রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ২৩

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ২৩

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। এই শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে।

সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান।

 এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। হেরেমের অভ্যন্তরীণ নানা দিক ছাপিয়ে রোডস অভিমুখে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সুলেমান। গল্পের এই পর্যায়ে এসেও চলছে যুদ্ধ প্রস্তুতি। অনেক পাঠকই সবখণ্ড একত্রে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আগামী একুশে বইমেলায় পুরো উপন্যাসটি বাজারে আসবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ২৩তম পর্ব।

 

[ পূর্ব প্রকাশের পর ]

হঠাৎ করেই প্রাসাদে একটা শোকের হাওয়া বইতে লাগল। মাহিদেভরানের বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। দুদিন আগেও সুলতানার সন্তানসম্ভবা হওয়ার খবরে আনন্দে নেচে উঠেছিল পুরো প্রাসাদ। কিন্তু আজ পুরোই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এই শোকের খবরে একজনই কেবল খুশি। হুররেম। কিন্তু সই খুশি প্রকাশ করতে গিয়ে এমন ঘটনার জন্ম হবে কেউ ভাবতে পারেনি। সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর মাহিদেভরান বিকালে বের হয়েছেন বাগানে ঘুরবেন বলে। সঙ্গে খাস বাদী সরা খাতুন। হারেম থেকে বেরোবার মুখে দেখা হয়ে গেল হুররেমের সঙ্গে। মাহিদেভরানকে দেখেই হুররেমের মাথায় কোন ভূত চাপল কে জানে। কোনো কারণ ছাড়াই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। মাহিদেভরানকে কুর্নিশ করা দূরে থাকুক, উল্টো তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন। কাছাকাছি আসতেই মাহিদেভরানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করতে লাগলেন হুররেম। ‘মাহিদেভরান, এবার তোমার দিন শেষ। কই? কই তোমার নতুন শাহজাদা? মনে রেখ আমি এই প্রাসাদের সুলতানা হব। শিগগিরই সুলতানের সন্তানের মা হব।’

হুররেমের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন মাহিদেভরান। পাশেই দাঁড়িয়ে হতভম্ব সারা খাতুন। চড় খেয়ে মুখ তুলে আবারও সেই খুনে দৃষ্টি হুররেমের। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি।

আরেকবার ধৈর্য হারালেন মাহিদেভরান। এবার রীতিমতো গলা টিপে ধরলেন হুররেমের। ‘ছাড় আমাকে...’ বলার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সুলতানার ইশারা পেয়ে সারা খাতুনও এসে জাপটে ধরেছে হুররেমকে। মাহিদেভরানের চেয়ে শক্তিশালী হলেও একা একা দুজনকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থা ছিল না তার। সন্তান হারানোর বেদনা আর একাকীত্বে উন্মাদনা ভর করেছিল মাহিদেভরানের মনে। সেই উন্মাদনার শিকার হলেন হুররেম। চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি আর খামচিতে একসময় জ্ঞান হারালেন হুররেম। ঠিক তখনই সুলতানের কামরা থেকে বেরিয়ে এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন পারগালি ইব্রাহিম।

ইব্রাহিমকে দেখে সারা খাতুন আর মাহিদেভরান দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লেন। কিন্তু পারগালি ঠিক চিনে ফেলেছেন দুজনকেই। পাশেই হুররেমের নিথর দেহ। আঘাতে আঘাতে লাল হয়ে গেছে হুররেমের ফর্সা শরীরের নানা অংশ। গালের এক পাশে নখের আঁচড়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। হারেমের দু ইবাদীকে ডেকে দ্রুত ঘরে ঢোকানো হলো হুররেমকে। হেকিম ডাকা হলো। পারগালি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। হুররেমের চিকিৎসা চলছে। চেচামেচির কারণ জানতে গিয়ে ঘটনা টের পেয়ে গেছেন স্বয়ং সুলেমানও। তখনও জ্ঞান ফেরেনি হুররেমের। মাথায় পানি দেয়া হলো। চামচে করে ভেষজ রস দেয়া হলো মুখে। সুলেমান এসে হুংকার করে উঠলেন ‘কী হয়েছে হুররেমের?’

পুরো কক্ষ কেঁপে উঠল। সবাই চুপচাপ। আস্তে করে হুররেমের মাথায় হাত রাখলেন সুলেমান। তখনই চোখ খুলল হুররেম। ব্যথার্ত গলায় বলে উঠল..‘সুলতান...আমার সুলতান।’

‘আমি আছি হুররেম।’ শক্ত করে হুররেমের হাত চেপে ধরলেন সুলতান। ইব্রাহিমের দিকে কঠোর দৃষ্টি। ইব্রাহিম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।

হেকিমকে খেয়াল রাখার কথা বলে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন সুলতান। ইশারায় ইব্রাহিমকে ডেকে নিলেন।

নিজের কামরায় লাল গালিচার ওপর ঘন ঘন পা ফলে বেশ দ্রুততার সঙ্গে পায়চারি করছেন সুলতান।

ইব্রাহিমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হুট করে পায়চারি থেমে গেল। ইব্রাহিমের দিকে প্রশ্নাতুর দৃষ্টি।

‘হুজুর..মাহিদেভরান সুলতান..।’ ইব্রাহিমের মুখের কথা শেষ না হতেই আক্রোশে ফেটে পড়লেন সুলেমান।

‘মাহিদেভরান? কী বলছো ইব্রাহিম?’

‘আপনার কক্ষ থেকে বের হয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখেই মাহিদেভরান আর সারা খাতুন দ্রুত চলে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি হুররেম খাতুন বেহুশ পড়ে আছে।’

সুলেমানের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। আরেকবার রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। আবার পায়চারি শুরু করেছেন। ‘তুমি এখন যাও।’ ইব্রাহিম চলেই যাচ্ছিল। সুলতান আবার ডাকল।

‘আজ রাতে হুররেম আমার ঘরে থাকবে। আমি নিজে ওর দেখাশোনা করব।’

সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন খাস কামরাপ্রধান। হুররেম খাতুনের প্রতি সুলতানের ভালোলাগা কতটা বেশি, সেটা আরেকবার টের পাওয়া গেল।

 

এরকম একটা কাজের জন্য বেগম সুলতানা কড়াভাবে শাসালেন মাহিদেভরানকে। শাশুড়ির এমন অগ্নিরোষের মুখে খুব বেশি  পড়েননি মাহিদেভরান। হুররেমের বেয়াদবির কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু লাভ হলো না। আয়েশা হাফসা সুলতান সেটা শুনতে রাজি নন। সাধারণ একটা দাসী মেয়ে প্রাসাদের নিয়ম ভাঙতেই পারে। তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মাহিদেভরান সুলতানের স্ত্রী। একজন সুলতানা হয়ে তার এহেন আচরণ কিছুতেই মানা যায় না। কাজটা যে ঠিক হয়নি এখন সেটা বুঝতে পারছেন মাহিদেভরান নিজেও। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই।

একের পর এক মন খারাপের যাঁতাকলে পিষ্ট মাহিদেভরান। নিজের ঘরে শুয়ে কাঁদছিলেন। হঠাৎ হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলো সারা খাতুন। কিন্তু মাহিদেভরানের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলেন। কিন্তু মাহি বুঝতে পারলেন ঠিকই। সারা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেছে। কী সেটা? জানতে হবে। প্রথমে বলতে না চাইলেও মাহিদেভরানের পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হলো সারা। সুলতান জেনে গেছেন। আর নির্দেশ দিয়েছেন মেয়েটাকে সুলতানের ঘরে পৌঁছে দিতে। সুলতান নিজে নাকি তার দেখাশোনা করবে। সারার কণ্ঠে অনিশ্চিত ভয় আর পাহাড়সম দ্বিধা। মাহিদেভরান নিষ্পলক চেয়ে আছেন। চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা অশ্রু চিক চিক করে উঠল।

 

বসফরাসের ঠাণ্ডা বাতাস আর হাল্কা কুয়াশায় রাত নেমেছে আরও আগেই। দাবার ঘুঁটি উল্টে দিয়ে আরেকবার সুলতানের কাছাকাছি হুররেম। এক কম্বলের নিচে অটোমান অধিপতি আর সাধারণ এক দাসী।

‘সুলতান..আপনি সত্যি যুদ্ধে যাবেন?’ হুররেমের আদুরে প্রশ্ন।

‘যুদ্ধ ছাড়া সুলতানের জীবন মিথ্যে হুররেম। এটাই আমাদের ঐশ্বর্য।’ আঙুরের থোকা থেকে কয়েকটা ছিঁড়ে নিলেন সুলতান। একটা হুররেমের মুখে পুরে দিলেন। আরেকটা নিজে নিলেন।

‘আমার ভয় করে।’ আধশোয়া সুলতানের হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে সটান শুয়ে থাকা হুররেম।

‘কিসের ভয়? আমি তো আছি।’

‘আপনি থাকলে তো ভয় নেই। কিন্তু আপনি চলে গেলে ওরা আমায় মেরে ফেলবে।’

হুররেম যতটা না ভীত, তার চেয়ে বেশি ভয়ের অভিনয় করল।

‘কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে যাব।’ মাথায় হাত রেখে হুররেমকে আশ্বস্ত করেন সুলতান।

‘কবে যাচ্ছেন?’

‘পরশু সন্ধ্যায়।’

‘সন্ধ্যায় কেন? দিনের আলোতে গেলে ভালো হতো না?’

‘দীর্ঘদিনের যুদ্ধযাত্রা। প্রচুর ধকল যাবে। শুরুতে যে এলাকা পার হব, সেগুলো সব আমার নিজের এলাকা। তাই রাতেও সমস্যা হবে না। তাছাড়া এ কয়দিন রাত আর দিন বলে কিছু থাকবে না। শুরু থেকে সবাই সে অভ্যাসটা করে নিতে পারলে আমাদেরই সুবিধা।’

‘আমায় নেবেন?’ হুররেমের আদুরে বায়না।

‘যুদ্ধ জান?’ সুলতানের পাল্টা জিজ্ঞাসা। জবাবে মাথা নাড়ে হুররেম।

‘যুদ্ধ না জানলে গিয়ে কী হবে? উল্টো বিপদে পড়বে।’

‘তা অবশ্য ঠিক।’ সুলতানের কথায় হুররেমের সম্মতি।

‘কিন্তু আপনাকে ছাড়া আমি একা একা কী করে এখানে থাকব? এই প্রাসাদে আমার কেউ নেই। সবাই আমায় হিংসে করে।’ ইনিয়ে বিনিয়ে বলল হুররেম। অমন আদুরে কথা বেশ ভালো লাগে সুলেমানের।

‘কেন হিংসে করবে কেন?’

‘এই যে আপনি আমায় ডাকেন। তাই।’

‘অন্য কাউকে ডাকলে তোমার হিংসে লাগবে না?’

‘অবশ্যই।’ হুররেম সপ্রতিভ।

‘তাহলে সেটা মেনে নিতে হবে।’ সুলতানের স্বাভাবিক উত্তর।

কয়েক সেকেন্ড পর উঠে গিয়ে আলোটা কমিয়ে দিলেন সুলেমান। এরপর হুররেমের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লেন। হুররেম পাশ ফিরে সুলতানের দিকে ঝুঁকে এলেন। হুররেমের গরম নিশ্বাস সুলতানকে জাগিয়ে দিল।

‘ঘুমাও তোমার শরীর খারাপ।’

‘আমার সুলতানের জন্য আমার কোনো খারাপ লাগা নেই। আমি সবসময় সুলতানকে এমন করে পেতে চাই।’ বলেই স্বভাবসুলভ হুররেম। কোথায় আঘাত আর কোথায় অসুস্থতা। সুলতানের ঠোঁটের আশ্রয়ে সব পালিয়েছে। কয়েক মিনিট আগেও নিস্তেজ থাকা সুলেমানও হঠাৎ জেগে ওঠে।

রাত বেড়েছে। আলোটা বুঝি এমনি এমনি কমে এলো। কম্বলের উষ্ণতা বাড়তে লাগল। সুলেমানের কবি মন কামকাব্য সাধনায় মত্ত হলো। না হয়ে উপায় আছে? সুলতানরাও যে রক্তমাংসের মানুষ!

 

যুদ্ধযাত্রা একেবারে সন্নিকটে। শেষ মুহূর্তের আলাপ সেরে নিচ্ছেন সভাসদরা। পীরে মেহমুদ পাশার নেতৃত্ব দরবার কক্ষে গোল হয়ে বসেছে সবাই। পীরে পাশার পরিবর্তে কাশিম পাশা পালন করবেন দায়িত্ব। বেগম সুলতানার পছন্দের মানুষ তিনি। এমনিতে মানিসার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। দুদিন আগেই সেখান থেকে ডেকে আনা হয়েছে তাকে।  অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব তাকে ভালো মতো বুঝিয়ে দিলেন পীরে পাশা। আটজন বিশেষ ঘোরসওয়ারী দূতকে ডাকা হয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে এরাই বার্তাবাহকের কাজ করবে। পারগালি ইব্রাহিম এদের প্রত্যেককে সুলতান ও অটোমান বাহিনীর যাত্রাপথের বিস্তারিত তথ্য দিলেন। কয়দিনের মাথায় ঠিক কোন দিকে তাঁবু খাটানো হবে সেরকম একটা ধারণাও দিয়ে দিলেন। কক্ষের বাইরে থেকে একজন রক্ষী উঁকি দিল। পীরে পাশার দিকে লক্ষ্য করে বলল- ‘হুজুর দানা হালিল আপনাদের সাক্ষাৎ প্রার্থী।’

‘আসতে বল।’ পীরে পাশার সহজ উত্তর।

দুলতে দুলতে ভেতরে ঢুকল দানা হালিল।

‘আমায় মাফ করবেন আপনাদের বিরক্ত করলাম বলে।’ দানা হালিলের মুখজুড়ে স্বভাবসুলভ মেয়েলি হাসি।

‘সমস্যা নেই, দানা হালিল। বলে ফেলুন।’ পীরে পাশা মুখ তুলে তাকালেন। অন্যদেরও একই রকম সজাগ দৃষ্টি দানা হালিলের দিকে।

‘বেগম সুলতানা আপনাদের সবাইকে সাধুবাদ দিয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করছেন সুলতান সুলেমান ও আপনাদের যোগ্য নেতৃত্বে অটোমানদের ঝাণ্ডা উড়বে সবখানে।’

‘ইনশাআল্লাহ... ইনশাআল্লাহ।’ একসঙ্গে বলে উঠল প্রায় সবাই।

‘আপনাদের যুদ্ধযাত্রার আগে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সবার আমন্ত্রণ। বেগম সুলতানা সবাইকে রাতের খাবার খাওয়াবেন। স্বয়ং সুলেমানও থাকবেন। জেনেসারিসদের তরফ থেকে একজনকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলা হয়েছে। পারগালি ইব্রাহিমের কাছে এটা বলতে বলেছেন সুলতানা।’

 

দানা হালিলের দৃষ্টি সুলতানের খাস কামরা প্রধান পারগালির দিকে।

‘হয়ে যাবে দানা। আর কিছু?’ পারগালি ইব্রাহিম খানিকটা বিরক্ত।

‘জি হ্য্যাঁ। কাশেম পাশাকে স্মরণ করেছেন বেগম সুলতানা।’

‘আমাকে?’ কাশেম পাশার কণ্ঠে বিস্ময়। সেইসঙ্গে খানিকটা গৌরবের ঝিলিকও দেখা গেল।

‘জি আপনাকেই পাশা।’

‘কখন যেতে হবে?’

‘আমার সঙ্গেই যেতে হবে।’

‘তাহলে আমায় আজ্ঞা দিন।’

পীরে পাশা ইশারায় যেতে বললেন তাকে। দানা হালিলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন কাশেম পাশা।

সভাসদরা ফেরত গেলেন আগের আলোচনায়। অস্ত্রশস্ত্র, রসদ আর অন্যান্য প্রস্তুতি সবই তৈরি। এখন কেবল যাত্রা করার পালা।

প্রার্থনা আর খাবারের আয়োজনে বেগম সুলতানা যতটা সপ্রতিভ, সুলতান সুলেমান ততটাই নিষ্প্রাণ। বোঝাই যাচ্ছে কোনো কারণে বিক্ষিপ্ত তিনি। এক ফাঁকে সুলতানের কানের কাছে গিয়ে সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললেন পারগালি- ‘সুলতান কোনো সমস্যা?’

‘কেন কী হয়েছে ইব্রাহিম?’ প্রশ্নটা সম্ভবত ভালো লাগেনি সুলতানের।

‘মাফ করবেন সুলতান। এমনি জিজ্ঞেস করেছি। আসলে কালই আমরা রওনা হচ্ছি। যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে আপনাকে আরও চাঙ্গা দেখব ভেবেছিলাম। এতে অন্যরাও চাঙ্গা হতো।’

ইব্রাহিমের কথার কোনো উত্তর দিলেন না সুলতান। কয়েক চুমুক মাদিরা ঢক ঢক করে গিললেন। তারপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিলেন যুদ্ধ জিতলেই সবার জন্য থাকছে পুরস্কার। নেতৃত্বদানকারীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পাবেন প্রশাসকের পদ। কেউ কেউ পাশাও হয়ে যেতে পারেন! আয়েশা হাফসা সুলতান ছেলের সাফল্য কামনা করলেন। এই পুরস্কারের ঘোষণার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন। সদম্ভে ঘোষণা করলেন ‘জয় আমাদের নিশ্চিত।’

আরেক ফাঁকে পারগালিকে আস্তে করে ধন্যবাদ জানালেন সুলতান। ‘ইব্রাহিম তোমাকে ধন্যবাদ। সত্যি আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। যুদ্ধযাত্রার আগে এমন থাকা মোটেও উচিত হতো না। সে কথা তুমি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছ। তোমাকে ধন্যবাদ। এখন সব ঠিক আছে তো?’ ইব্রাহিমের দিকে হাসি হাসি মুগ্ধতার চাউনি সুলেমানের।

‘আমায় লজ্জা দেবেন না সুলতান। আপনি আমায় ভালোবাসেন বলেই মাঝে মাঝে অনেক কিছু বলার সাহস করি। কখনো না বুঝে কোনো ভুল করলে আমায় মাফ করবেন।’ ইব্রাহিম একেবারে পেশাদার। জবাবে আবার হাসলেন সুলতান।

‘হুম। আচ্ছা কাশেম পাশাকে ডাক।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাশেম পাশাকে সামনে ডেকে আনলেন ইব্রাহিম। কুর্নিশের জবাব দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন সুলতান।

‘দায়িত্ব সব বুঝে নিয়েছেন পাশা?’

‘জি সুলতান।’

চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর