শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৬

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৬

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প-উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।

উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ষোড়শ পর্ব।

 

[পূর্ব প্রকাশের পর]

হাসান জং চলে যেতেই পারগালি ইব্রাহীমের দিকে পুনরায় মন দিলেন সুলতান সুলেমান খান।

‘তারপর.. পারগালি। রাতের কথা কিছু বল।’

পারগালি ইব্রাহীমকে বেশ অপ্রস্তুত দেখালো। ঢোক গিললেন দুবার। বিষয়টি খেয়াল করতেই স্মিত হাসলেন সুলেমান।

‘ইব্রাহীম? লজ্জা পাচ্ছো?’

‘জি না সুলতান। আসলে হয়েছে কী.. গতরাতের বিষয়টি আমার অনুকূলে ছিল না।’

‘মানে? কোনো সমস্যা হয়েছে? কেউ কী বেয়াদপি করেছে? তেমন কিছু ঘটে থাকলে আমায় নির্ভয়ে বলো ইব্রাহীম। আমি তার মুণ্ডুপাত করবো।’

‘না না সুলতান। সেরকম কিছু ঘটেনি। আসলে আমার কক্ষে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসাবেলা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই তার সঙ্গে আমার তেমন কোনো কথাই হয়নি।’

ভয় জড়ানো কণ্ঠে ইব্রাহীমের উত্তর শুনেই হো হো করে হেসে উঠলেন সুলতান। যাকে বলে প্রাণখোলা হাসি। হাসতে হাসতে প্রায় ইব্রাহীমের কাছে এসে লুটিয়ে পড়লেন যেন। কিছু না বুঝে ইব্রাহীম নিজেও সুলতানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ হাসতে হাসতে কেটে গেল তাদের। সুলতান সুলেমানকে এই মুহূর্তে ঠিক নিজের কাছের বন্ধুই মনে হচ্ছে ইব্রাহীমের। এ ব্যাপারটা অনুভব করে মনে মনে বেশ পুলকিত হলেন ইব্রাহীম। সেই পুলক কাটতে না কাটতেই রক্ষী এসে উপস্থিত।

‘হুজুর মাফ করবেন। খাস কামরা প্রধানের অতিথি জলপান শেষ করে অপেক্ষা করছেন।’

‘অতিথি?’

রক্ষীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইব্রাহীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সুলেমান।

‘জি জনাব। উনার নাম মাতরাকচি নাসু। খুব জ্ঞানী মানুষ। যেমন ভালো যোদ্ধা তেমন ভালো বক্তা। একজন গণিতবিদ, পেইন্টার, বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত মানুষ। তিনি মহামান্য সুলতান সেলিম খানেরও প্রিয়ভাজন ছিলেন। অটোমান সুলতানের উত্থান, সংস্কৃতি, সাম্রাজ্য প্রভৃতি নিয়ে ইতিহাস লিখছেন। আপনাকে নিয়েও সুলতাননামা লেখা শুরু করেছেন। জেনেসারিসদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হাসান জংয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয়। আপনি অনুমতি দিলে তাকে আপনার সামনে হাজির করতে চাই।’

‘আচ্ছা। আমিও আম্মার মুখে তার নাম শুনেছি। আসলেই অনেক জ্ঞানী আর মজার মানুষ নাকি। ডাকো তাকে।’

‘অতিথিকে এখানে পাঠিয়ে দাও।’

রক্ষীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন ইব্রাহীম।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে এসে হাজির হলেন মাতরাকচি নাসু। ঘরে প্রবেশের অনুমতি পেতেই সুলতানকে বিনয়ের সঙ্গে কুর্নিশ করলেন।

‘মহামান্য সুলতান সেলিম খান জং এ বাহাদুরের জয় হোক।’

‘ধন্যবাদ। আপনি কেমন আছেন মাতরাকচি নাসু?’

সুলতানের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলেন। পারগালির মুখে শুনেই সুলতান এভাবে তাকে সম্বোধন করবে ভাবেননি কখনো।

‘হুজুর আপনি কী আমায় চেনেন?’

‘কেন নয় মাতরাকচি? আমার মা আয়েশা হাফসার কাছে আপনার গল্প শুনেছি।’

‘সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার শোকর। সুলতানা আমায় ভীষণ পছন্দ করেন। উনি ভালো মানুষ।’

‘মাতরাকচি আপনি নাকি মজার মানুষ?’

‘না তেমন কিছু নয় হুজুর। এই একটু নিজের মতো করে চলার চেষ্টা করি। কারও কোনো কিছু গায়ে মাখি না। মন চাইলে যুদ্ধ করি। মন চাইলে লিখি। আবার মন চাইলে ছবি আঁকতে শুরু করি।’

‘আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আপনি আরও আগেই আসতে পারতেন।’

‘জি মানে। আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তাই কীভাবে আসবো ভাবিনি। আজই পারগালি মহোদয় নিয়ে এলেন। হাসান জংয়ের কাছে বলেছিলাম সুলতাননামা লিখতে হলে সুলতানের কাছাকাছি থাকতে হবে।’

‘অবশ্যই থাকবেন। ইব্রাহীম মাতরাকচি নাসুর থাকার ব্যবস্থা কর। আর উনার জন্য রাজপোশাকের ব্যবস্থা কর।  আজ থেকে আমি উনাকে আমার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ঘোষণা করলাম। পাশার সমান পদমর্যায় উনি বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুবিধাদি ভোগ করবেন।’

এমন ঘোষণা পারগালি কিংবা মাতরাকচি কেউই আশা করেনি। দুজনেই চমকে ওঠে মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল। মাতরাকচি ছুটে গিয়ে সুলতানের কাফতানে চুমু খেলেন। তারপর মাথা নুইয়ে সুলতানকে বললেন,

‘হুজুর অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।’

‘অবশ্যই মাতরাকচি। নির্ভয়ে বলুন।’

‘মানে আপনি যে সম্মান আমায় দিলেন আমি জানি না আমি তার যোগ্য কিনা। কিন্তু আপনার প্রতি আমৃত্যু আমার কৃতজ্ঞতা। কিন্তু হুজুর আমি যাযাবর মানুষ। লেখালেখি আর আঁকাআঁকির জন্য বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। সেক্ষেত্রে আমি আমার দায়িত্ব কীভাবে পালন করব। রাজপ্রাসাদের এত আরামও আমার সইবে কিনা কে জানে?’

মাতরাকচির কথা শুনে মৃদু হাসলেন সুলতান।

‘আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকল মাতরাকচি। আপনার যখন যেখানে খুশি যেতে পারেন। যেভাবে খুশি ঘুরতে পারেন। কেবল প্রাসাদের নিয়ম কানুনগুলো মাথায় রাখলেই চলবে। আশা করছি আপনার সঙ্গে আগামী দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ভালোই হবে।’

‘ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যেন আমায় সেই শক্তি ও সামর্থ্য দান করেন।’

‘অবশ্যই’।

সুলতান মাতরাকচির কথায় সহমত পোষণ করলেন।

 

 

ইসাবেলা এখন অনেকটাই সুস্থ। হারেমের মেয়েদের কক্ষে ফেরার পর থেকে হুররেম তার পাশেই ছিলেন। প্রচুর সেবাও করেছেন। দানা হালিল, মনজিলাও দফায় দফায় খোঁজ রেখেছেন ইসাবেলার। তবে এমন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ইসাবেলা নিজে বেশ লজ্জিত। হারেমের মেয়েদের কানাঘুষাও ওকে অনেক বিব্রত করেছে। এদিক থেকে অবশ্য হুররেম ওকে মানসিকভাবে দারুণ সমর্থন জুগিয়েছে। বারবার এই প্রসঙ্গেই ফেরত আসছে ইসাবেলা।

‘এটা কী হয়ে গেল হুররেম। আমার এমন কেন হলো বল তো?’

ইসাবেলার এই প্রশ্নের জবাব অনেকবারই দিয়েছে হুররেম। তারপরও বিরক্ত হলো না।

‘বাজে বকো না তো ইসাবেলা। এটা হতেই পারে। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলে না। আবার হঠাৎ ডাক পেয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলে। হেকিম হালিমের নেসাও তাই বলেছেন। তুমি উত্তেজনার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। এতে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই। তুমি পুরোপুরি সুস্থ হও, তোমাকে আবার পারগালির কক্ষে পাঠানো হবে।’

‘না.. আমি যাব না।’

এবার বিরক্ত হলেন হুররেম।

‘পাগলামি করছ কেন ইসাবেলা? তুমি কী সব ভুলে গেছ? ভুলে গেছ আমাদের পরিকল্পনার কথা? কিছুই কী তোমার মনে নেই?’

‘আছে হুররেম। কিন্তু এই মুখ আমি ইব্রাহীমের সামনে আবার কী করে দেখাব?’

‘উফ.. ইসাবেলা। আবারও। তোমাকে তো বলেছি পুরো ব্যাপারটা আমি নিজে দেখব। তোমার এত চিন্তা করার কিছু নেই। আচ্ছা বল তো তোমার শরীর এখন ঠিক কেমন আছে?’

‘এখন ভালো আছি হুররেম। তুমি আসার পর থেকে সব ঠিক লাগছে। এর আগে খুব খারাপ লাগছিল।’

‘কেন’?

‘তুমি তো জানই আশপাশের মেয়েগুলো কত খারাপ। অযথাই হাসাহাসি করছিল। খুব বিরক্ত লাগছিল। আবার কিছু বলতেও পারছিলাম না।’

‘আচ্ছা ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে রেখ একদিন এই প্রাসাদ আমার হবে। আমি শাহজাদার মা হব। সেদিন সবাইকে দেখে নেব।’

‘আস্তে বল হুররেম। কেউ শুনে ফেলবে। কথায় বলে দেয়ালেরও নাকি কান আছে।’

‘থাকুক। এই হুররেম কাউকে ভয় পায় না। আমি সুলতানকেও বলে দিয়েছি আমি তার শাহজাদার মা হতে চাই।’

‘মানে?’

বিস্ফোরিত কণ্ঠে ইসাবেলার জিজ্ঞাসা।

‘মানে সুলতানকে আমার স্বপ্নের কথা বলেছি।’

‘সুলতান কী বললেন?’

‘কিছুই না।’

‘সুলতান কিছুই বলল না?’

ইসাবেলার কণ্ঠে প্রবল কৌতূহল।

‘না। চুপ থেকেছেন।’

‘তার মানে কী? উনি কী তোমার ওপর রাগ করেছেন?

 ‘না। ধুর বোকা। আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবেন সুলতান? সুলতান আমাকে অনেক বেশি পছন্দ করেন। নইলে কী আর আমার নাম পাল্টে হুররেম রাখতেন?’

‘তুমি সত্যি সুলতানের মা হবে?’

‘অবশ্যই। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’

হুররেমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।

ইসাবেলা চুপসে যায়। হুররেম অর্থাৎ আলেকজান্দ্রাকে সে ছোটবেলা থেকেই চেনে। ও যেটা ভাবে সেটা করেই ছাড়ে। কে জানে মাথার ভিতর কী খেলছে। হুররেমের সঙ্গে থেকে ওর আবার কোনো বিপদ হবে না তো। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে ইসাবেলা। বেশ ঝুঁকি অনুভব করছে বিষয়টা নিয়ে।

‘কী ভাবছ?’

হুররেমের প্রশ্নে চমকে ওঠে ইসাবেলা। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।

‘না। তেমন কিছু না। ভাবছি তুমি শাহজাদার মা হলে কতই না ভালো হবে।’

‘হুম সেটাই। তখন তোমার ক্ষমতাও অনেক বেড়ে যাবে ইসাবেলা। ভাব ভাব। সামনে আমাদের সুদিন আসছে।’

‘সত্যিই যেন তাই হয় সে দোয়াই করি।’

‘অপেক্ষা কর ইসাবেলা। দেখবে জয় আমার হবেই।’

তখনই কারও গলা শোনা গেল। অন্য মানুষের গলা শুনেই চুপ হয়ে গেল হুররেম আর ইসাবেলা। কারণ ওদের মনের গোপন অভিপ্রায় অন্য কেউ জেনে গেলেই বিপদ।

 

চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর