শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভি এস নইপলের লেখক হওয়ার গল্প

মেহেরুন্নেসা

ভি এস নইপলের লেখক হওয়ার গল্প

ভি এস নইপলের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ক্যারিবিয়ার ত্রিনিদাদে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই লেখকের পিতামহ উত্তর প্রদেশের গোরখপুর থেকে শ্রমিক হিসেবে ত্রিনিদাদে অভিবাসী হন। তিনি লেখাপড়া করেন ব্রিটেনে। তারপর স্বাধীন লেখক জীবন বেছে নেন। তিনি মূলত উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক। ১৯৭১ সালে তিনি ‘ম্যান অব বুকার’, ১৯৯০ সালে ‘নাইটহুড’ ও ২০০১ সালে ‘নোবেল সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।

 

স্যার ভিদিয়া প্রসাদ নইপল, যিনি ভি এস নইপল হিসেবে পৃথিবীজুড়ে পরিচিত। বাঙালি পাঠকের কাছে তার পরিচয় কেবল একজন নোবেলজয়ী লেখক হিসেবে নয় বরং ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে তার সরস-বিরস রচনার জন্য। ভারত নিয়ে নইপলের প্রথম লেখা An area of Dakness. এতে তিনি বিতর্কের আগুন উসকে দিয়েছিলেন। ‘An area of Darkness’-এ নইপল ভারতের সাংস্কৃৃতিক জীবনের কঠোর সমালোচক হিসেবে প্রতিভাষ হয়ে আসেন। তিনি বলে—এটি ভারতীয় ইংল্যান্ডের একটি দিক; এটি ভারতীয় ইতিহাসের অংশবিশেষ; যা এখন মৃত। এর পরিণতি হিসেবে ভারত সরকার ৩৩ বছরের অক্সফোর্ড ফেরত তরুণ ভি এস নইপলের বই নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। নইপলের উত্তর-উপনিবেশিক জাতনায় হতাশা ও আত্মরতির চরম বহিঃপ্রকাশ এই বইটিতে নইপলের তীব্র ব্যঙ্গার্থক বর্ণনা-কাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়। তার ‘India : A wounded Civilization’ বইতে নিস্পৃহ ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি একই হতাশা ও নিরাসক্তির নির্বেদে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইন পরবর্তীতে স্থবির ভারতের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখানেও তিনি ভারতকে দেখেছেন। অপ্রস্তুত বা Un Structured একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে—যেখানে উত্তর-উপনিবেশিক নৈরাজ্য ছাড়া আর বলার মতো কিছুই থাকে না। ভারত নিয়ে নইপলের তৃতীয় গ্রন্থ ‘India : A Million Mutinies Now (১৯৯০)’ সেই হিসেবে অনেকটাই সহনীয় ও নরম সুরের সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণ। এখানে ভারতবর্ষের ব্যাপকতা ও সাংস্কৃৃতিক বৈচিত্র্যকে তিনি মূর্ত করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাশৈলীর মধ্য দিয়ে। এক গবেষকের ভাষায় এই বইয়ে নইপল একটি জাগরণের অপেক্ষায় থাকেন যা ভারতীয়দের হাজার বছর আগের আদি ভারত মাতার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে নিয়ে যাবে। এই বইয়ের শেষে তিনি মন্তব্য করেন—স্তর থেকে স্তরে ব্যথা ও নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটাতে হবে।

ভি এস নইপল ভারতকে নিয়ে তিনটি আলাদা ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। ভারতীয় সমাজের জীবন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিক বিবর্তনের চিত্র তার রচনায় ফুটে উঠেছে। তিনি নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন সমাজের বৈষম্য ও মানুষের অধিকারহীনতার কথা। এসব সরস আলোচনা নানাবিধ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এমনকি তার দেওয়া অসংখ্য সাক্ষাৎকার নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। ফিরবেন না বলে শপথ করেও বারবার সেই ভারতে (পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ) ফিরছেন, নিজেকে গভীরভাবে বিশ্লেষণের চালুনিতে ছেঁকে নিয়েছেন। এমনকি নিজের নোবেল পুরস্কারকে উৎসর্গ করেছেন এই ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে। আনুষ্ঠানিক ভাষণে লিখছেন—‘আমরা যখন আমাদের চিন্তা-ভাবনা পাল্টালাম এবং জানতে ইচ্ছা করলাম, ততদিনে কতটাই না পাল্টে গেছে সব কিছু!’ বিলেতে বসবাস করেও তিনি ভারতভূমিকে গভীরভাবে অনুভব করেছেন। তিনি বারবার ভারতভূমির কাছে তার ঋণ স্বীকার করেছেন। এই মহানুভবতা তাকে কোনো দিক দিয়ে খাটো করেনি বরং তার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত হয়েছে।

কিংবদন্তি লেখক ভি এস নইপলের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ক্যারিবিয়ার ত্রিনিদাদে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই লেখকের পিতামহ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর থেকে শ্রমিক হিসেবে ত্রিনিদাদে অভিবাসী হন। দারিদ্র্য ও কষ্টে নইপল তার শিশুকাল পার করেছেন। বেড়ে উঠেছেন সনাতন সংস্কৃতির মধ্যে কিন্তু পড়াশোনা করেছেন ব্রিটিশ স্কুলে। ১৮ বছর বয়সে বৃত্তি পেয়ে নইপল অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়তে যান। পরে ইংল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন। বেঁটে, কালো ও শ্বাসকষ্টে ভোগা এই ভারতীয়কে কেউই তখন কোনো কাজ দিতে আগ্রহী হয়নি। একে একে ২৬টি চাকরিতে আবেদন করেও নইপল কোনো চাকরি পাননি। পরে পড়াশোনা শেষে লেখালেখির ছোটখাটো কাজ করে জীবন চালাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কী লিখবেন তিনি এই ভাবতে গিয়ে মনে হলো ত্রিনিদাদের পোর্ট-অব-স্পেনের যে ঔপনিবেশিক জগতে তিনি শৈশব কাটিয়েছেন, সেগুলো নিয়েই লিখবেন। লিখলেন কিছু ছোটগল্প, নাম দিলেন ‘মিগুয়েল স্ট্রিট’। এই ছোটগল্প লিখতে গিয়েই তিনি বুঝতে চাইলেন নিজেকে।

‘প্রোলোগ টু অ্যান অটোবাইয়োগ্রাফি’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি পরবর্তীকালে লিখলেন—‘আমার লন্ডনে এগারো মাসব্যাপী অবস্থানের সময় আমি বোগার্ট সম্পর্কে লিখলাম। আমি আমার বই লিখলাম; আমি আরেকটি লিখলাম। আমি পেছনে ফিরতে শুরু করলাম।’ নইপলের এই ‘পেছন’ ফেরা একই সঙ্গে বাস্তবিক ও মেটাফরিক্যাল। তিনি লিখলেন তার ‘ম্যাগনাম ওপাস’ যে লেখায় তিনি অনায়াসেই তুলে ধরলেন উত্তর-ঔপনিবেশিক যন্ত্রণা-ক্ষুব্ধ দংশন ও আত্মরতির নির্যাস, সেই ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ এ বিশ্বাস মহাশয় নামের এক ভারতীয়ু ট্রিনিদাদিয়ান সাংবাদিকের চরিত্রের মাধ্যমে নইপল ফুটিয়ে তুললেন উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজের বিচ্ছিন্ন মানবাত্মাকে—যিনি কিং লিয়ারের মতো ঝড়ের মধ্যে সব পোশাক ঝেড়ে ফেলে খুঁজে ফেরে যেন জানতে চাচ্ছেন আসলে এই বিপন্ন পৃথিবীতে মানুষ কোথায়?

১৯৫৭ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য মিস্টিক ম্যাসুর’ প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে ফেঞ্চ সাহেবের ভাষায়, ‘যেভাবে বাঘের বাচ্চা তার প্রথম শিকারকে নিয়ে আসে গুহায়—সেভাবে নইপল তাবৎ রিভিউ ঘেঁটে প্রশংসাগুলোর সংক্ষিপ্তসার কপি করে পাঠান তার মায়ের কাছে।’ এ বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে নারীদের সঙ্গে নইপলের সম্পর্কের কথা বর্ণিত হয়েছে।

তিনি যখন ১৯৬১ সালে ২৯ বছর বয়সে লেখা উপন্যাস ‘অ্যা হাউস ফর মি. বিসওয়াস’ লিখেন, তখন তার অসহায় পিতা সাইনবোর্ডের সস্তা চিত্রকর আধখিচড়ে সাংবাদিক মশাই ছিলেন তার প্রেরণার উৎস। এখানে নইপল আত্মজৈবনিক কথকতায় নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন তার নিজের পিতার ব্যর্থ জীবনের সংগ্রাম, গ্লানি এবং অস্তিত্বের বিস্তৃত বিহ্বলতাকে। মি. বিশ্বাস সারাজীবন ব্যর্থ লড়াই করে একটির পর একটি বাড়ি গড়তে চেয়েছেন তুলসী পরিবারের মাতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজের আত্মপরিচয়ের বর্গ খুঁজে পাওয়ার প্রেষণায়। তবে পরবর্তী জীবনে তার অত্যন্ত সপ্রতিভ জননী নইপলের ‘উজ্জ্বল, নিশ্চিত, জবরদস্ত ও খানিকটা ঠাট্টা মশকরায় উচ্ছল’ সাহিত্য-স্বরকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। নিম্নবর্গের মানুষের পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিধৃত হয়েছে নইপলের উপন্যাসে।

ইংল্যান্ডে কঠোর পরিশ্রম ও অর্থ কষ্টে তার দিন কেটেছে। শুধু আলুসেদ্ধ খেয়ে কাটাতে হয়েছে নইপলকে। এই কষ্টের তার সহায় ছিল বন্ধু প্যাট্রিসিয়া। পরে প্যাট্রিসিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। সেই সময় প্যাট্রিসিয়া একটি স্কুলে পড়ানোর চাকরি করতেন। প্যাট্রিসিয়া হেইলের সঙ্গে ৪১ বছর বিবাহিত ছিলেন। এ মহিলার সঙ্গে বিবাহিত থাকাবস্থায় নইপল মার্গারেট মারি বলে বিবাহিতা আরেক অ্যাংলো-আর্জেন্টিনিয়ান নারীর সঙ্গে ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। তবে ব্রেস্ট ক্যান্সারে প্যাট্রিসিয়ার মৃত্যুর পর নইপল পুনরায় বিয়ে করেন তালাকপ্রাপ্তা পাকিস্তানি সাংবাদিক নাদিরা খানম আলভীকে। নইপল তার বইগুলো রচনার জন্য তার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হেইলের সক্রিয় সহায়তার ওপর ছিলেন নির্ভরশীল। তবে প্রায়শ তিনি মার্গারেট মারির প্রতি তার ভালোবাসার উল্লেখ করেন।

নইপল বিশ্বের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। জন্ম, বসবাস, নাগরিকত্ব, সাহিত্যকর্ম এসব মিলিয়ে তাকে ইন্দো-ত্রিনিদাদ-ব্রিটিশ লেখকও বলা হয়। অনেকগুলো সফল উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ ছাড়াও নইপল একাধিক ভ্রমণ কাহিনীর রচয়িতা। ভ্রমণ বৃত্তান্তে তিনি তৃতীয় বিশ্বের যে বসবাস অনুপযোগী চিত্র এঁকেছেন তা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তবে ভ্রমণ কাহিনী লিখে তিনি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন, সমালোচিতও কম হননি। বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের যে অস্তিত্ব-সংকট তা তার লেখা গল্প, তার ২২টি উপন্যাস ও প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে। ‘আ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ (১৯৬১), ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’ (১৯৭১), ‘হাফ এ লাইফ’ (২০০১) তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

ভি এস নইপল নোবেল পাওয়ার আগেই ১৯৯০ সালে ‘স্যার’ উপাধি লাভ করেন। আর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ২০০১ সালে। তার লেখা উপন্যাস এবং ভ্রমণকাহিনী চমৎকার। গদ্যের প্রশংসা সবাই করেন। কাহিনী বলার ঢংটিও বেশ চমকপ্রদ। আরেক নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক জি এম কোয়েটজি ২০০১ সালে দ্য নিউইর্য়ক রিভিউ অব বুকস-এ নইপলকে ‘আধুনিক ইংরেজি গদ্যের একজন মাস্টার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। নোবেল কমিটি নইপলকে তুলনা করেন জোসেফ কনরাডের সঙ্গে, বলেন ‘কনরাডের উত্তরসূরি’।

সর্বশেষ খবর