিবারের অনেকেই সহায়তা করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি এর শেষ দেখতে চেয়েছি। মানুষ আমাকে পাগল বলেছে। আমি থেমে যাইনি। দীর্ঘ চার বছর ধরে যে প্রচেষ্টা আমি চালিয়ে গেছি তার ফল এভাবে পাব ভাবিনি। দিল্লিতে সনুর মা-বাবার মুখ দেখে আমি আমার সব কষ্ট ভুলে গেছি। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সব কর্মকর্তার সহযোগিতায় আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে আমার মিনতি যাতে দ্রুত সনু তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা যেন সবাই করেন। আর পাচারকারীরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে। আর এ ঘটনার জন্য আমার এবং আমার পরিবারের নামে যেসব মিথ্যা মামলা হয়েছে তা থেকে যাতে আমি পরিত্রাণ পাই। এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই।’’

জামাল ইবনে মুসা

 

সনু যেভাবে বাংলাদেশে...

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির দিলশাদ গার্ডেনে নিউ সীমাপুর যুগ্গি এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা মেহবুব মাহমুদ ও মাধুরী মমতাজ। মেহবুব সাধারণ একজন গ্যারেজ মেকানিক্স। তাদের পরিবারে এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশি রহিমা খাতুন। সেখানে আশ্রয় পাওয়া এক সপ্তাহের মধ্যে সনুকে ২০১০ সালের ২৩ মে অপহরণ করা হয়। দিল্লি থেকে অপহরণ করে রহিমা বেগম ও আকলিমা বেগম নামের দুই বোন বাংলাদেশের বরগুনায় নিয়ে আসেন। মহিলা ও সনু একসঙ্গে নিখোঁজ হওয়ার পর সনুর বাবা-মা দিশাহারা হয়ে পড়লেন। বুঝতে পারলেন অপহৃত হয়েছে সনু। এর কিছুদিন পর এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে রহিমা ও তার বোন। সনুর খালার কাছ থেকে ধার করে সেই টাকাও এদের দিয়েছিলেন সনুর মা মাধুরী মমতাজ। কিন্তু এরপরও এরা সনুকে ফেরত দেয়নি। সনুকে মেরে ফেলে সে জন্য আর বাড়াবাড়িও করেনি। এখন যখন সনু নিরাপদ, তখন অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে ফোনালাপে রহিমা ও তার বোনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

 

সাধারণ একজন মুসা...

জামাল ইবনে মুসাকে দেখলে মনেই হবে না এই লোকটি এমন লড়াকু, এমন দুর্ভোগের মধ্যেও একটি শিশুকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্রোতের প্রতিকূলে এগিয়ে চলেছেন নিরন্তর। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই সাদামাটা মানুষটির বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে। এই গ্রামেরই একটি পরিবারের ভারত যাওয়া-আসা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। অনেকে সন্দেহও করত। কিন্তু এই পরিবারের প্রভাব ও তাদের খারাপ আচরণের কারণে কেউ কিছু জানতে চাইত না। ওই পরিবারের বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলেই তার ওপর নেমে আসে মামলা-হামলার খড়গ। ২০১০ সালের দিকে ওই বাড়িতে ছয় বছর বয়সী অপরিচিত একটি শিশুকে দেখতে পায় এলাকাবাসী। হঠাৎ করে এই কাজের ছেলে কোত্থেকে এলো সেটি নিয়ে কেউ কখনো ভাবেনি। কিন্তু অপরিচিত সেই শিশুটির ওপর নেমে আসা নানা অমানবিক নির্যাতন অনেককেই নাড়া দিয়ে গেল। সহজ-সাধারণ নরম হৃদয়ের মানুষ মুসা এই বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইতেই ওই পরিবার তার ওপর চড়াও হলো। বছর পাঁচেক আগে স্থানীয় এক সাংবাদিক নিয়ে মুসা ওই শিশুটিকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার ছেলেটিকে লুকিয়ে ফেলা হয়। এরপর আর বড় কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি মুসা। একপর্যায়ে জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা কমে এলে জামাল অভিরূপ সনুর ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। কিছু তথ্যও আসে তার হাতে। অনেকের কাছে গেলেও কেউই বিষয়টি নিয়ে কিছু করার আগ্রহ দেখায়নি। এর মধ্যেই ওই পরিবারের রোষানলে পড়েন জামাল ইবনে মুসা। একের পর এক মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে গত পাঁচ বছরে নিজের সন্তান, পরিবার-পরিজনসহ একাধিকবার জেল খাটেন জামাল ইবনে মুসা। হারিয়েছেন রিয়েল এস্টেট কোম্পানির চাকরিও। এক নিষ্পাপ শিশুকে রক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ মুসাকে জেল খাটিয়ে অপরাধী বানিয়ে ছেড়েছে পাচারকারী চক্র।

 

রহস্যময় সেই পরিবার...

গেরামর্দন গ্রামে জামাল ইবনে মুসার বাড়ি থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে মরহুম নূর হোসেনের মেয়ে হাসি বেগমের বাড়ি। চল্লিশোর্ধ্ব হাসি বেগমের আরও ছয় বোন রয়েছে। তিনিই সবার প্রধান। এই সাত বোন প্রায়ই ভারতের দিল্লি যাওয়া-আসা করেন। দিল্লি গেলে সীমাপুর এলাকায় তাদের আনাগোনা বেশি। জামাল ইবনে মুসা ও সেখানকার স্থানীয় একাধিক অধিবাসী অভিযোগ করেন, হাসি ও তার ছয় বোন সবাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশে মানব পাচারসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা করে আসছে। হাসির বোন রহিমা যে কিনা সনুকে পাচার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে তার স্বামী মিরাজও একই ধরনের অভিযোগ করেন। এমনকি তাকে জোর করে বিয়ে করার অভিযোগও করেন মিরাজ। এ বিষয়ে হাসি বেগমের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, দিল্লিতে তারা বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। তবে রহিমার স্বামী মিরাজের মতো তাদের আরেক বোন আকলিমার স্বামী জাহাঙ্গীর, হাসির স্বামী ইসলামও তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা আছে বলে স্বীকার করেন। কিন্তু এরা সবাই নিজেদের পরিস্থিতির শিকার বলে দাবি করেন।

 

পালানোর পর  সেফহোমে...

দিল্লি থেকে অপহৃত হওয়ার পর রহিমা ও আকলিমার সঙ্গে বরগুনা গেরামর্দন গ্রামে থাকতে হয় সনুকে। কাজের ছেলে হিসেবে রাজ্যের সব কাজ করানো হতো তাকে দিয়ে। অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। একবার গোবরের ঝুড়ি মাথা থেকে পড়ে গিয়েছিল। এর শাস্তি হিসেবে শিশু সনুকে গোবর গিলতে বাধ্য করেছিল ওরা। দেশ ও বাবা-মা ছেড়ে এমন নির্যাতনের মুখে কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সনু। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এর মধ্যেই গত বছর সনু তৃতীয়বারের মতো রহিমাদের কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করে। এবারের চেষ্টাও হয়তো ব্যর্থ হতো। তবে এবার সনু জামাল ইবনে মুসার হাতে পড়ল। মুসা নিজ দায়িত্বে ঢাকা নিয়ে আসেন তাকে। মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা করেন সনুকে ভারতে ফেরত পাঠাতে।

এর মধ্যেই বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের পরামর্শে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বরগুনা সমাজসেবা কার্যালয়ের স্থানীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বরগুনার আদালতে হাজির করা হয় অভিরূপ সনুকে। আদালত সনুকে যশোরের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। বর্তমানে সনু সেখানেই রয়েছে।

এই সময়ে মুসা পুলিশের সহযোগিতা নিতে গেলে পুলিশ উল্টো সনুকে অপহরণের দায়ে মুসাকেই গ্রেফতার করে। তবে আদালত ও পুলিশের মধ্যস্থতায় ওই সময় সমস্যার সাময়িক সমাধান হয়। তবে এর বিপরীতে রহিমা ও আকলিমার পরিবারের সদস্যরা মুসার বিরুদ্ধে ৪টি মিথ্যা মামলা করে। ওই সময়ের দুর্দশা ও হয়রানির কথা জানান মুসা। মিথ্যা মামলার কারণে তার পরিবারের ওপর নেমে এসেছে বিপর্যয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি খুইয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। দুই দফায় জেল খেটেছেন ৪১ দিনেরও বেশি। সনুকে সহযোগিতা করতে গিয়ে মুসার ছেলে ফেরদৌস ও শ্যালক নান্নাকেও কারাগারে যেতে হয়েছে।

 

ধারের টাকায় দিল্লির পথে

অভিরূপ সনুকে যশোরের সেফহোমে রেখেও থেমে থাকেননি মুসা। সনুকে জিজ্ঞেস করলেন তার পরিবারের কথা। তখনই সনু দিল্লির কথা বলে। বাবা-মার নাম জানতে চাইলে জানায় বাবা মেহবুব আর মা মাধুরী। আর এক ভাইয়ের কথা বললেও তার নাম বলতে পারেনি সনু। তবে বাবার এক চোখে এবং এক হাতে সমস্যার কথা অস্পষ্টভাবে জানাতে পেরেছিল। আর দিল্লির দিলশান গার্ডেনে বাবার গ্যারেজ থাকার কথাটিও সনুর বলা। শিশু সনু এবং হাসি বেগমের ছোট বোনের স্বামী জাহাঙ্গীরের দেওয়া অস্পষ্ট তথ্য পুঁজি করে দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মুসা। কিন্তু হাতে টাকা নেই। শ্যালক নান্না মিয়ার কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার করলেন। স্ত্রী নিরু বেগমসহ আত্মীয়রা সবাই মুসাকে পাগলামি না করতে অনুরোধ করল। কিন্তু মুসা শেষ চেষ্টা করতে চাইলেন। ধারের টাকায় রওনা করলেন কলকাতা।

 

কলকাতা-পাটনা হয়ে দিল্লি

প্রথমে কলকাতা গিয়ে পাটনায় গেলেন মুসা। সেখানে জাহাঙ্গীরের দেওয়া তথ্যানুসারে হাসি বেগম, রহিমা, ফাতেমাদের নামে ভারতীয় কোর্টে মামলার হদিস করতে উকিল ধর্মেন্দরের দ্বারস্থ হলেন। উকিল এদের মনে করতে পারলেন বটে, কিন্তু মামলার নম্বর ছাড়া নথি দেবেন কী করে? সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে দিল্লির দিকে এগোলেন। দিল্লি গিয়ে খোঁজ করতে থাকেন সনুর মা-বাবাকে। খোঁজ নিয়ে জানলেন দিলশান গার্ডেন নয়, দিল্লির সীমাপুর এলাকায় দিলশাদ গার্ডেন নামের একটা জায়গা রয়েছে। কিন্তু ভাষার সমস্যা ও বিস্তারিত তথ্য না জানার কারণে ঘুরতে হয়েছে প্রচুর। ওই এলাকায় দেড়শ বেশি গ্যারেজ আছে। সেখানেরই একটি গ্যারেজে সনুর বাবার পরিচিত একজনকে পেয়ে যান মুসা। সেখান থেকে সনুর বাবার গ্যারেজে পৌঁছান মুসা। এ সময় সনুর ছবি দেখালে কান্নায় ভেঙে পড়েন সনুর বাবা মেহবুব। এরপর মুসাকে সনুদের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুসার পা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সনুর মা মমতাজ বেগম। জামাল ইবনে মুসা জানান, দিল্লির নিউ সীমাপুর যুগ্গি জামে মসজিদের পাশে মেহমুদ পরিবারের বাড়ি। সনুর বাবা মেহবুব একটি মোটর গ্যারেজের শ্রমিক। জামাল জানান, ছেলের সন্ধান পেয়ে পরিবারটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।


‘মেরা বাচ্চা গুঙ্গা ভি নেহি, বেহরা ভি নেহি-তো উসে মুন্নি মাত কহো’

সনুর মা মমতাজ বেগম। বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। তার আগের নাম মাধুরী। বর্তমান বসবাস স্বামীর সঙ্গে দিল্লিতে। কিন্তু তার পিতৃস্থান কলকাতা। তিনি বাংলা জানেন। কথা বলেন হিন্দি বাংলার মিশেলে। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বারবার যখন বজরঙ্গি ভাইজানের প্রসঙ্গ আসে তখন কান্না-কান্না স্বরে প্রতিবাদ করেন মমতাজ। বলেন— ‘মেরা বাচ্চা গুঙ্গা ভি নেহি, বেহরা ভি নেহি, তো উসে মুন্নি মাত কহো। লেকিন মেরা সনুকো যিতনা জলদি হো মেরা পাস লেকে আও- মেরা বাচ্চা বহোত প্যারেসান হো রহে হ্যায়!’ বাংলা করলে মানে দাঁড়ায়- ‘আমার বাচ্চা তো বোবাকালা নয়, তাই ওকে বজরঙ্গি ভাইজানের মুন্নির সঙ্গে তুলনা করো না প্লিজ। কিন্তু সনুকে যত তাড়াতাড়ি পারো আমার কাছে নিয়ে এসো। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে!’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় সনুর মার দিল্লির ফোন নম্বরে। বাংলাদেশ থেকে বলতেই চমকে উঠলেন। সনুর খবর জিজ্ঞেস করলেন। জানালেন ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। এরই মধ্যে পাসপোর্ট করতে দিয়েছেন। সরকারি উদ্যোগে সনুকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটিতে সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে চান মমতাজ। বলেন, ‘আমার বহুত জালদ সনুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্লিজ ম্যারা বাচ্চা মেরে পাস লওটাদো।’ সনুর কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। আর সনুকে কিডন্যাপ করা রহিমাদের জোর শাস্তিও দাবি করেন।

 

সুষমা স্বরাজের আশ্বাস

সনুর বাসায় পৌঁছে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কাগজপত্রের খোঁজ শুরু করলেন মুসা। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়ায় কোনো জন্মসনদ নেই। পুরনো ছবি, এফআইআর এবং পত্রিকায় ছাপা হওয়া বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করলেন। স্থানীয় সংসদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। এরপর সোজা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরে। সেখানে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পাঁচ মিনিট দেখা করার অনুমতি মিলল। সঙ্গে ছিলেন সনুর মা, বাবা ও খালা। সুষমা স্বরাজ প্রথমে বিষয়টি শুনলেন এবং সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসকে খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ৫ মিনিটের আলাপ দেড় ঘণ্টায়ও শেষ হলো না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নির্দেশে ঢাকা থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি নিজে যশোরে গিয়ে সনুর সঙ্গে দেখা করেছেন। ২৪ মে একাধিক টুইটে সনুকে ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

 

মিষ্টি বিতরণ

সনুর খোঁজ পাওয়ার খবরে উদ্বেলিত তার বাবা-মা। দিলশাদ গার্ডেনের সরু কলোনির ভিতরে মেহবুব-মমতাজের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড় কদিন ধরেই উপচে পড়ছে। গত চার-পাঁচ দিন ধরে তাদের বাড়িতে এই উৎসবই চলছে। আর গৃহকর্তা মেহবুব নিজের সব কাজকর্ম লাটে তুলে বাড়িতে শুধু একের পর এক মিষ্টির বাক্স এনে চলেছেন। সবাইকে কেবল মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন।

 

বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাটি দেখেননি মুসা!

যে জামাল ইবনে মুসাকে বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান বলা হচ্ছে সেই মুসা কিন্তু বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাটি দেখেননি। এমনকি এর গল্পও ঠিক তার জানা ছিল না। তবে এখন তিনি শুনেছেন তার জীবনের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে। দিল্লিতে এই ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন তাকে এর ডিভিডি উপহার দিয়েছেন। তবে এখনো দেখার সুযোগ হয়নি। সুযোগ পেলেই ছবিটি দেখবেন বলে জানান মুসা। সবাই তাকে বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান বলছে এতে তার কোনো উচ্ছ্বাস নেই আবার আক্ষেপও নেই। তিনি কেবল সনুকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজে ও পরিবারকে মামলা থেকে নিষ্কৃতি দিতে চান।


সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায়

এদিকে বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান মুসাকে নিয়ে ভারতে চলছে তোলপাড়। টুইটারে বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজানকে নিয়ে ভারতে একাধিক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রশংসা পাচ্ছেন সুষমা স্বরাজ ও শাহরিয়ার আলম। হ্যাশট্যাগগুলোর মধ্যে রয়েছে, # JamalIBnamusa,  # BangladeshiBajrangi, # BangladeshiBhaijan এখন অপেক্ষা সনুর এবং তার বাবা মায়ের ডিএনএ-র নমুনা ম্যাচ করানোর। দুই পক্ষের কাছ থেকেই ডিএনএ সংগ্রহ করে তা এখন মিলিয়ে দেখা হবে সত্যিই মেহবুব ও মমতাজ সনুর বাবা-মা কিনা! এর পরই হয় তো চূড়ান্ত সাফল্য পাবেন জামাল ইবনে মুসা।

সর্বশেষ খবর