শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান - পর্ব ১৯

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান - পর্ব ১৯

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি।

সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। এই শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ১৯তম পর্ব।

 

[পূর্ব প্রকাশের পর]

 

এই মুহূর্তে কনস্টান্টিনোপলের সবচেয়ে ব্যস্ত লোকটির নাম পারগালি ইব্রাহিম। এই মাটির সোঁদা গন্ধ অন্যদের মতো তাকে মাতাল করে না। এখানকার আকাশ-বাতাস তার প্রেম নাকি অভ্যাস জানে না সে নিজেও। তবে সুলতানের প্রতি তার আনুগত্যটা চিরন্তন। এর কোনো ব্যত্যয় কখনই ঘটবে না হয়তো। সুদূর পারগা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাচক্রে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী সুলেমানের সঙ্গে পরিচয়। সেই সুলেমান যখন সিংহাসনে বসলেন তখন সবচেয় বড় চমকটা ইব্রাহিমকে ঘিরেই। খাস কামরা প্রধান, অটোমানদের শীর্ষ চার সিলমোহরের একটি। অটোমানদের ইতিহাস সাক্ষী দেয় পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক ও স্থানীয় নাগরিক ছাড়া এমন গুরু দায়িত্ব কখনই কোনো বিদেশিকে দেওয়া হয়নি। ইব্রাহিমই অনেক দিনের নিয়ম ভেঙে এই দায়িত্বে আসীন হয়েছেন। দিন যত যাচ্ছে ইব্রাহিমের প্রতি সুলতানের নির্ভরশীলতা বাড়ছে বৈ কমছে না। আবার এই মুহূর্তে রোডস অভিযান নিয়ে পুরো প্রাসাদ যেখানে পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত দিনাতিপাত করছে, সেখানে যুদ্ধ ছাপিয়ে ব্যক্তিগত নানা বিষয়ও গভীর ছাপ ফেলছে। এসব বিষয় নিয়ে সুলতানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। মাহিদেভরান সুলতানের সঙ্গেও মন খুলে কথা বলা সম্ভব নয়। আর এই প্রাসাদে পারগালির বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই। নিজের কক্ষে বসে এলোমেলো ভাবনার কলকাঠি নাড়ছিলেন তিনি। মাহিদেভরান সুলতানের দেওয়া একটা কাফতান উল্টে-পাল্টে দেখছিলেন। তখনই বাইরে থেকে কেউ একজন বলে উঠল—

‘আসতে পারি পারগালি।’

‘নিশ্চয়ই মাতরাকটি। আমি মনে মনে আপনাকেই খুঁজছিলাম।’

‘কিন্তু মুহতারাম আমি তো আর মনের ডাক্তার নই, যে মনে মনে ডাকলে ছুটে আসব। কেবল একটু ডাকবেন অধম হাজির হয়ে যাবে!’

‘আপনার সঙ্গে কথার লড়াইয়ে যাওয়া বোকামি মাতরাকটি। বসুন।’

হাসতে হাসতে মাতরাকটি নাসুকে আসন গ্রহণ করতে বললেন পারগালি। মাতরাকটি নিজের হাতের সব কাগজপত্র সামনের টেবিলে রেখে দিলেন। পাগড়িটি খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে মুখ খুললেন মাতরাকটি।

‘তা জনাব আমাকে স্মরণ করেছিলেন ঠিক কী কারণে?

‘কারণটা ব্যক্তিগত-মাতরাকটি।’

‘আমিতো ভেবেছিলাম যুদ্ধসংক্রান্ত।’

‘কেন, যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যক্তিগত কিছু ঘটা বন্ধ নাকি?

‘আমি কিন্তু তেমন কিছু বলিনি পারগালি।’

‘হুম। মাতরাকটি আপনি জানেন এই প্রাসাদে এবং এখানকার আশপাশে আমার কোনো বন্ধু বা শুভার্থী নেই। কিন্তু তাই বলে আমার ব্যক্তিগত জীবন থাকবে না তা কিন্তু নয়।’

‘আলবৎ জনাব। ব্যক্তিগত জীবন আপনার থাকতেই পারে। তবে স্বয়ং সুলতান সুলেমান খান যার বন্ধুপ্রতিম ভাই, তার কি আর বন্ধুর দরকার পড়ে জনাব?’

‘মাতরাকটি, আপনি অন্তত এমন করে বলবেন না। আপনাকে বন্ধু ভেবেই কিন্তু এসব কথা বলতে চাচ্ছি।’

‘কিন্তু আপনার আচরণে তো সেটা মনে হচ্ছে না।’

একটু অবাক হলেন পারগালি। মাতরাকটি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন?

‘কেন কী হয়েছে মাতরাকটি?’

‘মুখে বন্ধু বলছেন। কথা হচ্ছে কেবল আপনার আর আমার মধ্যে অথচ আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন। এটা নিশ্চয়ই বন্ধুত্বের সম্বোধন নয়।’

পারগালির ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির ছোট্ট একটা রেখা দেখা গেল। মিষ্টি পানীয়র পাত্রটি মাতরাকটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—

‘আপনার তো কিছুই বলেননি।’

‘আমি কী করে বলি হুজুর? আপনি জাঁহাপনার খাসকামরা প্রধান। পদবিঘটিত কারণেও কিন্তু আমি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি না।’

‘এখন থেকে পারবেন। আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম মাতরাকটি। আজ থেকে আমি তোমাকে আমার সেরা বন্ধুর মর্যাদা দিলাম।’

‘এই অধম দাসকে আপনি—

পারগালির চোখের ইশারায় পাল্টে গেল মাতরাকটির সম্বোধন।

‘মানে তুমি আমাকে আরও বেশি ঋণী করে দিলে পারগালি। এই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?’

‘বন্ধুত্বে কোনো ঋণ হয় না মাতরাকটি।’

পারগালি নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে মাতরাকটির কাঁধে হাত রাখলেন। এরপর খুলে দিলেন ব্যক্তিগত দ্বিধার জঞ্জাল। হুররেম খাতুনের অদ্ভুত আচরণ, ইসাবেলার প্রসঙ্গ, সবই এলো আলোচনায়। হুররেম গোপনে দেখা করেছে ব্যাপারটা কীভাবে যেন টের পেয়ে গেছেন মাহিদেভরান। তিনি বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। এরপরও পারগালির জন্য উপহার হিসেবে দারুণ এই রাজকীয় কাফতান দিয়ে গেছেন নিজে এসে। এদিকে পারগালির প্রিয়ভাজন সুরুর সায়রা ওকে ভুল বুঝে বসে আছে। শুধু তাই নয়, ইসাবেলাকে সে রীতিমতো হুমকি দিয়ে রেখেছে যেন সে খাসকামরা প্রধানের কাছে না ঘেঁষে। এটা আবার কানে গেছে মনজিলা খাতুনের। তিনিও পারগালিকে বলেছেন এর একটা বিহিত করার জন্য। এদিকে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সুলেমান হাজারটা কাজ দিয়ে রেখেছেন। নতুন করে অস্ত্র আর জাহাজ তৈরির তদারকিও করতে হচ্ছে। হুটহাট আবার পারগার কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার জন্যও মনটা কেঁদে কেঁদে উঠছে। সব মিলিয়ে পারগালি ইব্রাহিমের মন কতটা বিচ্ছিন্ন সেটাই তুলে ধরলেন মাতরাকটির সামনে। সব শুনে খানিক চুপ থাকলেন মাতরাকটি। তারপর গুনে গুনে তিনটা প্রশ্ন করলেন পারগালিকে। উত্তর পাওয়ার পর পারগালির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। পারগালির চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। কী বলছেন মাতরাকটি? সময়ই বলে দেবে সেটা।

 

‘হুররেম, তুমি এখন আসতে পার।’

‘হুজুর আমায় মাফ করে দিন। আমি বুঝতে পারিনি। আমার এভাবে আসা একদম ঠিক হয়নি। আসলে আপনাকে এত বেশি দেখতে ইচ্ছা করছিল যে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না।’

‘তুমি এখন যাও। নইলে রক্ষীদের ডাকব।’

পেছনে ফিরে কড়া ভাষায় হুররেমকে বেরিয়ে যেতে বললেন সুলেমান। হুররেম আর দেরি করলেন না। সুলেমানের এমন রেগে যাওয়ার কারণও বুঝতে পারলেন না। বারোটা বেজে গেল দানা হালিলের। অনুমতি ছাড়া হুটহাট কেউ কক্ষে প্রবেশ করলে তার গর্দান যাবে। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন সুলেমান। গত চার দিন ধরে হেরেমে স্ত্রী-মায়ের সঙ্গে দেখা নেই। তার দিনরাত কেবল রণ পরিকল্পনা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে। ব্যাপারটা জানেন না আয়েশা হাফসা সুলতানও। কিন্তু এরপরও এতদিন ছেলেকে না দেখতে পেয়ে অনেকটাই উতালা হয়ে উঠেছেন তিনি। এদিকে সুলেমানের বিক্ষিপ্ত ভাবনা স্বপ্ন আলোচনা আর চর্চার পুরোটাজুড়েই রোডস। রোডস ছাড়া আপাতত আর কোনো ভাবনা নেই তার। আপন মনে মাতরাকটির সরবরাহ করা ভূমধ্যসাগরের নতুন মানচিত্র ও রাস্তা পরিকল্পনা খুঁটিয়ে দেখছিলেন সুলেমান। তখনই একজন রক্ষী এসে হাজির।

‘জাঁহাপনা, ক্ষমা করবেন। বেগম সুলতান এসেছেন আপনার সাক্ষাত্প্রার্থী।’

‘আম্মা? এখানে। আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন সুলেমান। বেগম সুলতান ঢুকতেই এগিয়ে গেলেন সুলেমান।

‘আম্মা আপনি এখানে?’

‘সুলেমান-বাবা, তুমি কেমন আছো? কত দিন তোমাকে দেখিনি—।’

বেগম সুলতানাকে পাশে বসালেন সুলেমান। নিজের ব্যস্ততার কথা জানালেন। বেগম সুলতানা ছেলের জন্য মন খুলে দোয়া করলেন। বলে দিলেন শরীরের প্রতি যেন যত্ন নেয়। মাহিদেভরান আর মোস্তফার কথাও মনে করিয়ে দিলেন। সুলেমান শুধু বললেন রোডস অভিযানই এখন তার ধ্যান-জ্ঞান।

 

সবার সঙ্গে হুররেম খাতুনের ব্যবহারের দারুণ পরিবর্তন হয়েছে। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে হুররেমের এই নাটকীয় পরিবর্তন।

এই পরিবর্তনের মাঝেই সায়রার সঙ্গে হালকা বাকবিতণ্ডা হয়ে গেছে হুররেমের। বিষয় আগেরটাই। পারগালি ইব্রাহিম এবং ইসাবেলা প্রসঙ্গ। হুররেমের কথা হচ্ছে পারগালি ইব্রাহিম জাঁহাপনার খাসকামরা প্রধান। স্বয়ং সুলতান তাকে হেরেমের সুবিধা দিয়েছেন। কাজেই সুরুর সায়রা ইসাবেলাকে কোনোভাবেই হুমকি দিতে পারে না। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সেখানে হাজির দানা হালিল। সে দুই পক্ষকে দুইদিকে ঠেলে দিল। সঙ্গে এও বলে দিল বিষয়টি সে পারগালি ইব্রাহিমকে জানাবে।

হুররেম রাগে ফুসফুস করছিল—কিন্তু কোনো কথা বলল না। নিজের ডেরায় ফিরেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল হুররেম।

‘এর একটা বিহিত করতেই হবে।’

‘মাথা গরম কর না হুররেম।’

ইসাবেলার কথা হুররেমের কানে ঢুকেছে বলে মনে হলো না। হুররেমের চোখের কোণে তীব্র ক্ষোভ। আবার ঠোঁটের কোনো মৃদু হাসি।

‘কী ভাবছ হুররেম।’

‘না— কিছু না। পারগালির সঙ্গে দেখা করা দরকার। ’

‘আমি শুনলাম পারগালির নাকি জ্বর হয়েছে। আজ আর এদিকে আসবেন না।’

‘তাই?’

হুররেমের দুই চোখ চকচক করছে। কদিন হলো সুলেমানের সঙ্গেও দেখা হচ্ছে না। আর পারগালিকে বাগে আনতে না পারলে কোনো দিক দিয়েই কিছু হবে না। মাথার ভিতর দুষ্টু চিন্তা চক্কর কাটছে। একবার ভাবল ইসাবেলাকে বলে দেবে। পরক্ষণেই মত পাল্টে ফেলল। ইসাবেলা মেয়েটা আস্ত ভীতুর ডিম। ওকে দিয়ে কিছু হবে না। বলা সত্ত্বেও সে ব্যাপারটা কোনোমতেই হজম করতে পারবে না। আর তাই তার সঙ্গে এটা বলার চেয়ে না বলাই উত্তম মনে করল হুররেম। মাথার ভিতর একটাই চিন্তা, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো যায় কী করে?

 

এইমাত্র খানিকটা জ্বর কমে এসেছে খাসকামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহিমের। হেকিম মালিদ আগা এসে পরখ করে গেছেন। বলে গেছেন দু-একদিনের মধ্যেই সেরে উঠবেন ইব্রাহিম। আপাতত নিজের ঘরে একেবারেই একা সে। অবশ্য দানা হালিল নিজে থাকতে চেয়েছিল। ইব্রাহিমই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে—অন্য কারও থাকার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছে সে। অবশ্য কিছুক্ষণ পরপর মাতরাকটি এসে খবর নিয়ে যাচ্ছেন। আপাদমস্তক সুঠামদেহী পারগালির ইব্রাহিম খুব কমই শারীরিক পীড়ায় ভোগেন। বলা চলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দারুণ। কাজের চাপ আর মানসিক প্রশান্তির কারণেই এবারের অসুস্থতা। এমনটাই ধারণা পারগালি ইব্রাহিমের।

রাত গভীর হচ্ছে। বাইরের সুনসান নীরবতা আর ভিতরের মিটমিটে আলোর ভিতর ইব্রাহিমের নির্ঘুম চোখ যেন নিঃসঙ্গতার গলি ঘুপচি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় বাবা, কোথায় মা। কোথায় প্রিয় ভাই আছে কে জানে? সবাইকে হারিয়ে কোথায় এসে দাসত্বের জীবন বেছে নিল ইব্রাহিম। ভাগ্যের কী মধুর নির্মম পরিহাস! একদিকে নিজের শেকড়ের সঙ্গে বিচ্যুতি অন্যদিকে আবার শীর্ষ অটোমান সিলমোহর অর্জন। জীবন সত্যি বড় বিচিত্র। জীবনের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে বার বার অসমাপ্ত ফলাফল আসে ইব্রাহিমের। সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। এরপরও বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া আর কী—ইবা করার আছে?

তখন ঘুম আসি আসি করছিল। ইব্রাহিম সটান হয়ে শুয়ে আছেন। কোথাও হালকা পায়ের শব্দ শোনা গেল। সুলতানের পাশে দীর্ঘদিন থাকার কারণে চোখ-কান খোলা রাখতে হয় ইব্রাহিমের। তাই অনেক সূক্ষ্ম আওয়াজও খুব দ্রুতই কানে চলে আসে তার। শব্দ শুনে কান খাড়া হলো বটে কিন্তু চোখ খুলতে পারল না। ইব্রাহিমের শরীর তাকে সে অনুমতি দিল না। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিঃশ্বাসের সঙ্গে একটা মিষ্টি সুগন্ধি পেল ইব্রাহিম। এই ধরনের সুগন্ধি হেরেমের বিশেষ রমণীরা ব্যবহার করে। এবার আর ঠিক থাকা গেল না। শরীরের অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছার বিরুদ্ধে চোখ খুললেন পারগালি। চোখ খুলতেই অবাক। একটা কালো আলখাল্লা জড়ানো নারীমূর্তি ইব্রাহিমের ঠিক সামনে ঝুঁকে দাঁড়ানো। ইব্রাহিম কিছু বলতে যাবে তখনই তার মুখে হাত চেপে ধরল সেই নারীমূর্তি।

‘চিৎকার করবেন না পারগালি। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’

কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগছে ইব্রাহিমের। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। অন্য সময় হলে জোর খাটিয়ে তাকে কুপোকাত করে ফেলতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় লাগত ইব্রাহিমের। টেনে তুলতেই ইচ্ছা করছে না। মেয়েটার হাত তখনো পারগালির মুখে চেপে ধরা। মেয়েটা আর মুখের পর্দা সরাতেই চোখ দুটো চকচক করে উঠল।

‘হুররেম!’

ইব্রাহিমের মুখের কথা মুখেই রইল।

‘পারগালি চিৎকার করবেন না। শুনলাম আপনি অসুস্থ তাই দেখতে চলে এলাম। আর দয়া করে রক্ষী ডেকে, একে ওকে জাগিয়ে নিজের সম্মান নষ্ট করবেন না। এমনিতেই মাহিদেভরান জেনে গেছেন আমি আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করি। এমনকি এখন যে এলাম সেটাও তিনি জেনে যাবেন—আপনি একটু বোকামি করলেই। আশা করছি আপনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমার কথা শুনবেন।’

বলেই পারগালির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন হুররেম।

‘কিন্তু হুররেম এটা অন্যায়।’

‘আপনার কাছে আমার কাছে নয়।’

‘মানে ঠিক বুঝলাম না।’

পারগালি উত্তেজিত হওয়ার চেষ্টা করছে—কিন্তু পারছে না।

‘মানে, ন্যায়-অন্যায় মানুষের মনের ভিতর বাস করে। আপনি যেটাকে অন্যায় বলছেন আমার কাছে সেটা কৃতজ্ঞতা অথবা ধরুন গোপন ভালোবাসা।’

‘কী?’

ভালোবাসা শব্দটা শোনার পর আর ঠিক থাকতে পারলেন না পারগালি। আর তাই আওয়াজটা একটু জোরেই হয়ে গেল। এর মধ্যেই পাশের ঘর থেকে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন মাতরাকটি নাসু।

‘বন্ধু— কোনো সমস্যা। আমি আসব?’

‘না মাতরাকটি। তুমি শুয়ে পড়। আমি ঠিক আছি।’

‘আচ্ছা— কোনো সমস্যা হলে ডেক কিন্তু।’

‘অবশ্যই।’

মাতরাকটির চলে যাওয়া নিশ্চিত হতেই অন্ধকারে দাঁড়ানো হুররেম আবারও সপ্রভিতও হয়ে উঠলেন। এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

‘দরজা বন্ধ করছ কেন?

অনেকটা ফিসফিস করে বললেন ইব্রাহিম।

‘ভয় লাগছে?

পাল্টা প্রশ্ন করেই ফিক করে হেসে দিলেন হুররেম,

‘না, ভয় পাব কেন?’

দরজা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না পারগালি।

হুররেম পাশের আলমারির সামনে রাখা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। হ্যাঁচকা টানে আলখাল্লাটা খুলে টেবিলে রাখলেন।

আবছা আলোয় আড়চোখে সেদিকে থাকিয়ে হুররেমের কাণ্ড দেখছেন ইব্রাহিম।

আলখাল্লা খুলে ফেলার পর হুররেমকে যে পোশাকে দেখা গেল তাকে পোশাক না বলে অন্তর্বাস বলাই শ্রেয়। ভালোমতো তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে এলো ইব্রাহিমের, ফিরিয়ে নিলেন চোখ। মেয়েটাকে কিছু বলেও কাজ নেই। মনে মনে ভাবলেন ইব্রাহিম। এর মধ্যেই এগিয়ে এসে প্রদীপের আলোটা খানিক বাড়িয়ে দিলেন হুররেম। সে আলোয় আরেকবার হুররেমের দিকে চোখ গেল পারগালির। এখন আঁধার কালো চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়েছেন হুররেম। ইব্রাহিমের বুক দুরু দুরু কাঁপছে। এমন অসহায়ত্ব আর উত্তেজনা কখনো অনুভব করেনি সে। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। আপাতত সে নিজেও টের পাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা হুররেমের নিয়ন্ত্রণে। মাতরাকটির শেষ কথাগুলো কানে বাজছে পারগালির। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজকীয় মন নিয়ে চলতে গেলে এমন অনেক কিছুই মেনে নিতে হবে যা মন চাইবে না। পরে হয়তো সেটাই কাজে দেবে। এমন কি হুররেমকে ইঙ্গিত করেও মাতরাকটি বলেছিলেন এরকমই একটা কথা। এই হুররেম যদি পরবর্তীতে সুলতানের সন্তানের মা হয়ে যান তাহলে কিন্তু দাবার ঘুঁটি উল্টে যাবে। কিন্তু সুলেমান? তিনি যদি জেনে যান তাহলে? ইব্রাহিম আঁতকে ওঠে। ইব্রাহিমের ভাবনায় ছেদ পড়ে হুররেমের কথায়।

‘জ্বর কমেছে?’

ইব্রাহিমের কপালে হাত রাখতেই সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল।

‘ভয় পাচ্ছেন?

‘নাহ!’

ঢোক গিলতে গিলতে বললেন পারগলি। হুররেম আবার হাসে। টেবিল থেকে একটা কাসার পাত্র বের করে এগিয়ে দেয় ইব্রাহিমের দিকে।

‘খাবেন?’

‘কী ওটা?’

‘আঙুরের রস।’

‘সুরা।’

‘হুম।’

‘না, খাব না।’

ইব্রাহিমের উত্তর শুনে আবার হাসে হুররেম। ‘আমি বিষ মেশাইনি। আপনি খেলে আমি আগে খেয়ে দেব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবেন।’

পারগালি কোনো উত্তর দিলেন না। হুররেম এক চুমুক দিয়ে পাত্রটা বাড়িয়ে দিলেন ইব্রাহিমের দিকে।

‘নিন। জ্বরের সময় এটা বেশ কাজে দেয়।’

আধশোয়া হয়ে পাত্রটা হাতে নিলেন ইব্রাহিম।

‘কিন্তু এটা তুমি কোথায় পেলে?’

‘আমার কাছে ছিল। হালিমের নেসাকে মোহর দিলেই দিয়ে যায়। ভাবলাম আপনার জন্য একটু নিয়ে যাই। খাচ্ছেন না যে?’

ইব্রাহিমের মনে দ্বিধা। বুদ্ধিমতী হুররেম সম্ভবত সেটা বুঝতে পারলেন। ইব্রাহিমের হাত থেকে পাত্রটা হাতে নিয়ে ঢক করে আরও কিছুটা গলার ভিতর পাচার করে দিল। সে।

‘এবার খান।’

পারগালি বাকিটুকু একেবার ঢেলে দিলেন।

‘তুমি এটা খাওয়া কোথায় শিখলে?’

পারগালির চোখে বিস্ময়।

‘আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন আমি পাদ্রির মেয়ে। আমাদের সমাজে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার।’

‘ও।’

কিছুক্ষণ নীরব কাটল। হুররেম টেবিল থেকে আরও কিছুটা পানীয় ভরে নিলেন।

‘বসতে দেবেন না?’

এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন হুররেম।

ব্যাপারটা একদমই খেয়াল করেননি পারগালি। এবার নিজে খানিকটা সরে গিয়ে হুররেমকে জায়গা করে দিলেন। হুররেম পাশে বসে আরেকবার পারগালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ইব্রাহিমের শরীর আস্তে আস্তে চাঙ্গা হচ্ছে। এমনকি হুররেমের শরীরের মাদকতাময় ঘ্রাণটা এখন আর দ্বিধা কিংবা ভয়ের উদ্রেক করছে না। উল্টো উত্তেজনা তৈরি করছে পারগালির মনে। এই ব্যাপারটা টের পেয়েই কিনা কে জানে জড়ানো কালো কাপড়টা টেবিলের দিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন হুররেম। এরপর আরেকবার চুমুক দিলেন পানীয়র পেয়ালায়। পুরো ব্যাপারটিকেই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে ইব্রাহিমের। গল্প গল্প লাগছে। আর সেই গল্পের লাস্যময়ী নায়িকা হুররেম। ইব্রাহিম নিজেও আরেকবার পেয়ালায় মুখ ডুবালেন। সরাইখানায় যাওয়ার তেমন অভ্যাস না থাকলেও সুযোগ পেলে ইব্রাহিমও সুরা পান করতে ভুলেন না। তাই খুব বেশি খারাপ লাগছে না। উল্টো হুররেমের মতো একজন সহচর পেয়ে আলাদা একটা উত্তেজনা অনুভব হচ্ছে।

‘এখন কেমন বোধ করছেন’

হুররেমের চোখে অর্থপূর্ণ চাহনি।

‘ভালো।’

‘হুমম।’

আজকে এই প্রথম শব্দ করে হাসলেন হুররেম। সে হাসির মানে কেবল হুররেমই জানেন।

 

চলবে...পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর