একেক দেশে একেক রূপে আসেন দেবী দুর্গা
দুর্গা হলো দুর্গতিনাশিনী। দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। তারপরে প্রথমা, দ্বিতীয়া এভাবে পঞ্চমী পর্যন্ত মূর্তি, প্রতিমা তৈরি ও সাজানোর কাজসহ পূজারম্ভ পর্ব চলতে থাকে। আর পূজার মূল পর্ব শুরু হয় ষষ্ঠীর মাধ্যমে। পূজারম্ভের ধারাবাহিকতায় একে মহাষষ্ঠী বলা হয়। এ মহাষষ্ঠীর আগ পর্যন্ত পূজার যে প্রস্তুতি চলতে থাকে তার পরিসমাপ্তি হয় ষষ্ঠী শুরুর মাধ্যমে। এভাবে পূজা শুরু হওয়ার পরে সেটি সার্বজনীনতা লাভ করতে থাকে। বলা হয় সনাতন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে সব পূজা-পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞ। এবারে দুর্গা মা এসেছেন ঘোড়ায় চড়ে। বিদায়ও নেবেন ঘোড়ায় চড়ে। দুর্গা কখনো নৌকায় চড়েও আসেন। পৌরাণিক কাহিনীর তথ্যমতে কথিত আছে, যেবার মা দুর্গা নৌকায় চড়ে আসেন সেবার বেশি বৃষ্টি হয়। আবার যেবার মা দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে আসেন সেবার বৃষ্টি কম হয় এবং গরম বেশি থাকে। দেবী দুর্গা প্রাচীনকাল থেকেই ভক্তদের মাঝে নানারূপে পূজিত হয়ে আসছেন। বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা মূল রামায়ণ থেকে যখন বঙ্গানুবাদ করলেন তখন তা বাল্মীকি-রামায়ণের অনুসারী হলেও তাতে বহু পরিবর্তন ঘটল। বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গা তার অসুরদলনী রূপ ছাপিয়ে কন্যারূপেই অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। এই কন্যা প্রতি বছর একবার সপরিবারে আসেন পৃথিবীতে তার পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। চার দিন থেকে পঞ্চম দিন ফিরে যান নিজগৃহে। ঠিক যেভাবে আসে বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির কন্যা তার পিতামাতার বাড়িতে। বিশ্বের সকল শক্তির মিলিত রূপ দুর্গা। শিব, দুর্গা বা কালী সব একই শক্তি। ঈশ্বরের মাতৃরূপ শ্রী দুর্গার মধ্যে বিদ্যমান। এই মহাশক্তির আরাধনায় দেবীকে বিভিন্ন রূপে বন্দনা করা হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে দেখা যায় দুর্গার একেকটি রূপ যা নবদুর্গা নামে আখ্যায়িত হয়েছে। এই নবদুর্গার নয়টি রূপ আছে। রূপগুলো হচ্ছে— শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী।
এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা।
সকল দুঃখের বিনাশকারিণী
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোক পুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোক পুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই হলেন দুর্গা। দেবী দুর্গা
ত্রিনয়না বলে তাকে ‘ত্র্যম্বক’ বলা হয়। তার বাম চোখ হলো বাসনা (চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান (অগ্নি)। দুর্গার দশ বাহুতে যে দশটি অস্ত্র রয়েছে সেই অস্ত্রগুলোও বিভিন্ন প্রতীকের ইঙ্গিতবাহী। শঙ্খ ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা নির্দেশ করে। তীর ধনুক দেবীর শক্তিমত্তার প্রতীক। মায়ের হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি হলো ভক্তের সংকল্পের দৃঢ়তা। দুর্গার হাতের পদ্ম বা ‘পঙ্কজ’ অর্থ হলো পদ্ম যেমন কাদামাটির ভিতর থেকে অনাবিল হয়ে ফোটে তেমনি দেবীর উপাসকরাও যেন লোভ-লালসার জাগতিক কাদার ভিতর হতে আত্মার বিকাশ ঘটাতে পারে। দেবীর তর্জনীতে ধরা সুদর্শন চক্র তার শুভতার লালন ও অশুভের বিনাশের ইচ্ছার প্রকাশ। দুর্গার হাতে ধরা তলোয়ার জ্ঞানের ইঙ্গিত ও ত্রিশূল হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রকাশ।
সবচেয়ে বড় প্রতিমা নোয়াখালীতে
নোয়াখালীর বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত চৌমুহনীতে এবার তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্গা প্রতিমা। উচ্চতা ৭১ ফুট। চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পী অমর পালের নেতৃত্বে চলে এই দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ। নোয়াখালীর বিজয়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের পুজোর জন্য এই প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে মণ্ডপ তৈরি করা হয়। মৃৎশিল্পী অমর পাল ২০ বছর ধরে নোয়াখালীতে প্রতিমা তৈরির কাজ করলেও এবারই তিনি এই বিশাল আকারের প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। ১৯৭৪ সালে ছাত্রজীবন থেকে তিনি প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করলেও এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতিমা। কারণ এত বড় দুর্গা প্রতিমা তিনি আগে কখনো বানাননি। ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন দেশসেরা এই প্রতিমা ঘিরে ভক্ত-অনুরাগীদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রায় আড়াই মাস ধরে বিশাল এই দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন শরীয়তপুর থেকে আসা প্রতিমার কারিগর অমরকৃষ্ণ পাল ও তার ১২ জন সহযোগী। এ প্রতিমা ঘিরে ভক্ত-অনুরাগীদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রতিদিনই উত্সুক লোকজনের ভিড় জমছে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী ও দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে এখানে। শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর পরিবেশে সবার সঙ্গে দুর্গা উৎসব উপভোগ করছেন ভক্তরা। এবারের পুজোর প্যান্ডেল, আলোকসজ্জাসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি বছরই চৌমুহনীতে বিভিন্ন আদলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরাকীর্তি অনুকরণে মণ্ডপ তৈরি করা হলেও এটি এ বছর সবার চেয়ে আলাদা। দুর্গোৎসব উপলক্ষে নোয়াখালী ছাড়াও সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এটি দেখার জন্য আসছেন। ২০১৫ সালে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ৮৮ ফুটের দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়েছিল।
দেশে দেশে দুর্গোৎসব
ভারতে সোনা-হীরার দুর্গা
চার কোটি টাকার সোনা ও হীরার তৈরি দুর্গা এবার শোভা পাচ্ছে ত্রিপুরার আগরতলার ছাত্রবন্ধু ক্লাবে। সাড়ে সাত ফুটের দুর্গাসহ সব মূর্তিই গ্লাস-ফাইবারের। তার উপরে সোনা-হীরার কাজ। মূর্তিটি গড়েছেন হাবরার বাণীপুরের ইন্দ্রজিৎ পোদ্দার। ছবি : শান্তনু হালদার
লন্ডনে দুর্গা
ভারত মহাদেশের বাইরে সব থেকে পুরনো ও চোখ ঝলসে দেওয়া দুর্গোৎসব লন্ডন পুজো ক্যামডেনে। বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার এবং সুইন্ডন থেকেও অনেকে যোগ দেন এই শারদীয় উৎসবে। অন্য সম্প্রদায়ের অনেকেই পূজা মণ্ডপে উপস্থিত হয়ে আনন্দে শামিল হন।
নেদারল্যান্ডসের দুর্গা প্রতিমা
অক্টোবরের বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, এমনকি আশপাশের দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড থেকেও অনেকে আসেন এখানে পুজোর কটা দিন আনন্দে কাটিয়ে যেতে।
— তনিমা চট্টোপাধ্যায়, নেদারল্যান্ডস
কানাডাতে পূজার আমেজ
কানাডাতেও বাঙালিদের সবচেয়ে বড় এই সার্বজনীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি ঘিরে চলে মাসব্যাপী বিবিধ আয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো মন্ট্রিলের বাঙালি হিন্দু পরিবারগুলোতেও এখন বিরাজ করছে পুজোর আমেজ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা