‘জিতবই’ প্রত্যয় ছিল তার স্টাইল। নিজের ওপর অনড় আস্থা রেখে লড়াইতে নামতেন তিনি। বলতেন, ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট।’ সেই গ্রেটেস্ট মোহাম্মদ আলীর মহাপ্রস্থান ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফোনিক্সের একটি হাসপাতালে (৩ জুন-২০১৬) ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন সাবেক বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী। তাকে নিয়েই আজকের রকমারি—
শতাব্দীর সেরা লড়াই
৮ মার্চ-১৯৭১। আমেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ার কারণে পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয় মোহাম্মদ আলীর। তিন বছর কারাভোগের পর তিনি ছাড়া পান। জেলে যাওয়ার আগে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন মোহাম্মদ আলী। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তাকে মোকাবিলা করতে হয় ফ্রেইজারকে। তাদের মধ্যকার এই লড়াইকে বক্সিং জগতে শতাব্দীর সেরা লড়াই বলে অভিহিত করা হয়। শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই ছিল সেটি। এর আগে বক্সিং রিংয়ে প্রত্যাবর্তন করে তিনি জেরি কোয়েরি এবং অসকার বোনাভেনাকে নক-আউট করে দেন। আর এর পরেই তার সামনে ছিলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জো ফ্রেইজার। ফ্রেইজার এবং আলীর মধ্যকার সেই লড়াইটি শুধু বক্সিং রিংয়ের লড়াইকে ছাড়িয়ে দুই ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী দুই ফাইটারের মধ্যে আদর্শের লড়াইয়ে পরিণত হয়ে যায়। মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আলী এবং ফ্রেইজারের মধ্যকার সেই লড়াই আমেরিকা এবং সাড়া বিশ্বে অগণিত দর্শক উপভোগ করেছিলেন। সেই লড়াইয়ে মোহাম্মদ আলী ফ্রেইজারের কাছে হেরে যান। এটি ছিল আলীর প্রথম পেশাদারি ম্যাচের হার। তবে ১৯৭৪ সালের ফিরতি লড়াইয়ে আবার শিরোপা নিজের করে নেন মোহাম্মদ আলী।
‘স্বয়ং ঈশ্বর এসেছিলেন চ্যাম্পিয়ন হতে। আলী ছিলেন মহান মুষ্টিযোদ্ধা...’
—মাইক টাইসন, আমেরিকান মুষ্টিযোদ্ধা
মোহাম্মদ আলীকে বলা হতো অপরাজেয়। সত্যিই তাই। তার জীবনে পরাজয় এসেছে খুব কম। শেষবারের মতো হারলেন পার্থিব জগতে; এর নাম পার্থিব মৃত্যু। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধার খেতাবটা তার নামের পাশেই মানায়। মোহাম্মদ আলী তার ‘মুষ্টিতে বোমার’ চমক দেখিয়ে গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছিলেন কয়েক যুগ। এই মুষ্টিযোদ্ধা বা বক্সারের পৃথিবীজুড়ে সহস্র কোটি ভক্ত রয়েছেন। তাকে কেন সর্বকালের সেরা বক্সার মানা হয়? তার কৌশল, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, শক্তিশালী মুষ্টির আঘাত ও বক্সিং রিংয়ে বার বার জয়ের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। বক্সিং রিংয়ের প্রতিটি ইঞ্চি যেন তিনি নিজে মন মতো ব্যবহার করতেন। তার শারীরিক ফিটনেসও ছিল বিস্ময় জাগানিয়া। তার ক্ষিপ্রতার প্রশংসা এখনো করা হয়। তিনি অনেকটা প্রজাপতির মতো বক্সিং রিংয়ে উড়ে বেড়াতেন আর চোখের নিমিষেই মৌমাছির মতো হুল ফুটিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্থ করতেন। এই উপমাগুলো লিখে বা পড়ে ঠিক বোঝানো যায় না। আসলে চোখের তৃপ্তি ও উত্তেজনা টের পেতে হলে সেটা দেখার বিকল্প নেই। মোহাম্মদ আলী নামটিই দর্শকদের কাছে এক মোহ। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েট বক্সিংয়ে সোনা জয়ের মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ আলী খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর পেশাদার মুষ্টিযুদ্ধে চলে যান আলী। ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ বলে খ্যাত এই মুষ্টিযোদ্ধা ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে মার্কিন মুষ্টিযোদ্ধা সনি লিসটনকে হারিয়ে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। প্রথম মার্কিন কোনো মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে তিনবার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন আলী। ৬১টি মুষ্টিযুদ্ধের ৫৬টিতেই জয় পান তিনি। এর মধ্যে ৩৭টিই ছিল নক-আউট মানে প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে ফেলা। ১৯৮১ সালে অবসর নেন মোহাম্মদ আলী। রিংয়ের বাইরে বুদ্ধিদীপ্ত কথার জন্য তিনি তার দীর্ঘ বক্সিং ক্যারিয়ারে সফলতা পান। কিন্তু মোহাম্মদ আলী বক্সিং রিংয়ে তার পারফরম্যান্সের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সচেতন উপস্থিতির কারণেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকান কালোদের পাশে ছিলেন সবসময়।
যেভাবে বক্সার হলেন
বক্সিং জগতের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি ছিলেন তিনি। এখনো তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ বিশেষণ। বক্সিং রিংয়ে মোহাম্মদ আলীর একক রাজত্ব বিশ্ববাসী বিস্ময়ভরা চোখে উপভোগ করত। সেখানে সাম্রাজ্য পাততে যে পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন তা বেশ কৌতূহল জাগানিয়া। বক্সিংয়ে নামার আগের গল্প এটি। ক্যালেন্ডারে ১৯৫৪ সাল। একদিন মোহাম্মদ আলীর শখের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। পুলিশ অফিসার মার্টিনের সহযোগিতায় পরে তা উদ্ধারও হয়। উদ্ধারকারী পুলিশ অফিসারকে তখন মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি ওই সাইকেল চোরকে পেটাবো।
তখন পুলিশ অফিসারটি তাকে বললেন, চোরকে পেটাতে হলে আগে লড়াই করতে শিখতে হবে। পুলিশ অফিসার মার্টিন ছিলেন একজন বক্সার এবং তিনি শহরে বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণও দিতেন। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে পরদিনই মোহাম্মদ আলী বক্সিং শেখা শুরু করেন মার্টিনের কাছ থেকে।
‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে এসো’
অনেকেই হয়তো জানেন না, মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। কক্সবাজারে এক টুকরো জমিও উপহার পেয়েছিলেন তিনি। কিংবদন্তি আলী ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সপ্তাহব্যাপী এই সফরে সঙ্গী ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী ওভেরোনিকা পোরশে, মেয়ে লায়লা আলী, ভাই, বাবা ও মা। ঢাকায় আলীকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে সময়ই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় তাকে। আলীর সম্মানে তৎকালীন ঢাকা (বর্তমান বঙ্গবন্ধু) স্টেডিয়ামে প্রদর্শনী মুষ্টিযুদ্ধের আয়োজন করা হয়। এতে ১২ বছর বয়সী বাংলাদেশি বালক মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন সর্বকালের সেরা আলী। বাংলাদেশ সফরকালে আলী সুন্দরবন, সিলেট, রাঙামাটি ও কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হন আলী। উচ্ছ্বসিত হয়ে বাংলাদেশকে স্বর্গ আখ্যা দেন তিনি। বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেন, স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে ঘুরে আসুন। মোহাম্মদ আলীর বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে একটা তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল। তথ্যচিত্রটার নাম ‘মোহাম্মদ আলী গোজ ইস্ট : বাংলাদেশ, আই লাভ ইউ।’
আমেরিকান সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
ডেটলাইন ২৮ এপ্রিল- ১৯৬৭। আমেরিকার সঙ্গে ভিয়েতনামের যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। এরই মধ্যে মোহাম্মদ আলী আদেশ পেলেন তাকে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। কিন্তু সরাসরি না করে দিলেন আলী। উল্টো সরকারের বিপক্ষে আইনি লড়াই শুরু করেন। আলী আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে সরকার। আরও অভিযোগ করেন, অন্য ধর্মীয় গ্রুপের ওপর অত্যাচার ও অবিচার করার একটি প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে সরকার তাকে যুদ্ধে পাঠাতে চাইছে। কিন্তু রায় গেল তার বিপক্ষে। আদালত মোহাম্মদ আলীর চ্যাম্পিয়নশিপের পদক কেড়ে নেয় এবং তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে। পরে অবশ্য তিন বছর পর মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।
বোমারু ঘুষি
পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী ঘুষি ছিল মোহাম্মদ আলীর দখলে। তার মুষ্টির সামনে তারকা বক্সাররাও লড়াইয়ে নামার আগে আরেকবার ভেবে নিতেন। হিসাবটা বুঝে নিতে কষ্ট হবে না, তিনি ৬১ ম্যাচে ৩৭ বার প্রতিপক্ষকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছেন। একেবারে লীলাসাঙ্গ বলা যায়। তার জীবনে আলোচিত লড়াইয়ের তালিকায় রয়েছে ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর জায়ারের কিনসাসায় মোহাম্মদ আলী আর জর্জ ফোরম্যানের শিরোপা রক্ষার লড়াই হয়েছিল। সেটি তার সেরা লড়াইগুলোর একটি। আলীর বয়স তখন ৩২ বছর। ২৪ বছরের ফোরম্যান তখন অপরাজিত বুনো ষাঁড়ের মতো ভয়ঙ্কর এক মুষ্টিযোদ্ধা। শেষ আটটি লড়াইয়ে ফোরম্যান প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেছিলেন মাত্র দুই রাউন্ডে। সেই দুই রাউন্ডে পরাজিত দলে জো ফ্রেজিয়ারও আছেন। আর্চি মুর আলীকে পরামর্শ দিলেন লড়াইয়ের আগের রাতে সবার অগোচরে বনে পালিয়ে যেতে। কারণ তাতে করে রিংয়ে তার যে শোচনীয় অবস্থা হবে সেটি অন্তত তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন। ফোরম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ে আলী ‘দ্য রোপ এ ডোপ’ কৌশলের আশ্রয় নিলেন।
এ কৌশলের মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রথমে প্রতিপক্ষের আঘাত সহ্য করে পরে পাল্টা আঘাত হানা। প্রথম পাঁচ রাউন্ডে ফোরম্যানের আক্রমণগুলো প্রতিহত করে ষষ্ঠ রাউন্ড থেকে ঝলসে ওঠেন আলী। হিংস্র ফোরম্যান পঞ্চম রাউন্ড থেকে দুর্বল হতে থাকেন। আলী আক্রমণ প্রতিহত করে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। অষ্টম রাউন্ড শেষ হওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগে চূড়ান্ত আঘাত হানেন আলী। রেফারি ১০ গোনার আগে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেননি ফোরম্যান। এক দশক আগে জয় করা বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপাটি এভাবেই পুনরুদ্ধার করেন আলী।
এক নজরে
জন্ম : ১৭ জানুয়ারি-১৯৪২, যুক্তরাষ্ট্র
নাম : ক্যাসিয়াস ক্লে, পরে ধর্ম বদলে নাম রাখেন মোহাম্মদ আলী
পরিচিত ছিলেন : ‘পিপলস চ্যাম্পিয়ন’ নামে
উচ্চতা : ৬ ফিট ৩ ইঞ্চি
জাতীয়তা : আমেরিকান
লড়েছেন : ৬১ বার
জিতেছেন : ৫৬ বার
নক-আউট : ৩৭ বার (জিতেছেন)
হেরেছেন : ৫ বার
বাপকা বেটি!
মোহাম্মদ আলী মোট চারটি বিয়ে করেছেন। বক্সার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তৃতীয় ঘরের সন্তান। লায়লা আলী। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর রিংয়ে প্রবেশ করেন লায়লা আলী। প্রতিপক্ষ ছিলেন এপ্রিল ফ্লাওয়ার। লায়লার ক্রমাগত পাঞ্চের আঘাতে প্রথম রাউন্ডে নক-আউট হন এপ্রিল ফ্লাওয়ার। দ্বিতীয় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন স্যাডিনা পেনিক্সোরের সঙ্গে অনায়াসে জিতলেন লায়লা। এরপর একে একে হারালেন নিকলিন, আমটিং, ক্রিস্টাল আর্কেড, মাজোয়া দোল, কেন্দ্রা বেলহাট এবং ক্রিস্টিল রবিনসনকে। জ্যাকি ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যাবেন লায়লা এমন ধারণা ছিল অনুরাগীদের। মোহাম্মদ আলী হাতেগোনা যে কজন বক্সারের কাছে হেরেছিলেন জ্যাকির পিতা জো ফ্রেজিয়ার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। জ্যাকি ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে ৮ রাউন্ডের লড়াইয়ে জিতেছে লায়লা আলী। তৃতীয় স্ত্রী ভেরোনিকার মেয়ে লায়লার লড়াই দেখতে প্রায়ই গ্যালারিতে উপস্থিত থাকতেন মোহাম্মদ আলী। আলী লড়াইয়ে হেরেছিলেন। লায়লা আলী ২৫ লড়াইয়ে এখনো অপরাজিত। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর বক্সিং থেকে দূরে রয়েছেন লায়লা আলী।