বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাগলাটে শাসক উত্তর কোরিয়ার কিম

রণক ইকরাম

পাগলাটে শাসক উত্তর কোরিয়ার কিম

চুলের বিচিত্র ছাঁট, পোশাকে ভিন্নতা ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান, অদ্ভুত সব নিয়ম আর কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন বিশ্ব গণমাধ্যমে হয়ে উঠেছেন এক ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রের নেতা। অদ্ভুত শাসকের অদ্ভুত দেশ নিয়েই এ আয়োজন।

 

বিচিত্র তথ্যে উত্তর কোরিয়া

১. উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পৃথিবীর চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। পিয়ংইয়ংয়ের জনসংখ্যা ২.৮৪৩ মিলিয়ন।

 

২. সিআইএ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলতে ১৫ বছর এবং তার ঊর্ধ্বে যাদের বয়স তারা লিখতে ও পড়তে পারেন। এ হিসাবে উত্তর কোরিয়ার শিক্ষার হার শতভাগ।

 

৩. টাইমস জানায়, সেখানকার নারীদের জন্য রাষ্ট্রের নির্ধারিত ১৪টি চুলের স্টাইল রয়েছে। পুরুষরা ৫ সেন্টিমিটারের বেশি ও ২ সেন্টিমিটারের কম চুল রাখতে পারে না। দেশে মোট ২৮ ধরনের চুলের স্টাইল নির্ধারণ করে দেওয়া রয়েছে।

 

৪. উত্তর কোরিয়ার মাথাপিছু বাৎসরিক আয়ের চেয়ে কিম জং ইল এর কনিয়াক মদের পেছনে বাজেট ৮০০ গুণ বেশি। তার এ খরচ ৭ লাখ পাউন্ডের সমান।

 

৫. ইলের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ২০ হাজার ভিডিও টেপ সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে র‌্যাম্বো, গডজিলা ইত্যাদি।

 

৬. উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রফল ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার। দেশটি পেলসিলভেনিয়ার চেয়ে কিছুটা বড়।

 

৭. কোরিয়ান যুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়ায় যারা জন্ম নিয়েছেন তারা সবাই গড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে ২ ইঞ্চি খাটো।

 

৮. উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। দেশটির ১.১৯০ মিলিয়ন মানুষ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত।

 

৯. সেনাবাহিনীতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা সেনেগালের জনসংখ্যার সমান। এখানে ৬.৫১৫ মিলিয়ন পুরুষ এবং ৬.৪১৮ মিলিয়ন নারী সেনাবাহিনীতে কর্মরত।

 

১০. উত্তর কোরিয়ার ৬ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের অভাবে রয়েছে এবং ৩৩ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। দেশটির ২৩.৪ শতাংশ জিডিপি আসে কৃষিখাত থেকে। এ দেশে চাল, শস্য, আলু, সয়াবিন, ডাল চাষ হয়। এ ছাড়া ছাগল, শূকর এবং ডিম উৎপাদন হয়।

 

১১. বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় সোমালিয়া এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। এটি ২০১৩ সালের তথ্য।

 

উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গ

উত্তর কোরিয়া এই মুহূর্তে পৃথিবীর একটি রহস্যমণ্ডিত দেশের নাম। কন্ডোলিসা রাইস দেশটিকে ‘স্বৈরতন্ত্রের আবাসভূমি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ একে এক-তৃতীয়াংশ ‘এক্সিস অব ইভিল’ বলেছিলেন। আর ফ্রাঙ্কো ও সিথ রোজেন কিছুটা কৌতুক করে বলেছিলেন, দেশটি পিয়ংইয়ংয়ের অসমর্থনের ফল।

উত্তর-পূর্ব এশিয়ার কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর অর্ধাংশ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া। এর উত্তরে গণচীন, উত্তর-পূর্বে রাশিয়া, পূর্বে জাপান সাগর, দক্ষিণে দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিমে পীত সাগর অবস্থিত। দেশটির আয়তন ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার। উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যা ৩ কোটির কাছাকাছি। সাক্ষরতার হার শতভাগ। উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী কোরীয় উপদ্বীপের উপরের অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। পঞ্চাশের দশকে কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে এটি সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে রয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নাম পিয়ংইয়ং। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া মধ্যবর্তী অবস্থিত কোরীয় সেনামুক্ত ও প্রাবর অঞ্চল। আম্নোক নদী এবং তুমান নদী উত্তর কোরিয়া এবং গণচীনের মধ্যবর্তী সীমান্তে অবস্থিত। তুমান নদী একটি অংশ একেবারে উত্তর-পূর্ব অংশে রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। অবিভক্ত কোরিয়া মূলত জাপানিদের দখলে ছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়ার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার ফলে অবিভক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদী আমেরিকার মতাদর্শে পুঁজিবাদী ব্লকে যোগদান করে। তখন থেকে কোরিয়ার দুটি ভিন্ন নাম উত্তর ও দক্ষিণ।

 

কে এই পাগলাটে?

কিম জং উন। ক’দিন আগেও বিশ্বের অনেকেই তাকে চিনতেন না। কিন্তু ফ্রন্টলাইনে আসার পর থেকেই তিনি সারা বিশ্বের আগ্রহের কারণ। তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট। ওয়ার্কার্স পার্টি অব কোরিয়ার ফার্স্ট সেক্রেটারি, উত্তর কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সেনা কমিশন ও জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কোরিয়ান পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডারও তিনি।

২০১১ সালের জানুয়ারির শুরুতেই অনেক উত্তর কোরিয়াবাসী জানতে পারেন, সে বছরের ৮ জানুয়ারি এক বিশেষ দিনের মর্যাদা পেতে চলেছে। এক তরুণ নেতাকে চার তারকা জেনারেল ও দেশটির শীর্ষ নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে বরণ করে নিতে দিনটিতে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। সেই তরুণই আজকের বৈচিত্র্য আর রহস্যেঘেরা নেতা কিম জং উন। উনের জন্মদিনটি কোরিয়ানদের কাছে আজও অজানা। দিনক্ষণ না জানা থাকলেও বছরটি ১৯৮৪ বলে একটা গুঞ্জন রয়েছে। তাকে নিয়ে এমন অজানা অনেক বিষয়ই রয়েছে দেশটির অধিবাসীদের কাছে। গণমাধ্যমে প্রথম খোলাখুলিভাবে কিম জং উনের নামটি এসেছিল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। মাত্র ১৪ মাস পরই পুরো দেশের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। ইতিমধ্যে ২০১১-এর ডিসেম্বরে আকস্মিকভাবে মারা যান তার বাবা কিম জং-ইল।

অল্প বয়সে দেশের শাসনভার তুলে নেওয়ার পর অনেকেই তাকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কিন্তু সবার সংশয় উড়িয়ে দিয়ে তিনি এখন সবার আগ্রহের কারণ।

 

 

কিম জং উন নাম রাখা যাবে না

উত্তর কোরিয়ায় কোনো মানুষের নাম ‘কিম জং-উন’ রাখা যাবে না। শুধু তাই নয় সে দেশে যাদের এই নাম আছে, তাদেরও তা বদলে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সাল থেকেই এ নির্দেশ বহাল আছে। তবে এটি জনসমক্ষে আসে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। সরকারি নির্দেশে জানানো হয়েছে, কোনো নবজাতকের নাম কিম জং-উন রাখা যাবে না। যাদের এই নাম আছে, তাদের জন্মসনদ সংশোধন করতে হবে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বাবা কিম জং-ইল ও দাদা কিম

ইল-সাংয়ের নামে নাম রাখার ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। ২০১১ সালে কিম জং-উন উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতায় বসেন। তবে এর আগ পর্যন্ত তিনি পর্দার অন্তরালেই ছিলেন। দেশটির বেশির ভাগ মানুষই তার ছবি দেখেনি বা তার সম্পর্কে জানত না।

 

ইচ্ছেমতো চুল কাটা মানা

উত্তর কোরিয়ার অদ্ভুত আইনগুলোর আরেকটি হচ্ছে সেখানে চাইলেই ইচ্ছেমতো চুল কাটা যাবে না। যার যেমন খুশি চুল কাটবেন সে উপায় নেই? স্বৈরশাসক কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর পরই ঠিক করে দিয়েছেন, দেশের সব পুরুষকে বিশেষ ১০টি আর মেয়েদের ১৮টি হেয়ার স্টাইলের মধ্যেই যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। আর কিম জং উন যেভাবে চুল কাটান সেভাবে দেশের আর কেউ কাটাতে পারবেন না। এই একটি কাটিং কেবল তাদের শাসক কিম জং এর জন্যই বরাদ্দ!

 

গাঁজা সেবনে বাধা নেই

অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম থাকলেও উত্তর কোরিয়ার একটা নিয়ম কিন্তু আপনাকে একদম চমকে দেবে। আর সেটি হচ্ছে এখানকার লোকজন আর কিছু করতে পারেন আর না পারেন নির্বিঘ্নে গাঁজা সেবন করতে পারবেন ঠিকই। কারণ উত্তর কোরিয়ায় গাঁজা সেবনে কোনো বাধা নেই। তাই গাঁজাপ্রিয় মানুষের কাছে উত্তর কোরিয়া একটা স্বর্গ বলে বিবেচিত হতেই পারে! এ দেশে যে যত খুশি গাঁজা খেতে পারেন। গাঁজা সেখানে কোনো নিষিদ্ধ মাদক নয়। অন্যান্য সব সাধারণ খাবার-দাবারের মতোই সেখানে গাঁজা টানা হয়!

 

পাঠ্যবইয়ের পুরোটাজুড়ে কিম

পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল অনেক কিছুই ঘটিয়েছেন কিম জং উন। এরকমই আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে  পাঠ্যবইয়ে কিম জং উনের জীবনী যুক্ত করা হচ্ছে। যার পুরোটা জুড়েই থাকছে ‘বিস্ময়বালক’ কিম জং উনের মাহাত্ম্য। কীভাবে মাত্র তিন বছর বয়সে দক্ষ চালক হয়ে উঠেছিলেন, মাত্র নয় বছরে নৌ-প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন এসবেরই আখ্যান থাকছে সেই অবশ্যপাঠ্য বিষয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, উনের এই নতুন কৌশলের পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।

তা হলো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করা। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো বটেই, শিক্ষার্থীরাও যাতে উত্তর কোরিয়ার এ স্বৈরতন্ত্রী প্রশাসকের ব্যাপারে অনুগত থাকেন, তা নিশ্চিত করতেই এ পদক্ষেপ।

উত্তর কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে, তাদের রাষ্ট্রপ্রধান রাজনীতির আঙিনায় দক্ষ তো বটেই, পাশাপাশি ছবি আঁকাতেও সমান পটু। আবার তিনি সুরস্রষ্টাও বটে। একই সঙ্গে অকুল সমুদ্রে দক্ষ নাবিকের মতো ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতাও তার জন্মগত। সব মিলিয়ে উত্তর কোরিয়ার এ শাসককে বিস্ময়বালক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ওই পাঠ্যবইয়ে।

 

শক্তিমান কিম...

এদিকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন মার্কিন মদদপুষ্ট  প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়াকে একের পর এক হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মার্কিন ঘাঁটি তাক করে বিধ্বংসী রকেট পর্যন্ত মোতায়েন করেছেন। দুই কোরিয়ার যৌথ শিল্প এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মীদের। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পারমাণবিক চুল্লি আবার চালু করার ঘোষণা দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। উনের এসব কর্মকাণ্ডে সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন দুই কোরিয়ার সমস্যা। খোদ মার্কিন কর্তৃপক্ষ রীতিমতো নড়েচড়ে উঠেছে। জোরদার করছে তাদের সামরিক শক্তি। তবে কি কিম জং-উন বাবা ও দাদার চেয়েও শক্তিমান নেতা? না, স্রেফ খেয়ালখুশির বশে ঘটিয়ে যাচ্ছেন এসব আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা?

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সত্যিই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে কিছু করে দেখাতে পারবেন? ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত নেতা কিম জং-ইলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যখন তার উত্তরসূরি হিসেবে বড় দুই ছেলেকে ডিঙিয়ে ছোট ছেলে কিম জং-উনের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক কানাঘুষা শুরু হয়েছিল।

একে তো কিম জং-উন বয়সে নেহাত তরুণ, তার ওপর তার কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, তার বিদ্যার পাল্লা তেমন ভারী নয়, বুদ্ধিশুদ্ধিতে ধার নেই, রাজনীতির চেয়ে খেলাধুলায় ঝোঁক বেশি। আবার তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। এসব খবরে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, উন আর যা-ই হোন, বাবা ইলের মতো অতটা প্রভাবশালী নেতা হতে পারবেন না।

 

দেখতে বাচ্চাদের মতো...

কিম জং ইলের কনিষ্ঠ পুত্র কিম জং উন। বয়স মাত্র ২৭। এত অল্প বয়সেই তিনি চার তারকা জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছেন। কিম জং উনকে দেখলে যে কেউ অত্যন্ত অল্পবয়স্ক বলে ভুল করবে। বলা হচ্ছে তিনি দেখতে বাচ্চাদের মতো। ঠিক কবে কিং জং উন জন্মেছেন তা কেউ জানে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে ১৯৮২, ‘৮৩ কিংবা ‘৮৪ সালে তার জন্ম। বাবা কিম জং ইলের তৃতীয় পুত্র সন্তান জং উন। জং উনের মা কিম জং ইলের তৃতীয় স্ত্রী। সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন জং উন। জার্মান ভাষাও তখন শিখেছেন। রাজধানী বার্নের কাছে গুমলিঙেন শহরের একটি স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন জং উন। এই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি ইংরেজি ভাষা শেখেন।

টেবিল টেনিস খেলতে পছন্দ করেন জং উন। হলিউডের অ্যাকশন হিরো ভ্যান ড্যামের ছবি তার খুব পছন্দের। একই সঙ্গে আমেরিকান বাস্কেটবলের ভক্ত তিনি। অত্যন্ত অমায়িক এবং মিশুক বলে স্কুলে পরিচিত ছিলেন জং উন। তবে উনি সবসময়ই একজন দেহরক্ষী নিয়ে স্কুলে আসতেন। বেশ ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও জং উন স্কুলের পাঠ পর্ব শেষ করেননি। ভর্তি হওয়ার কয়েক বছর পরেই তাকে স্কুল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ওয়াকিবহাল মহল বলছে, কিম জং-উন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। দেশের সেনার ওপর তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রয়েছে কিনা তা নিয়ে কিম নাকি সন্দিহান। তাই কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই তাকে হত্যার আদেশ দিয়ে দিচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা।

অনভিজ্ঞ উনের ব্যাপারে অধিকাংশ পর্যবেক্ষকেরই ধারণা ছিল, অন্তত পরের কটি বছর বাবার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ঝানু সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দায়িত্ব-কর্তব্য রপ্ত করবেন তিনি। কিন্তু রাতারাতিই বুঝিয়ে দিলেন, ভাবনা ঠিক নয়।

 

বাদ পড়েনি সেনাপ্রধানও

কখনো ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে ঠেলে দিয়ে। কখনো কামানের তোপ। আবার কখনো সামনে থেকে গুলি করে। বিরোধী বা তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে এভাবেই প্রাণদণ্ড দেওয়ার একাধিক নজির রয়েছে উত্তর কোরিয়ার  ‘স্বৈরাচারী’ শাসক কিম জং উনের। এবার কিম  প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দিলেন তার সেনাপ্রধান জেনারেল রি ইয়ং গিলকে। দীর্ঘদিনের এই সেনাপ্রধানকেও হয়তো কামানের গোলা কিংবা ক্ষুধার্ত কুকুরের পালের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

২০১৪ সালে সরকারবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে কিম জং উন ক্ষুধার্ত কুকুরের পালকে খাইয়ে দেন নিজের কাকাকে। এবার খোদ দেশের সেনাপ্রধানকেই মেরে ফেলার নির্দেশে রীতিমতো তোলপাড় পড়ে গেছে তামাম দুনিয়ায়। ২০১৩ সালের আগস্টে কিম জং উন যখন কিম ক্ষমতায় আসেন তখন থেকেই সেনাপ্রধান ছিলেন রি ইয়ং গিল। কিমের খুব কাছের মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন রি। উত্তর কোরিয়ার সরকারি খবর অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল রি-এর বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগেই তিনি দোষী প্রমাণিত হন কিম জং উনের আদালতে। শুধু রি ইয়-ই নন, সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিককে সরিয়েছেন কিম। তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও দক্ষিণ কোরিয়ার সোপ অপেরা দেখার অভিযোগ ছিল।

 

জমজমাট রাজনীতির মঞ্চ

কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়ার প্রথম হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালানোর নেপথ্যের ব্যক্তিও এ কোরীয় নেতা। ওই পরীক্ষা চালানোর নির্দেশপত্রে সই ছিল তার।

হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কিম বিশ্বকে এটাই স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হুমকি, চাপ, ভাবনা নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই। তাই বিশ্বনেতাদের বুড়ো আঙুল দেখাতে কার্পণ্য করেননি তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বে ‘কবরের হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিশ্বকে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোনো ছাড় না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক হতে পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বারাক ওবামা উত্তর কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একদম পেটের মধ্যে আঘাত হানা যায় এমন সব অস্ত্র আবিষ্কার করছে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের হুমকি ও নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে আপনজনদের হত্যাসহ নানান কর্মকাণ্ডে দেশটি সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়া ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র টেনশনে রয়েছে সেটা বলাই যায়।

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন  প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটিকে শয়তান চক্রের অংশ বলেছিলেন। বর্তমানে উত্তর কোরিয়া উদীয়মান সামরিক শক্তির একটি দেশ। গত কয়েক মাসে বেশ দাপটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গন গরম করে তুলেছেন কিম জং উন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, প্রয়াত বাবা কিম জং-ইলের মধ্যে আক্রমণাত্ম যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে, ছেলে কিম জং-উনের মধ্যেও তার ছাপ রয়েছে। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, মৌখিকভাবে আক্রমণ ও হুমকি দেওয়া কিম পরিবারের পুরনো ঐতিহ্য। গত ৫০ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে তরুণ কিমের বাবা ও দাদা একই কাজ করেছেন। তবে কিম জং-উন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে।

 

জন্মদিন পালনেও নিয়ম

উত্তর কোরিয়ায় বছরের বিশেষ দুটি দিনে কেউ জন্ম নিলে সেই দিনে জন্মদিন উদযাপন করা যাবে না। উত্তর কোরিয়ার সাবেক দুই শাসক কিম ই সুং এবং কিম জং ইল মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে সেই দিনগুলোতে দেশের কোনো সাধারণ মানুষের জন্মদিন উদযাপন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ। এ নিয়ম মানতে গিয়ে প্রায় ১ লাখ মানুষকে ৮ জুলাই বা ১৭ ডিসেম্বরের জন্মদিন উদযাপন করতে হয় একদিন পর, অর্থাৎ ৯ জুলাই এবং ১৮ ডিসেম্বরে।

 

জিন্স পরা নিষিদ্ধ

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ বহু পুরনো। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে যার শুরু। এর জের এখনো যায়নি। তাই তো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি জিন্স পরে বলে এ দেশে জিন্স পরা নিষিদ্ধ।

 

সমাজতন্ত্র নাকি একদল

এক সময় উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা ছিল কিন্তু এখন যে ধরনের শাসন চলছে তাকে সমাজতান্ত্রিক বলার উপায় নেই। দেশের নাম ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল’স রিপাবলিক অব কোরিয়া’, অথচ ঘোষিতভাবেই চলছে একদলীয় শাসন।

তবে সমাজতন্ত্র না থাকলেও উত্তর কোরিয়ার সেই ‘শীতল যুদ্ধের’ সময়কার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধিতা ঠিকই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি জিন্স পরে বলে এ দেশে জিন্স পরা নিষিদ্ধ। একদলীয় শাসনের কারণে এমন নানা বিচিত্র নিয়ম চলছে দেশটিতে।

 

কিম নামা

২০১১ সালে পিতা কিম জং ইলের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করার পরে শুরু থেকেই কিম জং উন তার অদ্ভুত ধরনের নৃশংসতার জন্য আলোচিত। তার ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার অন্তত ১০০ জন এলিটকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন তিনি।

 

সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলায় দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিওন ইয়ং চলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অদ্ভুত আর নৃশংস ঘটনা আর কখনোই দেখা যায়নি।

 

ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে কিম জং। ক্ষমতাগ্রহণের পরই দেশের শীর্ষ তিন উপদেষ্টার যে হাল উন করেছিলেন, তাতেই পর্যবেক্ষকরা বুঝে গিয়েছিলেন সামনে কী কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছেন তিনি। উপদেষ্টাদের একজনকে সরকারি বৈঠকে ক্যামেরার সামনেই গ্রেফতার করান তিনি। পরের সপ্তাহেই মৃত্যুদণ্ড। আরেকজনকে সাপ্তাহিক বৈঠকে আসতে বলেন। পরে এই উপদেষ্টার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তৃতীয়জনকে গৃহবন্দী করেন যিনি উনেরই এক স্বজন ছিলেন।

 

বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১২ ডিসেম্বর ফুফা-জ্যাং সং থায়েককে মৃত্যুদণ্ড দেন উন। এরপর তিনি জ্যাংয়ের রক্তের সম্পর্কের প্রত্যেককে নিশ্চিহ্ন করেন। রেহাই পায়নি নিরপরাধ শিশুরাও। জ্যাংয়ের বংশের কোনো চিহ্ন না রাখার জন্যই এ গণহত্যার আদেশ দেন কিম জং।

সর্বশেষ খবর