বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাহাড় কাহিনী

সাইফ ইমন

পাহাড় কাহিনী

আকাশছোঁয়া হিমালয়

হিমালয় মানে এক বিস্ময়কর রহস্য, এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। হাজার বছর ধরে গোটা দুনিয়ার মানুষকে অভিভূত করে রেখেছে এই হিমালয়। হিমালয় হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা। তবে পৃথিবীর অন্য সব পর্বতমালা থেকে একটু আলাদা হিমালয় পর্বত। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, প্রায় দুই কোটি বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ড ছিল আফ্রিকার কাছাকাছি।

ভূমিকম্প, জলবায়ুর পরিবর্তন নানা কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ ধীরে ধীরে এগোতে থাকে এশিয়ার দিকে। এক সময় প্রচণ্ড ধাক্কায় এশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তাতে এশিয়ার ভূখণ্ডের সঙ্গে জোড়া লেগে যায়। আর এই জোড়া লাগা স্থানগুলো প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে যায়। উঁচু হয়ে যাওয়া এই বিরাট ভূমিই কালের বিবর্তনে হিমালয় পর্বতমালায় পরিণত হয়।

হিমালয় নামটির সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থান হলো এই হিমালয়। উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার! যার মানে ৮.৮৫ কিলোমিটার! আকাশের সঙ্গেই যার মিতালি। যেন আকাশছোঁয়ার এক অদম্য ইচ্ছা নিয়ে উপরের দিকে বেড়ে উঠেছে এই রহস্যময় পর্বতমালা। মেঘ যাকে নিয়ে খেলা করে, সাদা তুষার যার পোশাক আর যার আছে মাথা উঁচু করে সমগ্র পৃথিবীকে দেখা সেই তো হিমালয়। এর চূড়াকে বলা হয় এভারেস্ট যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

নানা রহস্য, নানা কাহিনী, নানা কল্পনার রাজ্য এই পর্বতমালা। এই পর্বতমালা জয়ের নেশা মানুষের আদিকাল থেকেই। সেই নেশা নিবারণ করতে বহু মানুষ দিয়েছে অমূল্য জীবন।

কিন্তু শেষ পর্যন্তু ঠিকই পৌঁছাতে পেরেছে কল্পনার এভারেস্টে। মানুষের অজেয় কিছুই নেই। এই চূড়ায় প্রথম পৌঁছেন স্যার এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে।

 

রহস্যময় আদম পাহাড়

রহস্যময় আদম পাহাড়ের অবস্থান শ্রীলঙ্কায়। রহস্যের কারণটা হলো এর চূড়ায় অবস্থিত বিরাট আকারের এক পায়ের ছাপ। হ্যাঁ, মানুষের পায়ের ছাপ! পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ওই পায়ের চিহ্নটি সত্যিই রহস্য, আকারেও বিশাল। মুসলমানদের বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এর নামেই নামকরণ হয়েছে এই পাহাড়ের। তবে এর চূড়ায় অবস্থিত ওই পায়ের ছাপকে সব ধর্মের মানুষই পবিত্র হিসেবে মনে করে।

শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা বিশ্বাস করে পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) প্রথম শ্রীলঙ্কায় পদার্পণ করেছিলেন। আর পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পায়ের ছাপটি তারই। তাই এই ছাপকে মুসলমানরা পবিত্র হিসেবে গণ্য করে। আদম পাহাড় শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবার কাছেই সমানভাবে শ্রদ্ধার স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করে এই পদচিহ্নটি শিবের পায়ের, আবার খ্রিস্টানরা মনে করে এটা যিশুর পায়ের ছাপ, বৌদ্ধরা মনে করে এটা বুদ্ধের পায়ের ছাপ। সবার ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় জায়গাটি সবার কাছেই শ্রদ্ধার। 

১৫০৫ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছিলেন পর্তুগিজ এক নাগরিক। তিনি এ পাহাড় দেখে বলেছিলেন পিকো ডি আদম। সেই থেকেই পাহাড়ের নাম আদম পাহাড়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পায়ের ছাপটি রয়েছে এখানে। এই আদম পাহাড় নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। অনেক মুসলমানই বিশ্বাস করে হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে অবতরণের সময় সর্বপ্রথম পা রাখেন শ্রীলঙ্কার এই পাহাড়ে।

এই পাহাড়ের চূড়াটি একটি সমতল ক্ষেত্র। সর্বপ্রথম ১৮১৬ সালে লেফটেন্যান্ট ম্যালকম এর পরিমাপ করেন। পরিমাপ অনুযায়ী এর দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট, প্রস্থ ২৪ ফুট এবং মোট আয়তন ১৭৭৬ বর্গফুট।

 

বৃষ্টির পাহাড়!

বৃষ্টির পাহাড়। এ আবার কেমন। পাহাড় যেখানে বৃষ্টি পড়ে, তুষার ঝরে কিংবা মেঘে ঢাকে। তাহলে আলাদা করে আবার বৃষ্টির পাহাড় বিষয়টা কী। হ্যাঁ, তাই হতে যাচ্ছে আরব আমিরাতে। বৃষ্টির জন্য কৃত্রিম পাহাড় বানাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর এ জন্য আরব বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটির রাজধানী দুবাইয়ে তৈরি হবে ‘বৃষ্টির পাহাড়’। বৃষ্টিহীন মরুভূমির এই দেশটিতে কৃত্রিম পাহাড় বৃষ্টিপাতে বাধ্য করবে  এমনটাই আশা নগর কর্তৃপক্ষের। খালিজ টাইমসের খবর অনুযায়ী, এবার বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে স্থায়ীভাবে বৃষ্টির পাহাড় তৈরি করতে যাচ্ছে ইউএই। দুবাইয়ে এর আগেও কৃত্রিমভাবে মেঘ তৈরির কাজ হয়েছে।

কৃত্রিম উপায়ে বাতাসের বেগ তৈরি করে মেঘের সৃষ্টি এবং সেই মেঘের কারণে বৃষ্টি হবে এমনটা আশা করেই তৈরি করা হচ্ছে এই মানুষ নির্মিত পাহাড়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লাউড সিডিং।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল অ্যাটমোসফেরিক রিসার্চের বিজ্ঞানীদের সহায়তায় দুবাই এই বড় প্রকল্পে হাত দিয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক।

১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত হলেও ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিটি হালে অনেক উন্নত হয়েছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী মেঘের জলকণাকে জোরপূর্বক সম্প্রসারণ করা হয়। যার ফলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার আরব আমিরাতে আরও বেশি মাত্রায় বৃষ্টিপাতের উদ্দেশ্যে আবুধাবির একজন বিজ্ঞানী ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছেন। ক্লাউড সিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে আমিরাতের তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য এসব টিমের গবেষণা বাবদ ৫০ লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্টের এক খবরে বলা হয়, ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে আবহাওয়াকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যেন সেই বিশেষ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ে।

এই প্রকল্পের একজন বিশেষজ্ঞ রলফ বরুন্টেজেস বলেন, এমন একটি পাহাড় তৈরি করা এত সহজ কাজ নয়। আমরা এখনো বিষয়টি শেষ করতে ব্যস্ত আছি।

তাই আমরা উচ্চতা, প্রশস্ততা ও জায়গা নিয়ে কাজ করছি। স্থানীয় আবহাওয়াবিদদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।’

এই কৃত্রিম পাহাড় যদি সফলভাবেই মেঘ উৎপাদনে সক্ষম হয় এবং বৃষ্টি ঝরায় তাহলে বিশ্বে এরকম সব অঞ্চলের জন্য এটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

 

জাদুর পাহাড়

পাহাড় মানেই রহস্য। সৌন্দর্যের রহস্য আছে আবার আছে ভয়ঙ্করের রহস্য। সেই সঙ্গে আছে জাদুর রহস্য। বলা হচ্ছে জাদুর পাহাড়ের কথা। সৌদি আরবের মদিনা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ওয়াদি আল বায়দা নামক স্থানে আছে এই জাদুর পাহাড়। স্থানীয়রা একে জিনের পাহাড় বলেও সম্বোধন করে।

খুব সাধারণভাবেই আমরা জানি, সব কিছু ঢালুর দিকে গড়িয়ে যায়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই জিনের পাহাড়ে সবকিছু ঢালুর বিপরীত দিকে গড়ায় মানে সাধারণ নিয়মের ঠিক উল্টো। যেন এখানে এসে হার মেনে যাচ্ছে বিজ্ঞানের সব সূত্র। এমনই রহস্য তৈরি হয়েছে এই জাদুর পাহাড়ে। কোনো অজ্ঞাত কারণে গাড়ি নিজ থেকেই ঢালুর বিপরীত দিকে চলতে শুরু করে। এমনকি রহস্যঘেরা এই পাহাড়ে বন্ধ গাড়িও ঢালুর বিপরীতে চলতে থাকে। কেউ কেউ ধারণা করেন জায়গাটিতে প্রচুর চুম্বক জাতীয় পদার্থ আছে তাই এমনটি হয়।

তবে জানা যায়, ২০০৯-১০ সালের দিকে সৌদি সরকার এই ওয়াদি আল বায়দায় একটি রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়। হঠাৎ দেখা যায় রাস্তা নির্মাণের যন্ত্রপাতি আস্তে আস্তে মদিনা শহরের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি যন্ত্রপাতিগুলো মদিনার দিকে ঠেলছে। এমনকি পিচ ঢালাইয়ের ভারী রোলারগুলোও বন্ধ থাকা অবস্থায় আস্তে আস্তে ঢালু বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। যেন কোনো হরর মুভি বা সায়েন্স ফিকশান মুভির দৃশ্য দেখছেন আপনি। এসব দেখে কর্মরত শ্রমিকরা ভয় পেয়ে যায়। তারা কাজ করতে অস্বীকার করে। ফলে রাস্তা বানানোর কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রাস্তাটির কাজ যেখানে বন্ধ করা হয় সেখানে চারদিকে বিশাল কালো পাহাড়। ওখানেই শেষ মাথায় গোলচত্বরের মতো করে আবার সেই রাস্তা দিয়েই মদিনা শহরে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই রাস্তাটি ২০০ কিলোমিটার করার কথা থাকলেও ৪০ কিলোমিটার করেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসলে সরকার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই এই পাহাড় ঘিরে নানা ধরনের রহস্য-গল্প প্রচলিত হতে থাকে। যার ফলে এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয় জাদুর পাহার বা জিনের পাহার। এ জিনের পাহাড়কে ঘিরে মানুষের মাঝে রয়েছে অনেক কৌতূহল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক আসে এই জিনের পাহাড় দেখতে। হজের সময়ও এই রহস্যময় পাহাড় দেখার জন্য অনেকে ভিড় জমান।

 

 

রেকর্ডবুক

এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম পৌঁছেন স্যার এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে।

১৯৭৫ সালের ১৬ মে প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর কৃতিত্ব দেখান জাপানের জুনকো তাবেই।

অক্সিজেন ছাড়া প্রথম এভারেস্ট জয় করা নারী হলেন লিডিয়া ব্র্যাডি। তিনি এভারেস্ট জয় করেন ১৯৮৮ সালের ১৪ অক্টোবর।

অক্সিজেন ছাড়া প্রথম পুরুষ হিসেবে ১৯৭৮ সালের ৮ মে এভারেস্ট জয় করেন অস্ট্রিয়ার পিটার হেবেলার এবং ইতালির রেইনহোল্ড মেসনার।

ইতালির রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম অভিযাত্রী যিনি একা এভারেস্ট জয় করেন ১৯৮০ সালের ২০ আগস্ট।

শীতকালে প্রথম এভারেস্ট জয় করেন পোল্যান্ডের এল সিচি এবং কে ওয়েলিকি ১৯৮০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

প্রথম এভারেস্ট জয়ী দম্পতি হলো স্লোভেনিয়ার আন্দ্রেজ এবং মারিয়া স্ট্রেমফেলজ। ১৯৯০ সালের ৭ অক্টোবর এভারেস্ট জয় করে এই দম্পতি।

২০০১ সালের ২৫ মে প্রথম অন্ধ ব্যক্তি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন যুক্তরাষ্ট্রের এরিক ভিয়েনমায়ার।

দুই ভাইয়ের এভারেস্ট জয় ১৯৯২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। প্রথম সহোদর হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন আলবার্তো ও ফেলিক্স ইনুরাতেগুই।

বাবা-ছেলে একসঙ্গে এভারেস্ট জয় করেন ১৯৯০ সালে। তারা হলেন জ্য নোয়েল রোচে এবং ছেলে রোচে বারত্রা ওরফে জেবুলন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর