রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
দিলীপ সাংঘভি
[ প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সান ফার্মাসিউটিক্যালস]

ওষুধের ফেরিওয়ালা এখন ধনকুবের

তানভীর আহমেদ

ওষুধের ফেরিওয়ালা এখন ধনকুবের

ভারতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দিলীপ সাংঘভি। সান ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা এখন ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। বিশ্বের ৪৪তম শীর্ষ বিলিওনিয়ার হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছেন ফোর্বস ম্যাগাজিনে। ১৬.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক দিলীপ সাংঘভিকে ভারতে ওষুধশিল্পের প্রাণ বলা হয়। তার গবেষণাগার জাদুকরী ওষুধের সন্ধান দিয়ে চলেছে বিশ্ববাসীকে। তার জীবনে উত্থানের গল্প প্রেরণা জোগায়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাবার সঙ্গে একসময় কলকাতায় হোলসেল ওষুধ বিক্রি করতেন। জীবনের গল্প বদলাতে বাবার কাছ থেকে ১০ হাজার রুপি ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন সান ফার্মা। বাকিটুকু তার জাদুমাখানো এক আখ্যান...

 

ধনকুবের দিলীপ

দিলীপ সাংঘভির মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফোর্বসের হিসাবে বর্তমানে তিনি ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। বিশ্বের ৪৪তম বিলিওনিয়ার। তার সান ফার্মাটিউক্যালস জাপানের র‌্যানব্যাক্সি কিনে নেওয়ার পর বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফার্মা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভারতের সবচেয়ে দামি ওষুধ কোম্পানি এখন সান ফার্মা। বর্তমানে এই ফার্মার বাজারমূল্য ৩০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সর্বশেষ সাফল্য ক্যান্সারের ওষুধ গ্লিভেক। এই জেনেরিকের ওষুধটি এনেছে তার মালিকানাধীন নোভার্টিস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ওষুধটি বাজারজাতকরণের উপযুক্ত বলে সার্টিফিকেট প্রদান করে। সাংঘভির আয়ের দরজা খুলে গেছে। ওষুধ ব্যবসার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ব্যবসায় নাম জড়িয়েছেন। গ্রিন এনার্জি উৎপাদন, বিতরণেও তার আগ্রহের কথা অজানা নয়। বাতাস থেকে শক্তি উৎপাদন কোম্পানি সুজোলনের ২৩ শতাংশ শেয়ার কিনে সেটাই বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু সম্মাননা লাভ করেছেন। ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী লাভ করে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। টাকার জোয়ার থাকলেও শুধু ব্যবসায় টাকা লাগাচ্ছেন আর বিলাসী জীবন পার করছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি সমাজসেবী হিসেবেও জনপ্রিয়। প্রতি বছর সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করেন। এ ছাড়া অসহায় নারী ও শিশু, দরিদ্র, নিরক্ষর, স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিতদের অঢেল অর্থ দান করেন।

 

অবিশ্বাস্য মনে হলেও রূপকথা নয়

বাবার সঙ্গে হোলসেল ওষুধ বিক্রেতা থেকে এখন ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী হয়ে ওঠার গল্প অবিশ্বাস্য হতে পারে অনেকের কাছে। তবে এটি রূপকথা নয়। বাবার কাছ থেকে ১০ হাজার রুপি ধার নিয়ে সান ফার্মা স্থাপনের সময় তার সঙ্গে কারখানায় কাজ করতেন মাত্র দুজন। মাত্র পাঁচ ধরনের সাইকিয়াস্ট্রি ওষুধ তৈরি করার সুবিধা ছিল তার সান ফার্মার— এতটাই ছোট। ধীরে ধীরে একটি দল দাঁড় করান তিনি। ১৯৯০ সালের দিকে সান ফার্মার নিজস্ব গবেষণা ল্যাব চালু করেন। পুরোটাই দিলীপ সাংঘভির একক প্রচেষ্টার ফসল। আশপাশের দেশেও ওষুধ বিক্রির সাহস করে বসেন। ১৯৯৪ সালে একটা অবস্থানে চলে আসে তার সান ফার্মা। এটি পাবলিকলি ঘোষণা করেন। শেয়ার আসে বাজারে। নতুন টাকা বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেননি তিনি। ১৯৯৬ সালের দিকে ওষুধ তৈরির একটি উপযুক্ত প্লান্ট কেনেন। মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের সেই প্লান্টের নাম নল ফার্মা। এটি তার প্রথম কেনা সম্পত্তি। জাদুর ছোঁয়া লাগে তার ওষুধ কোম্পানিতে। প্রায় ২৪টি দেশে তার কোম্পানির তৈরি ওষুধ বিক্রি শুরু হয়। সবখান থেকেই টাকার স্রোত বয়ে আসে কোম্পানির নামে। তবে ব্যবসায়িক প্রজ্ঞার নমুনা তিনি দেখিয়েছেন ১৯৯০ সালের দিকে। সে সময় চালু করা গবেষণাগার পরবর্তী সময়ে আলাদিনের চেরাগ হয়ে ওঠে। তিনি সাইকিয়াস্ট্রি ছাড়া ক্রোনিক থেরাপি, অনকোলজি, ডার্মাটোলোজি, কার্ডিওভাসকুলার ও নিউরোলজিতে সাফল্যের দেখা পান। তার গবেষকরা নিরন্তর পরিশ্রম করে ওষুধভাণ্ডার প্রসিদ্ধ করে তোলেন। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে সান ফার্মা। একে একে নতুন ওষুধ কারখানা, গবেষাণাগার, বিজনেস পলিসি দিয়ে শক্ত ভিত তৈরি করেছেন সান ফার্মার। সর্বশেষ তার নজর পড়ে র‌্যানব্যাক্সির ওপর। র‌্যানব্যাক্সি জাপান-বেসড বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ ওষুধ কোম্পানি। ২০১৪ সালে ৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে  র‌্যানব্যাক্সি কিনে ফেলেন দিলীপ সাংঘভি। এর ফলে সান ফার্মা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি হিসেবে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায়।

 

বাবাকে বললেন, ১০ হাজার রুপি ধার দাও ব্যবসা শুরু করব। তারপর...

দিলীপ সাংঘভির জন্ম গুজরাটের প্রত্যন্ত এক গ্রাম  আমরেলিতে। সেখানে দরিদ্রতার সঙ্গে বসবাস গ্রামবাসীর। একই অবস্থা দিলীপের পরিবারের। পরিবারে আর্থিক অনটন লেগেই থাকে। মা গৃহিণী। বাবা ওষুধের হোলসেলার। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ দোকানে দোকানে নিয়ে যেতেন। দরদাম মিলে গেলে বিক্রি করতেন। খুব সামান্য আয়। এ আয়ে বউ আর সন্তানের ভরণ-পোষণ করেন। বাবার এই কষ্ট দেখেই বড় হয়েছেন দিলীপ সাংঘভি। পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। শুরুতে গ্রামের স্কুলে। তারপর শহরকেন্দ্রিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজমেরি হাইস্কুল থেকে স্কুলিং শেষ করে গ্র্যাজুয়েশনের জন্য গেলেন ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজে। টাকার টানাটানি। খাবার জোগাতেই বাবা হিমশিম খান, উচ্চশিক্ষার খরচ তো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তবে তার পড়াশোনা থেমে থাকেনি। বাবার সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেন। ওষুধ ফেরি করা। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ওষুধের নমুনা নিয়ে ছুটতেন। ওষুধের দোকানে তো বটেই, ওষুধ ফেরি করেছেন রাস্তায়ও। বাবার সঙ্গে হোলসেল ওষুধ বিক্রির ব্যবসা খুব কাছ থেকে শিখলেন। এ সময় আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এভাবে আর কত। বাবাকে একদিন সাহস করে বললেন, বাবা টাকা দাও। ব্যবসা করব।

ছেলের মুখে এই কথা শুনে অবাক হলেন বাবা। কিন্তু তার শরীরী ভাষা ছিল স্পষ্ট। এবার সময় বদলানোর চেষ্টা। বাবা বললেন, কত টাকা? দিলীপ সাংঘভি বললেন, ১০ হাজার রুপি দাও। বাবার কাছে জমানো টাকা আসবে কোত্থেকে? তিনি বললেন, টাকা ধার দিতে পারি। কোথায় টাকা নষ্ট হয় কে জানে! যে টাকা জমিয়েছিলেন সেটাই তুলে দিলেন ছেলের হাতে। বাবা ১০ হাজার রুপি দিলীপের হাতে তুলে দিয়ে জানতে চাইলেন, কীসের ব্যবসা? দিলীপের সহজ উত্তর, ওষুধের ব্যবসা। হোলসেল ওষুধ বিক্রি করে যে আয় হয় তার চেয়ে বরং আমরাই একটা ওষুধ কোম্পানি খুলে ফেলি। ওষুধের মান যদি ঠিক তাতে তা বাজারে বিক্রি করতে অসুবিধা হবে না। ১০ হাজার রুপি ধার হিসেবে হাতে নিয়ে দিলীপ সাংঘভি কাজে নেমে পড়লেন। ১৯৮২ সালের কথা। যাত্রা শুরু সান ফার্মাসিউটিক্যালসের। ওষুধ তৈরি প্রযুক্তি ও কৌশল নিয়ে নানা চড়াই-উতরাই পার হতে হয় এই কোম্পানিটির। আজ সেই সান ফার্মাসিউটিক্যালস বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি। এর আয় থেকেই আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন দিলীপ সাংঘভি। এখন তার ব্যবসা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে।

 

দিলীপ সাংঘভির হীরার বাড়ি

ধনকুবেরদের বাড়ি, গাড়ি আর বিমান নিয়ে বাজারে মুখরোচক খবরের শেষ নেই। মানুষের মুখে মুখে সেই খবর আরও চাঙা হয়। দিলীপ সাংঘভির বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। তার একটি গুজরাটের সুরাটে। অনেকে বলেন, এই বাড়িটির ভিতরে নাকি হীরা বসানো হয়েছে। সত্যিটা কী তা এই বাড়ির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই শেষে জানায়। সুরাট একসময় ভারতে আনকাট হীরা বাজার উপযোগী করার জন্য বিখ্যাত ছিল। তার হীরার ইতিহাস ধরে রাখার প্রচেষ্টা ছিল এই বাড়িতে। বাড়িটির নকশা ও ভিতরের ইন্টেরিয়র, দেয়াল— সবখানেই হীরার চমক রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এটা অনেকটাই আলোর খেলা। সত্যিকারের হীরা নয়। তবে দেখে মনে হবে সত্যি বুঝি হীরা বসানো এক স্বর্গপুরী।

 

এক নজরে...

নাম : দিলীপ সাংঘভি

বয়স : ৬০ বছর।

পেশা : ব্যবসায়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মাটিউক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

যে কারণে আলোচিত : এখন ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে নিজেই ওষুধ বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন।

আয়ের উৎস : ওষুধের ব্যবসা ও নিজস্ব।

বেতন : ভারতের ওষুধ কোম্পানিগুলোর সিইও হিসেবে সবচেয়ে কম বেতন পান দিলীপ সাংঘভি। তিনি মাসে ২ থেকে ৩ কোটি রুপি বেতন পান। এর মধ্যে বাড়িভাড়া, পার্কিং খরচ, অফিস অ্যালাউন্স, বোনাস ও ইনস্যুরেন্স যোগ রয়েছে।

মোট সম্পদ : ২০১৫ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার হারান তিনি। এখন ১৬.১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে তার।

ব্যক্তিগত জীবন : বিবাহিত। তার দুই সন্তান রয়েছে। থাকেন ভারতের মুম্বাইয়ে। তার দুই ছেলে অলোক ও বিধি সান ফার্মার ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব লাভ করেছেন। তার স্ত্রী বিভা বর্তমানে সান ফার্মার ২৮০ কোটি রুপির শেয়ারের মালিক। শাশুড়ির কাছ থেকে বিভা এই শেয়ার উপহার হিসেবে পান।

সর্বশেষ খবর