বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট লড়াইয়ের যত কাহিনী

আবদুল কাদের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট লড়াইয়ের যত কাহিনী

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনীতি ও রাজনীতির পালাবদলে আমেরিকার ভূমিকা বরাবরই আলোচিত-সমালোচিত। সেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। এ নিয়ে গোটা বিশ্বের আগ্রহের কমতি নেই। আমেরিকার সোয়া দুইশ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস রয়েছে। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে বারাক ওবামা, ইতিহাস দেখেছে অনেক কিছু। সম্প্রতি শেষ হয়েছে প্রেসিডেন্ট বিতর্ক। আমেরিকার ইতিহাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নানা কাহিনী নিয়ে আজকের রকমারি—

 

 

মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতি

বর্তমান বিশ্বের যেসব দেশে সাংবিধানিক গণতন্ত্র রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ স্বচ্ছ। প্রতি চার বছর পর পর নির্বাচন হয়ে থাকে। আর দেশটির প্রধান দুই দল থেকে প্রার্থী বাছাই করা হয়।

নির্বাচনী বছরে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৪৫ সাল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা বাছাইয়ে ৩টি শর্ত মানতে হয়। এক, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। দুই, ৩৫ বছরের বেশি বয়সী এবং তিন, ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হতে হবে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সময় ধরে প্রাথমিক ভোট গ্রহণের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত করা হয়। এ জন্য আইওয়া রাজ্যে দলীয় কার্যালয়ে নির্বাচনী আলোচনা হয়। এখান থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দলের প্রার্থী বাছাই হয়। প্রধান দুই দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন সম্মেলন করেন। চার দিনব্যাপী সম্মেলনে প্রার্থীর প্রশংসা করে প্রার্থীকে বরণ করা হয়। ১৮৫৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্ক প্রথা শুরু। বর্তমানে প্রার্থীদের এই বিতর্ক গোটা বিশ্বই দেখতে পারে। তিন পর্বের বিতর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়। এ বিতর্কে প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানে খোলামেলা প্রশ্ন করা হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রার্থীরা এ বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির নির্বাচন আমেরিকায় বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। মূলত এই পদ্ধতি প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজনকে বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতিতে যে প্রার্থী ৫৩৮ ইলেকটরের মধ্যে কমপক্ষে ২৭০ ইলেকটরের ভোট পাবেন, তিনিই জয়ী গণ্য হবেন। এ ছাড়া ৪৩৫ সদস্যের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিও ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। মার্কিন সংবিধানের ১২তম সংশোধনী অনুযায়ী দেশটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একজন ভোটার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সময় একই সঙ্গে ইলেকটোরাল প্রতিনিধিকেও ভোট দিতে পারেন। মূলত ভোটাররা ইলেকটর নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। কারণ কাগজে-কলমে ইলেকটরদের ভোটেই নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘ মেয়াদি এই ভোটগ্রহণ পদ্ধতি শেষে ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভোট গণনা করা হয়। সিনেটর সভাপতির তদারকিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সব শেষে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে গোটা বিশ্বের আগ্রহ রয়েছে।

 

বিতর্কিত যত প্রার্থী

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতটা না উত্তেজনাপূর্ণ হয় তার চেয়ে বেশি আলোচিত হন নির্বাচিত প্রার্থীরা। যেমন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, নানা বিতর্ক আর কেলেঙ্কারিতে মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাসে এমন এর আগেও ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জর্জ ওয়ালেসও বিতর্কিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ শতকের প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ। চারবার প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জয়ী হতে পারেননি। আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী সময়গুলোয় তার বর্ণবাদী আচরণে তিনি বিতর্কিত হন। ১৯৩৬ ও ১৯৪০ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আর্ল ব্রাউডার। রাশিয়ান পাসপোর্ট গোপন করে রাশিয়ান এক গুপ্তচরকে বিয়ে করায় বিতর্কিত হন। এ ঘটনায় তার চার বছরের জেলও হয়। জন চার্লস ফ্রেমন্ট ছিলেন ১৮৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নাকি মানুষখেকো! অদ্ভুত কথা! ঘটনাটি ছিল এরকম, ফ্রেমন্ট ও তার দলবল সিরেয়াসে অভিযানে পথ হারিয়ে ফেলেন। তখন অনাহারে বেঁচে থাকার তাগিদে নরমাংস ভক্ষণ করেন। নির্বাচনের আগেই বিষয়টি জনসম্মুখে চলে আসে। শেষ রক্ষা আর হলো না। নির্বাচনে হেরে যান। গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডও বিতর্কের বাইরে ছিলেন না। তিনি শিশুপ্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তবে এখানেই শেষ হলে পারত। পরবর্তীতে ধর্ষণের মতো অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এর বাইরেও অনেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিতর্কিত হয়েছিলেন। বেরি গোল্ডওয়াটার, এগুন ভি ডেবস, হুয়ে পি লং, ভিক্টোরিয়া উডহুল, পেট জে বচ্চন, জর্জ ইডেন টেইলরের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদও পার পাননি। ফলাফল নির্বাচনে হার। তা ছাড়া ২০০৬ সালের উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের ইতিহাস সবারই জানা। সে সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ চরমভাবে বিতর্কিত হন। মার্কিন ইতিহাসে জর্জ বুশই সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি।

 

মার্কিন নির্বাচনে কারচুপি কাহিনী

পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের জন্য রোল মডেল। কিন্তু এই পাশ্চাত্যের নির্বাচনে কারচুপি, তাও আবার মার্কিন নির্বাচনে কীভাবে সম্ভব? মার্কিন নির্বাচন উত্তেজনায় রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প নির্বাচন নিয়ে কারচুপির আশঙ্কা করেন। মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসে এর আগে কোনো প্রার্থী কখনো ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন অভিযোগ করেননি। এবারই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।

এমন আশঙ্কায় চোখ কপালের ওঠার মতো অবস্থা। যদিও এমন অভিযোগ নতুন নয়। খুব বেশি দূরে নয়, ২০০০ সালের মার্কিন নির্বাচনের দিকে তাকালেই মিলবে তার প্রমাণ। সে সময় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আল গোর এবং জর্জ ডব্লিউ বুশের মধ্যে নির্বাচন ছিল চরম উত্তেজনার। ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন। সে সময় ফ্লোরিডা স্টেটে ভোট পুনঃগণনার দাবি উঠেছিল।

একই ঘটনার জন্ম দিয়েছিল এর আগেও। ১৮২৪, ১৮৭৬ এবং ১৮৮৮ সালের নির্বাচনী ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা। জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো পপুলার ভোটে হেরেও ১৮২৪-এ জন কুয়েনসি অ্যাডামস, ১৮৭৬-এ রাদারফোর্ড হায়েস এবং ১৮৮৮-এ বেঞ্জামিন হ্যারিসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও সে সময় এসব নির্বাচনগুলোতেও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। এর আগে ১৮০০ সালে থমাস জেফারসন ও জন অ্যাডামসের নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ১২তম সংশোধনীতে ভোটাররা দুই সর্বোচ্চ পদে আলাদাভাবে ভোট দিতে পারবেন বলে সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। তা ছাড়া ভোটার তালিকা ও ভোট গণনায় প্রতারণার অভিযোগ তো আছেই। ইতিহাসে ১৯৬০ সালে জন এফ কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সনের নির্বাচনে ভুয়া ভোটারের অভিযোগ উঠেছিল। ভোটার তালিকায় অনেক মৃত মানুষের নাম ছিল। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাফ জানিয়ে দেন, ‘নির্বাচনে কারচুপি নেই। নির্বাচন পরিচালিত হয় আলাদা নির্বাচনী স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থায়’। এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যতই আশঙ্কা থাকুক না কেন, অপেক্ষা শুধু শেষ সময়ের। কে হবেন বিশ্ব মোড়ল?

 

যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রেসিডেন্টরা

বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের আগ্রাসনের কথা কার না জানা। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে বারাক ওবামা, সোয়া দুইশ বছরের ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ রচনা করেছেন তারা। মার্কিন ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস। তখন ছিল ঢাল-তলোয়ারের যুগ। ১৭৭৮ থেকে ১৮০০, এ সময় ‘দ্য কোয়াসি ওয়ার’ দিয়ে মার্কিন যুদ্ধের সূচনা করেন। এরপর অসংখ্য যুদ্ধ পরিচালিত হয়। কিন্তু বিগত ৩০ বছরে ৫ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে আগ্রাসন চালিয়েছেন তা ছিল ভয়াবহ। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার বিশ্লেষণে প্রকাশ পেয়েছে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও মানবতা ধ্বংসের ভয়ঙ্কর সব তথ্য।

রোনাল্ড উইলসন রিগ্যান ৪০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত শাসনামলে প্রথম আগ্রাসনের শিকার লেবানন। ১৯৮৩ সালে গ্রানাডা এবং ১৯৮৬ সালে বার্লিনের ডিস্কোবারে বোমা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে লিবিয়ায় হামলা চালান তিনি। জাতিসংঘ এই হামলায় তীব্র নিন্দা জানায়। এরপর ৪১তম প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত বুশের আগ্রাসন বিশ্ববাসী দেখেছে। ক্ষমতার প্রথম বছরেই পানামা, এরপর ১৯৯১-তে ইরাকে হামলা চালানো হয়। ১৯৯২-এ সোমালিয়ায় হামলা চালান। এরপর মার্কিন ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ১৯৯৩ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ক্ষমতার প্রথম বছরে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অজুহাতে ইরাকে হামলা চালান। একই সালে সোমালিয়ায় এরং পরের বছর হাইতি ও বসনিয়ায় হামলা চালান। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালে ন্যাটো বাহিনীর সমর্থনে বসনিয়ায় বিমান হামলা চালান। ১৯৯৬-তে ইরাক এবং ১৯৯৮-এ সুদান ও আফগানিস্তানে হামলা চালায় ক্লিনটন বাহিনী। সব শেষে ১৯৯৯ সালে কসোভোয় হামলা চালান ক্লিনটন। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতায় থাকেন। ইতিহাস তাকে সবচেয়ে আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবেই চেনে। ২০০১-এ টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিবাদে আল-কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সে সময় আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩-এ আবারও ইরাকে হামলা করে শেষ হয় জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামল। এরপর ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পূর্বসূরি বুশের শুরু করা ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ তিনি চালিয়ে নেন। ২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থামানোর জন্য বিমান হামলা চালান।

২০১১ সালে লাদেনকে হত্যার পর নতুন মিশন সিরিয়া। ইতিমধ্যে সামরিক হামলা চালানোর ছক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন শুধু জাতিসংঘ ও মিত্র দেশের সমর্থন পাওয়ার অপেক্ষা। এর মাঝেই শেষ হচ্ছে ওবামা শাসন।

 

ইতিহাস গড়ার পথে হিলারি?

হিলারি রডহাম ক্লিনটন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সহধর্মিণী তো বটেই, আমেরিকান ডেমোক্র্যাট দলের দীর্ঘদিনের সফল রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক জীবনে পররাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে বর্ণবাদ, নারী অধিকার ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি— সবকিছুতে তার বিচক্ষণতা আর বুদ্ধিমত্তা সব মহলেই প্রশংসিত। ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ও ট্রাম্প মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন। শেষ হওয়া সবগুলো টিভি বিতর্কে হিলারির বাচনভঙ্গি ও বক্তৃতা নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের। বিপক্ষকে ব্যঙ্গ, কটাক্ষ ও ঘায়েল করার জমজমাট বাগ্যুদ্ধে হিলারির ছিল রক্ষণশীলতা, উদারতা, সহনশীলতা আর ধৈর্যের ছাপ।

আমেরিকার রাজনৈতিক-সাংবাদিক সংগঠন ‘পলিটিকো’র জরিপে হিলারি সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। বিতর্ক পরবর্তী জরিপ বলছে, দুই দলের ভোটারদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ ভোটার মনে করেন, নতুন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য হিলারিই সেরা।

শেষ হওয়া সবগুলো বিতর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। উঠে আসে জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থান, আবাসন ইত্যাদির মতো কঠিন কিছু বিষয়। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে বরাবরের মতো কর্মসংস্থান হোঁচট খাচ্ছে। আর তা নিয়ে ভাবনার কমতি নেই। আর এই কর্মসংস্থানের বিষয়ে হিলারি বলেন, তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ৩৫ ভাগ কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া হিলারি তার ই-মেইল কেলেঙ্কারির দায় স্বীকার করে নেন। অবশ্য ধনকুবের ট্রাম্পকে তার ট্যাক্স রিটার্ন বিষয়ে চেপে ধরেন। উত্তরে ট্রাম্প বলেন, আমি আমার ট্যাক্স রিটার্ন প্রকাশ করব যদি আমার প্রতিপক্ষ তার ‘মুছে ফেলা ৩৩ হাজার’ ই-মেইল প্রকাশ করেন। নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠিত এসব বিতর্কে বর্ণবাদ, যুদ্ধ, পররাষ্ট্রনীতিও উঠে আসে। হিলারি সন্ত্রাস ও জঙ্গি প্রসঙ্গে সপ্রভিত উত্তর দিয়ে বলেন, ট্রাম্প বরাবরই দেশে ও দেশের বাইরের মুসলমানদের নিয়ে অপমানসূচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এতে আইএসের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের প্রকারান্তরে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার কথা বলেন হিলারি। বিভিন্ন রাজ্যে পরিচালিত বিতর্কে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকানদের নিয়ে জরিপ করা হয়। বিতর্ক-পরবর্তী জনমত জরিপে হিলারিকে সমর্থন করা মার্কিনির সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ। সিএনএন, ওআরসি, ফক্স নিউজ পোল পরিচালিত জরিপে এমনটাই উঠে এসেছে। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে রয়টার্সের করা সর্বশেষ জরিপে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে পেছনে ফেলে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। সেখানে ট্রাম্পের জনসমর্থন মাত্র ৩৮ ভাগ। এবিসি নিউজের করা সর্বশেষ জরিপে হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। শক্তিশালী নেতা হিসেবে হিলারিকে সমর্থন দিয়েছেন শতকরা ৬২ ভাগ ভোটার। ট্রাম্পকে ভোট দেন মাত্র শতকরা ৩৯ ভাগ। শুধু ভালো বিতর্কিত হিসেবে হিলারিকে টপকে গেছেন ট্রাম্প। অনেকেই মনে করেন বিতর্কিত ট্রাম্পের উগ্রগামী আচরণই হিলারিকে নির্বাচনে জয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্পের চেয়ে নিজস্ব মতামত অনেক যথাযথ ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন হিলারি। তারা মনে করেন, নির্বাচনী ইস্যুগুলোতে ট্রাম্পের চেয়ে হিলারির বোঝাপড়া অনেক স্বচ্ছ। প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতার প্রশ্নেও এগিয়ে রয়েছেন হিলারি। সবগুলো বিতর্ক পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে আমেরিকানরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কারণ, গণতন্ত্র মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখায়। ঠিক উল্টো দিকে রিপাবলিকানরা। তারা সাদা চামড়ার স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। সারা বিশ্ব চায় আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের শাসক মানুষকে মানুষ হিসেবে মনে করুক।

পৃথিবীর বহু দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশে এখনো নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। এবার হয়তো সাবেক এই ফার্স্টলেডি মার্কিন ইতিহাস গড়বেন। মার্কিনিদের নারী প্রেসিডেন্টের অভাবটাও ঘুচবে।

 

কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত খেপাটে ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই সমালোচিত। ব্যবসায় থেকে রাজনীতিতে প্রত্যর্পণ করা ট্রাম্প বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও বিতর্কিত একটি নাম। শুরু থেকেই বিতর্কিত এই মিলিওনিয়ারে। মনোনয়ন না পেলে দাঙ্গা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। নামধারী ব্যবসায়ী হলেও চরম বিতর্কিত ট্রাম্প। তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে। তা ছাড়া ক্রাইম সিন্ডিকেটেও তার হাত রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনেও ট্রাম্প চরমভাবে বিতর্কিত। তিনটি বিয়ে করা ট্রাম্প নানা নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত। একসময়কার জনপ্রিয় মডেল ইভানা, হলিউড সুন্দরী মারলা ম্যাপল এবং মেলানিয়া নাউসের মতো বিশ্ব সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িত। সমালোচনায় পরিপূর্ণ ট্রাম্পের এ পর্যন্ত ৯ জন নারীর যৌন কেলেঙ্কারি, গর্ভপাত, মার্কিন নির্বাচনে রুশ গোয়েন্দাদের নাক গলানোর বিষয়ে নির্বুদ্ধিতা, মিডিয়াকে হুমকি, কর ফাঁকি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নোংরা আক্রমণ— সব মিলিয়ে ট্রাম্পের নির্বাচনী তরী ডুবে গেছে বললেই চলে। অবশ্য তিনি উল্টো এসব সমালোচনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সেই নারীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবেন। সব শেষে ফক্স নিউজের নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল মেনে নেওয়ার প্রশ্নেও তার বাঁকা উত্তরে হতভম্ব খোদ রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে নারীদের নিয়ে অশোভন মন্তব্যের জন্য সমালোচনায় তোপের মুখে। তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ জোরালো হয়ে উঠেছে। বহু আগের ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা তার নির্বাচনী ইমেজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৩০ বছর আগের বিমানের একটি ঘটনায় ট্রাম্প নানামুখী চাপে রয়েছেন। নিউইয়র্কের বিতর্কিত এই ব্যবসায়ী নাকি ওই নারীর শরীর অশোভনভাবে স্পর্শ করেছিলেন। তার ভাষায়, অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে যৌন নিপীড়ন চালান ট্রাম্প। এখানেই শেষ নয়, আরেক নারীর অভিযোগ, ২০০৫ সালে ট্রাম্প টাওয়ারে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই নারীর মুখে চুম্বন করেছিলেন ট্রাম্প। এসব নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতিতে খেপাটে ট্রাম্প আর উগ্রতা প্রকাশ করে বসেন। নিউইয়র্ক টাইমসকে নির্বাচন-পরবর্তীতে দেখে নেবেন বলেও হুমকি দিয়ে বসেন এই ব্যবসায়ী।  এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার অনুপ্রবেশের বিষয়ে উল্টাপাল্টা মন্তব্যও করেন ট্রাম্প। এর আগে ইরাক যুদ্ধে নিহত পাকিস্তান বংশোদ্ভূত মার্কিন সেনা হুমায়ুন খানের বাবা খিজির খান ও মা দোজালা খানের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করে দেশ-বিদেশে এমনকি নিজ পার্টিতেও ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন। নানা সংকট আর কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে খোদ রিপাবলিকানরাও তার থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। গেল তিন টিভি বিতর্কে গোটা বিশ্ব দেখেছে খেপাটে ট্রাম্পের কাণ্ড। টিভি বিতর্কে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারির ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ আর নানামুখী প্রশ্নে ট্রাম্পের বুদ্ধিহীনতার পরিচয়ে মার্কিনিরা তার ওপর থেকে সব আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারিতে চারদিক যখন সরব ট্রাম্প আত্মরক্ষায় তখন ক্রমেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন। সর্বোপরি বহুল সমালোচিত এই প্রার্থী নির্বাচন পরবর্তীতে জিতলে ফলাফল মেনে নেবেন। আর হারলে মানবেন না। তার এই বক্তব্য বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই, গোটা বিশ্বের কাছে সমালোচিত হয়েছে।

 

প্রথম বিতর্ক

♦ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

♦ হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটি, হেম্পস্টিড, নিউইয়র্ক

♦ সিএনএন, ওআরসির জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে হিলারি

♦ হিলারির জনসমর্থন শতকরা ৬২ ভাগ

♦ ট্রাম্পের জনসমর্থন শতকরা ২৭ ভাগ

 

দ্বিতীয় বিতর্ক

♦ ৯ অক্টোবর ২০১৬

♦ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, স্টেট লুইস, মিসৌরি

♦ সিএনএনের জরিপে এগিয়ে হিলারি

♦ হিলারির জনসমর্থন শতকরা ৫৭ ভাগ

♦ ট্রাম্পের জনসমর্থন শতকরা ৩৪ ভাগ

 

তৃতীয় বিতর্ক

♦ ১৯ অক্টোবর ২০১৬

♦ ইউনিভার্সিটি অব নাভাদা, লাসভেগাস, নিউইয়র্ক

♦ সিএনএন ও ফক্স নিউজের জরিপে এগিয়ে হিলারি

♦ হিলারির জনসমর্থন শতকরা ৫২ ভাগ

♦ ট্রাম্পের জনসমর্থন শতকরা ৩৯ ভাগ

 

সর্বশেষ জরিপ

♦ এবিসি নিউজের সর্বশেষ জনমত জরিপে ট্রাম্পকে পেছনে ফেলে এগিয়ে হিলারি।

♦ হিলারির জনসমর্থন শতকরা ৫০ ভাগ

♦ ট্রাম্পের জনসমর্থন শতকরা ৩৮ ভাগ

সর্বশেষ খবর