বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সোনার খনি

তানিয়া

সোনার খনি

শত শত ফুট মাটির নিচে, পাহাড়ের পাথুরে খাঁজে খাঁজে এভাবেই আটকে থাকে দুর্লভ সোনা

সোনা পছন্দ করে না এমন মানুষ নেই। পৃথিবীর শুরু থেকেই এই মূল্যবান সম্পদটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। তবে, আগে মানুষের এই সম্পদটি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। জানা ছিল না সোনা উত্তোলনের কৌশল। বিভিন্ন খনির সন্ধানও ছিল না তাদের কাছে। সময়ের বিবর্তনে মানুষ সোনা নিয়ে রাজত্ব করতে শিখেছে। গড়ে তুলেছে বিভিন্ন  সোনার মহল। বিশ্বজুড়ে থাকা এই সোনার ভাণ্ডার নিয়ে ঘটে যাওয়া নানা ইতিহাস জানা যাবে আজকের রকমারিতে।

 

স’মিল বসাতে গিয়ে সোনা!

১৮৪৮ সালে জন সাটার নামের এক মার্কিন ধনাঢ্য আবাসন ব্যবসায়ী দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বড় আবাসন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে কাজে তার প্রচুর কাঠ প্রয়োজন হলো। প্রকল্পের পাশেই সাটার একটি স’মিল বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কাছেই সাক্রামেন্টো পাহাড়ে সেই স’মিল বসানোর দায়িত্ব দিলেন বর্তাল জেমস মার্শালকে। এই কাজে মাটি খোঁড়ার সময় মার্শাল আবিষ্কার করলেন মাটির নিচে সোনালি কিছু একটা চকচক করছে। আবিষ্কারের আনন্দে তার চোখ জোড়াও চকচক করে উঠল। তিনি প্রথম সোনার খনি আবিষ্কার করেছেন।

জন সাটারের স’মিলে পরিখা খননের প্রয়োজনে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতি রাতে নদীর পানির দিক পরিবর্তন করে স’মিলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত করা হতো। দিনের বেলা সেই প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনের বেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ করে মার্শাল পরিখার অবস্থা দেখতে গেলেন। শুকনো পরিখায় মার্শাল এক তাল চকচকে উজ্জ্বল ধাতব কিছু একটা দেখতে পান সোনালি রঙের। দেখেই তার চোখ চকচক করে উঠল। তিনি দুটি পাথর দিয়ে ধাতব তালটাকে পিটিয়ে দেখলেন। সেটি ছড়িয়ে গিয়ে বড় হলো, কিন্তু ভাঙল না। ব্যস, মার্শাল নিশ্চিত হলেন, ওই তালটা সোনারই।

 

গোল্ড রাশ

সোনার খবর প্রকাশ হলে কোলোমায় দলে দলে লোক সমাগম ঘটে। খুব দ্রুত সোনার খোঁজে মানুষের উন্মত্ততা বা ‘গোল্ড রাশ’ চূড়ায় ওঠে। এই ‘গোল্ড রাশ’ মোটামুটি বছর বিশেক স্থায়ী হয়। গোল্ড রাশের সময় আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বড় দেশান্তরের ঘটনা ঘটে। সোনার খোঁজে প্রায় লাখ পাঁচেক লোক পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটে আসেন। সাগরপথ-সড়কপথ, সব পথেই লোকের ভিড় লেগে যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জল-জঙ্গল ডিঙিয়ে মানুষ ক্যালিফোর্নিয়ায় আসতে থাকেন। এই লোকজন আসার ঘটনা ঘটে মূলত ১৮৪৯ সালে। তাই এদের নামই দেওয়া হয় ‘ফোর্টি নাইনার্স’। সব আশা গুঁড়িয়ে সোনার দেখা আর মেলে না। খনিতে থাকা-খাওয়ার কষ্ট তো আছেই, সঙ্গে যুক্ত হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা। তার ওপর খনির হাড়ভাঙা খাটুনি তো আছেই।

 

সোনার ভাণ্ডার

সোনা সব মানুষের জনপ্রিয় মূল্যবান খনিজ পদার্থ। আর সেই সুবাদে যেখানেই সোনার খনির সন্ধান মিলেছে সেখানেই মানুষ ছুটে গেছে। তবে বিশ্বের সব দেশেই তো আর সোনার ভাণ্ডার নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দেশে রয়েছে এই খনি। উপমহাদেশীয় ভারতেই রয়েছে সোনার বিশাল ভাণ্ডার। বিজনেস ইনসাইডারের জরিপে বর্তমানে এশিয়ার এই অন্যতম বৃহত্তম দেশটির রয়েছে প্রায় ৫৫৭.৭ টন সোনার ভাণ্ডার। ভারতীয়দের নিজেদের পুরনো বিশ্বাস যে, সোনার ওপর টাকা খরচ করলে তা ক্ষয় হয়। তাই হয়তো বিশাল এই ভাণ্ডারের ওপর তাদের কোনো নজর নেই। বিশ্বের আরেকটি সোনার ভাণ্ডারের দেশ নেদারল্যান্ডস। বেশ কিছুদিন আগেও তাদের দেশে সোনা বিক্রির হিড়িক ছিল। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এর আগে ডাচরা কখনোই তাদের এই হলুদ টাকার ওপর হাত দেয়নি। নেদারল্যান্ডসে প্রায় ৬১২.৫ টন সোনা রয়েছে। এশিয়ার আরেক দেশ জাপানও বিশাল  সোনার উৎস। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জাপানিদের সোনা ছিল মাত্র ৬ টন। তবে বর্তমানে জাপানে ৭৬৫.২ টন সোনার বিশাল মজুদ রয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও রাশিয়াও সোনার দৌড়ে পিছিয়ে নেই। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের কাছে দেশটির দেওয়া তথ্যানুসারে বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের রয়েছে ১,০৪০ টন সোনা। অন্যদিকে বৃহত্তর রাশিয়ার রয়েছে প্রায় ১৩৫২.২ টন সোনার ভাণ্ডার। এশিয়ান চীনের সোনার ভাণ্ডার হলো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সুফল। বর্তমানে দেশটিতে সোনা রয়েছে প্রায় ১,৭০৮.৫ টন। অন্যদিকে ফ্রান্সের কথা বলতে গেলে দেশটির ডানপন্থি নেতা মেরিন লে পেনের ভূমিকা সম্পর্কে বলতেই হয়

 যিনি কিনা ২০১৪ সালে দেশটিকে সোনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ব্যাপক উৎসাহ দেন। বর্তমানে দেশটির সোনার মজুদ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২,৪৩৫.৫ টনে। ইতালির ভাণ্ডারে রয়েছে ২,৪৫১.০ টন সোনা। অন্যদিকে জার্মানির হাতে রয়েছে প্রায় ৩,৩৮১ টন পরিমাণের সোনা। আমেরিকার সোনার মজুদও কম নয়। ১৯৫২ সালের আগে ছিল প্রায় ২০,৬৬৩ টন।

পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে পরিমাণ কমতে থাকে। বর্তমানে এ দেশটির সোনার ভাণ্ডার রয়েছে মোট ৮১৩৩.৫ টন।

 

ভূমিকম্পেই সোনা

ভূমিকম্প পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র। বদলে দিতে পারে গতিপথ। ধ্বংস করে দিতে পারে সভ্যতা, সুউচ্চ পাহাড়। তবে সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে বোমা ফাটালেন বিজ্ঞানীরা। ভূমিকম্পের ফলে নাকি সোনা তৈরি হয়। অবাক হলেও এর সত্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের ফলে নাকি সৃষ্ট ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থগুলো খণ্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরিত হয়।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের ভূপদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক ডিওন ওয়েদারলি এই গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ তাপ ও চাপের ফলে তরল পদার্থগুলো পৃথক পৃথক কণায় রূপান্তরিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন পদার্থ।

ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে পানির সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সিলিকা মিশে থাকে। যখন ভূকম্পন হয়, তখন প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে ভেঙে যায় সেখানকার পানির কণাগুলো। এতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়। তখন অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো সোনার উপাদানগুলো সেখানে বালি ও কাদামিশ্রিত অবস্থায় থাকে। এভাবে সোনার খনিও সৃষ্টি হতে পারে।

 

সবচেয়ে বড় সোনার খনি

গ্রাসবার্গ খনি : পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোনার খনি গ্রাসবার্গ। এই খনির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রিপোর্ট। এটি একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামার খনিও। গ্রাসবার্গ খনিটি ওসেনিয়া মহাদেশের পাপুয়া নিওগিনিতে অবস্থিত। এখানে কর্মরত আছেন ১৯ হাজার ৫০০ কর্মী। ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই খনি থেকে সোনা উত্তোলন করা যাবে। গ্রাসবার্গ খনিতে এখন পর্যন্ত ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন সোনা মজুদ আছে। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে এই খনিতে মোট সংরক্ষিত সোনার পরিমাণ ছিল ৬.৫ মিলিয়ন আউন্স। খনি পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর মতে, গেল ২০১৩ সালে খনিটি থেকে ১.২৫ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়।

ওয়ানকোচা খনি : পেরুর আনদেস পর্বতমালায় অবস্থিত ওয়ানকোচা খনি লেটিন আমেরিকার বৃহত্তম সোনার খনি। এটি ১৯৯৩ সালে আবিষ্কৃত হয়। এর তিনটি সক্রিয় খনি আছে। এই খনি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২৬ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্পন্ন হয়েছে। এই খনি পরিচালনা কোম্পানির নাম নিউমন্ট মাইনিং। ২০১২ সালে এই খনি থেকে ১.৩৪৬ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই খনিতে ৩ মিলিয়ন আউন্স সোনা মজুদ আছে।

গ্লোডস্ট্রাইক খনি : গ্লোডস্ট্রাইক খনিটি আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন অঞ্চলের নিভাদা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। খনিটি ব্যারিক গোল্ড কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। সোনার ভাণ্ডার খ্যাত কোম্পানিটি ১৯৮৭ সালে চালু হয়। গোল্ডস্ট্রাইক সোনার খনি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ৮.৫ মিলিয়ন সোনা উত্তোলন করা হয়। ২০১৬ সালে এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৭৫ হাজার আউন্স থেকে ১ কোটি ৭৫ হাজার আউন্স পর্যন্ত। এই খনিতে প্রতি আউন্স সোনা উত্তোলনে খরচ হয় ৭৮০ থেকে ৮৫০ ডলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর