রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৭

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৭

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। এটা কেবল সুলতানের মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প-উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।

 

উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। এবারের পর্বে দেখা যাবে হুররেমের নতুন চাল ও সুলেমানকে নিয়ে ভ্যাটিকানের পাদ্রিদের ষড়যন্ত্র। রকমারির এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো সপ্তদশ পর্ব।

 

দুই দিন আগে হেরেমে দশ-বারোজন নতুন মেয়ে এসেছে। এরা সবাই মিসরীয়। হেরেমে নতুন মেয়েরা এলেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এবারও  হেরেমের নিয়ম-কানুন শেখানোর জন্য দানা হালিলের নেতৃত্বে নতুন দল গঠন করা হয়েছে। তবে এবারের দলে দানা হালিল কিংবা মনজিলার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। কারণ এরা তুর্কির পাশাপাশি টুকটাক রুশ জানলেও মিসরীয় ভাষায় তেমন কিছুই জানে না। আর এ কারণেই এবারের দলটির প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইনারন খাতুনকে। তিনিও মিসরীয়। নতুন কেউ নন। এই হেরেমে এর মধ্যেই কেটে গেছে আট-নয় বছর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে এখানে এসেছিল ইনারন। এখনো শরীরময় যৌবনের ছাপ থাকলেও অভিজ্ঞতায় এগিয়ে গেছেন অনেকের চেয়ে। ইনারন খাতুনকে আগেই সব বুঝিয়ে দিয়েছেন দানা হালিল ও মনজিলা খাতুন। মেয়েদের তুর্কি ভাষা শেখানো হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে নতুন মেয়েদের জন্য সিরকাসিয়ান চিকেন ও শুকনো রুটির তৈরি স্যুপ এমেক পাপারাসি দেওয়া হয়। আর এই খাবার খেতে গিয়েই বেধেছে বিপত্তি। এমনিতে কিছু হতো না হতো। ঘটনাচক্রে মাহিদেভরান সুলতান যাচ্ছিলেন এদিক দিয়েই। তখন মেয়েদের এলোমেলো খাওয়ার ধরন দেখে বেজায় চটেছেন তিনি। এসব নিয়ে ইনারন খাতুনকে বেশ কথা শুনতে হয়েছে। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই মেয়েদের শেখানো হচ্ছে এখানকার খাবার-দাবার গ্রহণের নিয়ম।

এই নিয়মগুলোর প্রায় সবই সাধারণ ভদ্রতার নিয়ম। অটোমান প্রাসাদে স্যুপ, শরবত, সিরাপসহ সব ধরনের তরল শব্দ করে ঢোক গিলে খাওয়া অভদ্রতার শামিল। অবশ্যই নিঃশব্দে পেটের ভিতর চালান করে দিতে হবে। লোভীর মতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে খাদ্য গ্রহণ করা- খাবার গুঁড়ো করা, খাওয়ার সময় সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে দেওয়া এসবই অভদ্রতা হিসেবে মানা হয়। তা ছাড়া খাবার পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়া চলবে না। ধীরে সুস্থে খাবার গ্রহণ করতে হবে। নিজের ডিশ থেকে খাবার না নিয়ে অন্যের ডিশে হাত বাড়ানো চলবে না। আবার পাত্র থেকে খাবার নেওয়ার সময় টেবিলে খাবার পড়ে যাওয়া চলবে না। এসবই নিয়মের লঙ্ঘন। কঠিন শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কোনো প্রকার শব্দ করা ছাড়াই খাবার গ্রহণ করতে হবে। ইনারন খাতুন যখন মেয়েদের এসব বলছিলেন তখনই সেখানে ঝটিকা সফরে হাজির হলেন পারগালি ইব্রাহীম। সঙ্গে দানা হালিল।

‘এই মেয়েরা সব উঠে দাঁড়াও। কুর্নিশ করো। ইনি পারগালি ইব্রাহীম। সুলতান সুলেমানের খাসকামরা প্রধান।’

দানা হালিলের কথা শুনে পেছনে সরে গেলেন ইনারন খাতুন নিজেও। পারগালি ইব্রাহীম তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন হেরেমে আসা নতুন মেয়েগুলোকে। এটাই এখানকার নিয়ম। হেরেমে নতুন কোনো মেয়ে এলে কিংবা সুলতানের জন্য কোনো মেয়েকে তৈরি করলে খাসকামরা প্রধান অথবা সুলতানের মনোনীত ব্যক্তি আগে তাদের পরখ করবেন বা নির্বাচিত করবেন। এরপরই মূলত তাদের সুলতানের সামনে উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হতো। সুলতান সুলেমান খানের কাছে যেতে সেই দায়িত্ব পালন করছেন পারগালি ইব্রাহীম।

‘এই মেয়ে তোমার কী নাম? একটা মেয়েকে ইশারা করে প্রশ্ন করলেন পারগালি ইব্রাহীম। মেয়েটা নিশ্চুপ। পারগালি কিছু বলে ওঠার আগেই মুখ খুললেন ইনারন খাতুন।

‘হুজুর মাফ করবেন। ওরা মিসরীয়। ওদের তুর্কি জানা নেই। আমি এক্ষুনি জানাচ্ছি।’

তারপর মিসরীয় ভাষায় মেয়েটার সঙ্গে কথা বললেন ইনারন।

‘জনাব, ওর নাম রাহিসুন।’

‘মুসলিম?’

পারগালির প্রশ্ন।

আবার বিচিত্র ভাষায় কথা হলো ইনারন আর রাহিসুনের।

‘জি মুসলিম।’

‘আচ্ছা। ওদের দ্রুত তৈরি করো, একেবারে তুর্কি না জানলে কীভাবে হবে? সবার আগে তুর্কি শিখাও।’

‘জি জনাব।’

পারগালির কথার সঙ্গে সায় দিলেন ইনারন। তবে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করলেন না পারগালি। ফেরার পথেই ইসাবেলার সঙ্গে দেখা। মাথা নিচু করে ইব্রাহীমকে সম্ভাষণ জানাল সে।

‘শরীর এখন কেমন?’

পা থেমে গেছে ইব্রাহীমের। ইসাবেলার দিকে তাকিয়ে সহজ প্রশ্ন তার।

‘এই তো হুজুর ভালো।’

মুচকি হেসে জবাব দিলেন ইসাবেলা।

‘হুমম। নিজের খেয়াল রাখতে হবে।’

বলেই হাঁটতে শুরু করলেন পারগালি। সুলতানের খাসকামরা পেরিয়ে প্রাসাদের আর্য ওদাসির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এখানেই সুলতান সুলেমান খানের সিংহাসন রয়েছে। এই কক্ষটি দর্শনার্থীদের কক্ষ হিসেবেও পরিচিত। কয়েকজন খোজা সুলতানের সিংহাসন পরিষ্কার করছিল। মিনিট দুয়েক ওদের কাজ তদারকি করলেন ইব্রাহীম। ভালো মতোন পরিষ্কারের নির্দেশও দিলেন।

এরপরই দিওয়ান ভবন। এখানে উজির ও অন্য  উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কাজ চালালেও ইব্রাহীম এখানে খুব একটা আসেন না। যদিও খাসকামরা প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর অটোমান প্রশাসনের শীর্ষ চার সিলমোহরের একটি তার হাতে, এরপরেও এখান থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন ইব্রাহীম। এর পেছনে একটাই কারণ আহমেদ পাশা। এই লোকটাকে এমনিতেই খুব একটা পছন্দ নয় ইব্রাহীমের। তার গতিবিধি কেমন যেন সন্দেহজনক। তার চেয়েও বড় কথা ইব্রাহীমকে খাসকামরা প্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে সে সহজভাবে নেয়নি। উল্টো এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে। শুধু তাই নয়, একজন ভিনদেশিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায়  সাম্রাজ্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দাবি করে প্রকাশ্যে পারগালি ইব্রাহীম বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। এই তথ্য পারগালি পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগেনি খুব একটা। সব জানার পর পারগালি পীরে মেহমুদ পাশার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। উজিরে আজম বিষয়টি স্বীকারও করেননি আবার অস্বীকার করেছেন সেটিও বলা যাবে না। তিনি দাবি করেছেন তিনি মেহমুদ পাশাকে বুঝিয়ে বলেছেন। কারণ এটি জাহাপনার সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কথা বলা সুলতানের বিরোধিতা করার শামিল। তাই এ ব্যাপারে ফেরাত পাশাকে নাকি চুপ থাকার অনুরোধ করেছেন। পীরে পাশা অবশ্য পারগালিকেও অনুরোধ করেছেন যেন এ বিষয়টা সুলতানের কান পর্যন্ত না গড়ায়।

পারগালি ইব্রাহীম পীরে পাশার কথা রেখেছেন। সুলতান পর্যন্ত যাননি। তবে আরেকটা কাজ করেছেন, সেটা হলো পাশাদের এড়িয়ে চল। বিশেষত ফেরাত পাশাকে। আর খাসকামরা প্রধান হওয়ার সুবাদে ইব্রাহীম সব সময়ই সুলতানের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পান। তাই পাশাদের কাছাকাছি থাকার খুব একটা প্রয়োজনও পড়ে না। দিওয়ান ভবন ও হাস ওদার ঠিক মাঝামাঝি ইব্রাহীমের কার্যালয়। হাস ওদা হচ্ছে তোপকাপি প্রাসাদের ঠিক যে জায়গা পর্যন্ত জনসাধারণের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে সেই এলাকার নাম। ইব্রাহীমের থাকার জায়গা সুলতানের কক্ষের ঠিক পাশে হলেও প্রশাসনিক কার্যালয় এটাই। এখানকার একটি কক্ষে মাতারকচি নাসুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নিজের কক্ষে প্রবেশের পর কিঞ্চিৎ ক্লান্তি অনুভব  করলেন পারগালি। পাগড়িটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর মাথার চুলে হাত বোলাতে লাগলেন। মাথা ঘেমে গেছে। চেয়ারে বসে পারগার কথা ভাবছিলেন ইব্রাহীম।

কে জানে বাবা-মা সবাই কেমন আছে? ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিজের মাতৃভূমি আর আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এই সুদূরে এসে থিতু হয়েছেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শীর্ষ কর্তা। অথচ বাবা-মায়ের খোঁজ জানা নেই।

‘আসতে পারি?

ইব্রাহীমের ভাবনায় ছেদ পড়ল নারীকণ্ঠের আওয়াজে। দ্রুত পাগড়ি ঠিক করতে করতে পারগালি বললেন,

‘আসুন।’

‘তুমি? তুমি এখানে? কী চাই?’

হুররেম খাতুনকে এখানে দেখে যারপরনাই চমকে উঠলেন পারগালি ইব্রাহীম। কিন্তু হুররেম খাতুন সহজ, স্বাভাবিক। যেন পারগালিকে চমকে দেওয়ার জন্যই এখানে আসা।

‘আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আসলাম পারগালি।’

‘কৃতজ্ঞতা? কিসের কৃতজ্ঞতা?’

পারগালির কণ্ঠে তখনো প্রবল বিস্ময়।

‘মিথ্যে বলবো না, প্রথম যখন আপনাকে দেখেছি খুব অপছন্দ করেছি। একদম সহ্য হতো না আপনাকে। কিন্তু পরে যখন আপনাকে জেনেছি তখন তো আপনার প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে আমার।’

বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন হুররেম। কাঁধের আচল সরে পড়ল। সেদিকে খেয়াল নেই তার। দুই বুকের সন্ধিস্থল পর্যন্ত ঘুরে আসে পারগালি ইব্রাহীমের চোখ।

‘চুপ করো। কী সব বলছো। তুমি জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?’

‘মাফ করবেন পারগালি। আমি জানি আপনি খাসকামরা প্রধান। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে আমার মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছি। আমি আপনাকে ছোট করতে চাইনি।’

হুররেমের কণ্ঠে প্রবল আঁকুতি। ঠোঁট বাঁকিয়ে কামরার চাহনি ইব্রাহীমের দিকে। ইব্রাহীমও ঠিক বুঝতে পারছে না মেয়েটা আসলে কী চাচ্ছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ধমক দিয়ে বিদায় করে দিত। কিন্তু এই মেয়েটার চাহনিতে কী যেন আছে। এখন টের পাচ্ছে সুলতান কেন বার বার এর কথা বলেন।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এখন যাও। এখানে আর কখনো আসবে না। আমার সঙ্গে দরকার থাকলে দানা হালিলকে বলে হেরেমের ভিতর দেখা করবে। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে। কিন্তু জানতে চাইবেন না কেন ধন্যবাদ দিতে এসেছি?’

‘কেন? বল তো?’

ইব্রাহীম আগ্রহভরে জানতে চায়।

‘কারণ আপনি আমাকে সুলতানের কক্ষের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। এটা জানার পর আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ভালোবাসা বেড়ে গেছে।’

‘ও আচ্ছা।’

ইব্রাহীম আর কোনো কথা বললেন না।

‘যদি কখনো আপনার কোনো রকম কাজে আসতে পারি তাহলে বলবেন।’

হুররেমের কথা বলার সুরটাই যেন কেমন লাগছে ইব্রাহীমের কাছে। মেজাজ খারাপ হলেও মেয়েটাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। আবার মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফেরানোও কঠিন।

ইব্রাহীম হাঁ করে হুররেমের সৌন্দর্যের গলি ঘুপচি মাপছিলেন। হুররেম তখন হুট করেই ইব্রাহীমের ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেল।

এরপর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বলল,

‘জনাব পারগালি— এটা আমার ধন্যবাদ। আপনার প্রাপ্য ছিল। আপনি নিজের কথা না ভেবে আমাকে জাহাপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আবার জাহাপনার কাছে যাওয়ার কারণে আপনি কখনো আমায় চাইতে পারবেন না। তাই ভাবলাম প্রকাশ্যে না হোক আড়ালে অন্তত আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাই। সঙ্গে এটাও বলে দিতে চাই আপনি ডাকলে আমি হাজির। এটা হোক প্রকাশ্যে বা হোক আড়ালে। কোনো বেয়াদপি হলে মাপ করবেন।’

আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করল না হুররেম। পারগালি ইব্রাহীম পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক। মেয়েটার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। কী প্রবল আত্মবিশ্বাসরে বাবা!

পারগালি ইব্রাহীম ভাবে আর অবাক হয় এই মেয়ের সাহস আর কথা বলার ধরন দেখে। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সঙ্গে এই মেয়েটা যথেষ্ট নির্লজ্জও! আর এটাই বেশি ভাবাচ্ছে ইব্রাহীমকে। কারণ আর কেউ না জানলেও পারগালি জানেন এই মেয়েটার জন্য সুলতানের মনে এর মধ্যেই একটা জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। আর এ যদি কোনোভাবে শাহজাদার মা হয়ে পড়ে তাহলেই বিপদ। ভয়ঙ্কর মেয়ে!

 

 

‘মোস্তফা দুষ্টুমি করো না। সারার কাছে যাও। আমি ফুপুর সঙ্গে কথা বলছি।’

মোস্তফার লাফালাফি থামাতে বললেন মাহিদেভরান সুলতান। পাশেই বসে আছেন হেতিজা।

‘হেতিজা সুলতান কিছু মনে করবেন আপনি এমন মন খারাপ থাকলে কিন্তু একদম ভালো লাগে না।’

মাহিদেভরানের কথায় কৃত্রিম রাগের ছাপ স্পষ্ট। হেতিজা মৃদু হাসলেন। এরপর মুখ খুললেন—

‘আমার কপাল এত খারাপ কেন বলতে পারেন মাহিদেভরান?’

‘মন খারাপ করবেন না হেতিজা। নিশ্চয়ই আপনার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। নইলে আপনার সঙ্গে এমন কেন হবে?’

‘আমারও তো সেটাই কথা। আমার সঙ্গে এমন কেন হলো? কী অন্যায় করেছি আমি? আমার কপাল এত খারাপ কেন?

হেতিজার চোখ থেকে টপাটপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ঘুরে বসে জামার আস্তিন দিয়ে সে পানি মুছে দিলেন মাহিদেভরান। মাথায় হাতও বুলিয়ে দিলেন। তারপর হেতিজার থুতনিতে হাত দিয়ে চেহারাটা উপরের দিকে তুললেন। বললেন,

‘তাকান এদিকে। হেতিজা তাকান।’

হেতিজা চোখ উপরে তুলে ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকালেন।

‘আপনি  জানেন আপনি কতটা সুন্দরী। আপনি কাঁদলে চারপাশ একেবারে বিষণ্ন হয়ে ওঠে। আপনার মন খারাপ থাকাটা একদমই মানায় না। আপনি তো বুড়ো হয়ে যাননি। অটোমান সাম্রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যা আপনি মহামান্য সুলতান সুলেমান খানের বোন। আপনার জন্য অবশ্যই সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’

পেছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন বেগম সুলতানা। মাহিদেভরানের কথা শেষ হতে না হতেই হেতিজার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

‘কী হয়েছে আমার মামণির? সব ঠিক হয়ে যাবে। খুব শিগগির আমি সুলেমানের সঙ্গে আলাপ করব। আমি আবার তোমার বিয়ে দেব। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘না আম্মা। আমি আবার বিয়ে বসতে চাই না।’

‘পাগলের মতো কথা বলো না হেতিজা। তোমার জীবনের পুরোটাই এখনো বাকি। এই গোটা জীবন একা একা কী করে কাটাবে। আমি সুলেমানকে  আজই বলব। তোমার জন্য একটা যোগ্য সঙ্গী খুঁজে বের করতে সব নতুন করে শুরু করো, দেখবে আর খারাপ লাগছে না।’

সুলতান সেলিম খানের ইচ্ছায় বিয়ে হয়েছিল হেতিজার। কিন্তু বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় স্বামীর অকাল মৃত্যু হেতিজাকে বিধবা করে দেয়। এরপর থেকেই বিষণ্ন্নতা আর একাকীত্বকে পুঁজি করে তোপকাপি প্রাসাদে নিজের কষ্টমুখর দিনগুলো পার করছেন হেতিজা। আর তাকে ঘিরে বেগম সুলতানা, সুলতান সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের শীর্ষ কর্তাদের চিন্তার কোনো কমতি নেই। সবার একটাই আশা হাসি-খুশি চঞ্চল সেই পুরনো রাজকুমারী যেন ফেরত আসে। কিন্তু আদৌ সেটা সম্ভব কিনা জানে না খোদ হেতিজাও।

 

 

সার্বা সালেকীনের কাছে পাকা খবর আছে ভ্যাটিকান সিটির পাদ্রি সুলতান সুলেমানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। এই তথ্য জানার পর সুলেমান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সার্বা সালেকীনের আর্জি একটাই সুলেমান যেন সাবধানে থাকেন। নইলে যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে। এ কথা শোনার পর আর ঠিক থাকতে পারলেন না সুলতান। উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে হুংকার করে উঠলেন তিনি।

‘ভ্যাটিকানের ঐ শয়তানগুলো আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। ওরা জানে না ওরা আসলে নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনছে। এই তরবারি ঐ শয়তানগুলোর রক্তে যেদিন গোসল করবে সেদিন আমি শান্তি পাব।’ ‘নিশ্চয়ই জাহাপনা। ইনশাআল্লাহ আপনার বিজয় হবে। ’

সুলতানের কথায় একমত পোষণ করলেন গুপ্তচর সার্বা সালেকীন। ক’দিন আগেও সুলেমানের বার্তা বাহক ছিল সে। বিশ্বস্ত হওয়ার কারণে তাকে অটোমান গুপ্তচর দলের প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে। হাঙ্গেরি, ভ্যাটিকান সিটি, ইরান, রোডস এমনকি প্রাচ্যেও অটোমান গুপ্তচর রয়েছে। এদের কাজ হচ্ছে ওখানকার সামগ্রিক অবস্থা এবং অটোমান সুলতান সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর শত্রু রাষ্ট্রগুলো নতুন কোনো ষড়যন্ত্র করছে কিনা সেই তথ্য সুলতানের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আর সুলতানের হয়ে পুরো কাজটি সমন্বয় করেন সার্বা সালেকীন। আজ তাই তার কাছ থেকে এমন খবর শুনে অনেকটাই উত্তেজিত সুলেমান।

‘সার্বা সবদিকে খবর পাঠাও। সর্বশেষ গুপ্ততথ্য আমার চাই। আমি বিশ্ব মানচিত্রে রাজত্ব করতে চাই। আলেকজান্ডারের মতো বিশ্বের  একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। মনে রেখ ইরানের শাহ ইসমাইল আমার শত্রু নয়। কিন্তু উল্টা পাল্টা কিছু হলে তাকেও ছেড়ে কথা বলব না। ভ্যাটিকানের শয়তানগুলোকে পারলে চিবিয়ে খেতাম। তবে সব ছাপিয়ে আপাতত আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে রোডস। সবার আগে রোডসের দখল নেব আমরা। অটোমানদের ন্যায় ও সুবিচারের ঝাণ্ডা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। গোটা ভূমধ্যসাগর এক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমাদের কথা ছাড়া কোনো জাহাজ পাল তুলবে না। আবার আমাদের হুকুম ছাড়া কোনো জাহাজ নোঙরও করবে না। সাগরের প্রতিটা জলরাশি অটোমানদের নিয়ম মেনে চলবে।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুলেমানের কথা শুনছিলেন সার্বা সালেকীন, পীরে মেহমুদ পাশা এবং হাসান জাং। সুলতানের কথায় সবার শরীরের লোম কেমন যেন খাড়া হয়ে গেছে। উত্তেজনার একটা শীতল স্রোত বয়ে গেছে গোটা শরীর জুড়ে। সেই উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সম্ভবত সার্বা সালেকীনের মধ্যে। এ কারণেই সবার আগে সুলতানের জ্বালাময়ী কথার জবাবে মুখ খুলল সেই।

‘হুজুর আপনি একদম ঠিক করেছেন। মহামান্য সুলতান সেলিম খানের স্বপ্ন পূরণ তো বটেই, আপনার হাতে অটোমান সাম্রাজ্যের নতুন সূর্যোদয় হয়েছে। এবার কেবল আলো বিকিরণের পালা।

‘একদম ঠিক!

ইনশাআল্লাহ মহামান্য সুলতান সুলেমান খানের নেতৃত্বে আমরা সাফল্যের নতুন জোয়ারে ভাসব। অনেকক্ষণ চুপ ছিলেন পীরে মেহমুদ পাশা। সুলতানের মুখ থেকে জ্বালাময়ী কথা শোনার পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। শেষ বয়সে এসেও তাই তরুণের মতোই তার দৃঢ় উচ্চারণ। সুলতান সুলেমান খান জানেন তার এই হুংকারের খবর ঠিক বিদেশিদের কাছে পৌঁছে যাবে। সুলেমান যদি এখানে বসে বিদেশিদের খবর পেতে পারেন, ঠিক তেমনি অন্যরা কেন অটোমানদের খবর পাবে না? নিশ্চয়ই এখানে এমন কেউ না কেউ আছে যে প্রাসাদের খবর বাইরের দুনিয়ায় পাচার করে। সুলেমানের ভীষণ ইচ্ছা বিপক্ষ দলের কোনো গুপ্তচরকে হাতেনাতে ধরা। এই ব্যাপারটা নিয়ে পারগালির সঙ্গে কথা বলতে হবে। তোপকাপি প্রাসাদের ভিতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে খোঁজ লাগাতে হবে। সুলতানের নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নেও বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

সুলেমানের নিরাপত্তা বিদেশিদের ষড়যন্ত্র আর গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে মাতরাকচি নাসুর সঙ্গে আলাপ করেছে ইব্রাহীম। মাতরাকচি লোকটার মাথায় বুদ্ধি আছে মানতেই হবে। ইব্রাহীমের জটিল জঠিন কতগুলো প্রশ্ন ও সমীকরণ খুব সহজেই মিলিয়ে দিলেন মাতরাকচি। এতে করে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিংবা লুকিয়ে থাকা শত্রু খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে সেজন্য একজন মানুষকে ঠিক মাতরাকচির মতো বুদ্ধিমান না হলেও একটু সতর্ক থাকলেই চলবে। অটোমান সাম্রাজ্যের একমাত্র শাহজাদা মুস্তাফা এসেছেন ইব্রাহীমের কাছে। সঙ্গে মোস্তফার রক্ষণাবেক্ষণকারী রক্ষী মুহসিন আর রব। ‘ইব্রাহীম তুমি এখানে কী করছ? আমি তোমাকে সারা প্রাসাদ  খুঁজে খুঁজে  হয়রান।’

‘কেন শাহজাদা? আমি বাবার কাছে যাব। আমাকে কেউ বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছে না।’

‘কিন্তু শাহজাদা সুলতান তো এখন জরুরি কাজে ব্যস্ত। আপনি তো তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।’

শাহজাদা মোস্তফাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পারগালি ইব্রাহীম। মোস্তফা তবু নাছোড়বান্দা।

‘না ইব্রাহীম। আমি তোমাকে খুঁজে বের করেছি। এখন তুমি আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাও। না হলে চলো আমার সঙ্গে খেলবে। আর ইনি কে?’

মাতরাকচি নাসুর দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করল মুস্তাফা।

‘ ইনি মাতরাকচি নাসু। বিশাল পণ্ডিত এবং লেখক।’

‘উনি কী করেন?’

প্রশ্নে প্রশ্নে ইব্রাহীমকে জর্জরিত করে তুলছে মোস্তফা।

‘উনি লিখেন, ছবি আঁকেন।’

‘তাহলে আমার একটা ছবি এঁকে দাও। আমি হুকুম দিচ্ছি আমার একটা ছবি এঁকে দাও।’

‘শাহজাদা- এভাবে বলতে নেই। উনি গুরুজন। বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই।’ [চলবে]

পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর