বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বন্ধুদের চোখে শাকিল

বন্ধুদের চোখে শাকিল

মাহবুবুল হক শাকিল [জন্ম : ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৮—মৃত্যু : ৬ ডিসেম্বর ২০১৬]

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ফেসবুকে ছিলেন সক্রিয়। ফেসবুকে ভেসে উঠত তার জীবনের গল্পগুলো। কখনো প্রেমিক কবি, কখনো আবেগের গভীরতম বর্ণনায় পাঠকদের ছুঁয়ে গেছেন তিনি। তার মৃত্যুর পর অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী তার এই লেখাটি প্রচার করছেন বারবার—

 

আমি চলে যাবার পরেও

 মাহবুবুল হক শাকিল

আমি চলে যাবার পরেও ঢাকার রাস্তায় থাকবে নিত্যদিনের যানজট, রিকশার টুংটাং পথচলতি মানুষের মিছিল, মফস্বল থেকে আসা বোকা মুখের বিস্ময়।

রাজনীতির তুমুল তর্ক থাকবে, ক্ষমতার পালাবদল থাকবে, চলমান থাকবে বহুতল ভবনের নির্মাণ। থাকবে আজকের মতোই ভালোবাসা-বাসি। বিরহী প্রেমিকের বিষণ্নতা, অভিমানী  প্রেমিকার কান্না। চলে যাবার পরেও থেমে থাকবে না সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত, জন্ম এবং সৎকার।

যে প্রিয় বইয়ে বারবার ছোঁয়াতাম তৃষার্ত আঙুল, তেমনি আর কারও আঙুল ছুঁয়ে যাবে আরেকটি বইয়ের পাতা।

শূন্য থাকবে না পানশালায় প্রতিদিনের নির্ধারিত চেয়ার জানালার পাশে, যেখানে বসে স্থবির আমি চলাচল শহর দেখতাম।

আমার মা সন্তান বিয়োগের দুঃখে চোখ ভাসাবেন জলে। প্রাকৃতিক নিয়মেই; দীর্ঘতর হবে আমার পিতার জায়নামাজে বসে থাকার স্থিতিকাল।

একমাত্র সহোদর নিঃসঙ্গ হতে হতে একসময় বুঝে যাবে একাকিত্বই জীবনের মৌলিক ভ্রাতা, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়।

মেনে নিতে কষ্ট হবে প্রিয়তমা কন্যার, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আর স্বপ্নজুড়ে আমাকে দেখে সারারাত জেগে থাকবে বোবা কান্না নিয়ে। একসময়ে সেও বড়ো হবে, পিতাকে নিয়ে সযতনে রাখা কষ্ট-স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে নতুন স্বপ্নের উৎসবে। কোনো একদিন সুখী হবে আমার আত্মজা।

চলে যাবার পথে আমি দূর-দ্বীপবাসিনী দুটি চোখ দেখি, সেই চোখে আমি কোনো কান্না দেখি না। পেশাদারি ব্যস্ততা দেখি, সংসার সাজানোর নিত্য-নতুন আয়োজন দেখি।

কেবলমাত্র দুর্লভ অবসরে মীর্জা গালিব বা রবীন্দ্রনাথ যখন তার সঙ্গী তখন টের পাই আমার চলে যাবার পথে এক বিরল দীর্ঘশ্বাস, মুক্তার দানার মতো অশ্রুবিন্দু।

আমি চলে যাবার পর পৃথিবীর আর কোনো ভাবান্তর দেখিনা।

 

 

ডিসেম্বরের ৫ তারিখ। সন্ধ্যা ৬টা ২৭ মিনিটে ফেসবুকে এই হূদয়ছোঁয়া কবিতাটি লিখেন মাহবুবুল হক শাকিল। কে জানত, তার সময় যাচ্ছে ফুরিয়ে?

‘‘

 

এলা, ভালোবাসা, তোমার জন্য

কোনো এক হেমন্ত রাতে অসাধারণ

সঙ্গম শেষে ক্লান্ত তুমি, পাশ ফিরে শুবে।

তৃপ্ত সময় অখণ্ড যতিবিহীন ঘুম দিবে।

তার পাশে ঘুমাবে তুমি আহ্লাদি বিড়ালের মতো,

তার শরীরে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে, মাঝ রাতে।

তোমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে এক প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাস,

আরও একবার তোমাদের মোথিত চুম্বন দেখবে বলে।

মৃতদের কান্নার কোনো শব্দ থাকে না, থাকতে নেই,

নেই কোনো ভাষা, কবরের কোনো ভাষা নেই।

হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি,

তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে।

 

ইচ্ছা-বিদায়ের বরপুত্র

জীবনভর যদি আহ্লাদ দিয়ে থাকি, ইচ্ছা-বিদায়েও সংহতি রইল। পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যারা পার্থিব নিয়ম-শৃঙ্খলা, চাওয়া-পাওয়া ও সরল হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে। তাদেরকে সসীমে বেঁধে রাখা যায় না।

শাকিল, তোকে তাই ছেড়ে দিলাম অনন্তের পথে। যদি কোনো দিন তোর উচ্চতায় পৌঁছুতে পারি, হতে পারি চূড়ান্ত নির্মোহ ও অকৃপণ, নিশ্চয়ই দেখা হবে আবারও বেহিসেবি কোনো এক রাতে।

 

— মোজাম্মেল বাবু

প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন

 

আমাকেও লাশের বোঝা বইতে হচ্ছে

আমাকেও লাশের বোঝা বইতে হচ্ছে

শাকিল। কতদিন ধরে ওকে চিনি? তার  ছোটবেলায়, সে তখন স্কুলের ছাত্র— আমরা ময়মনসিংহে ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে দাপিয়ে বেড়াই।

যে কোনো কর্মসূচিতে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, কল কল করতে করতে একদল ছাত্র এসে শামিল হয় আমাদের সাথে। তাদেরই একজন শ্যামলা বরণের শাকিল। স্লোগান দেয়, কবিতা লেখে, ভালো বক্তৃতা দেয়। হয়ে যায় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী, আমার ছোট ভাই।

এই ছোট ভাই-বড় ভাই সম্পর্ক ম্লান হয়নি  কোনোদিন। কালক্রমে শাকিল বড় হয়েছে, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পা রেখেছে ছাত্রলীগে। পেশাগত জীবনে সে আরও বড় হয়েছে। তার সব আমি অনুমোদন করেছি এমনটি নয়, সে আমার সব অনুমোদন করেছে তাও নয়। কিন্তু আচরণে কোনো প্রভাব পড়েনি। সামনে বাবা ডেকে পেছনে ছুরি মারার চরিত্র ছিল না তার। তার বাবাও আমার শ্রদ্ধার পাত্র সব সময়ই ভিন্ন সমীকরণে।

আজ শাকিলের লাশ তার বাবার কাঁধে, আমাকেও  তো বহন করতে হচ্ছে এই লাশের বোঝা।

 

—মনজুরুল আহসান বুলবুল

সিইও, একুশে টেলিভিশন

 

মন খারাপের সকাল

তিনি মূলত কবি। ‘মন খারাপের গাড়ি’ নামে তার একটি কবিতার বই আছে। কিন্তু কে জানত ৪৭-এ সবাইকে বিষণ্ন করে মন খারাপের গাড়ি থেমে যাবে শেষ গন্তব্যে। বেঁচে থাকতে তাকে কখনো কিছু দেয়া যায়নি। আর এখন তো তিনি সব চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ার ঊর্ধ্বে। কাল ঘুমিয়েছেন হিমঘরে, আজ শুয়ে যাবেন মাটির ঘরে। তিনি ছিলেন অকপট। যা বিশ্বাস করতেন, বলে ফেলতেন। কত মধ্যরাতে ফোন করে, শিশুর মতো হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, আই লাভ ইউ ব্রাদার। আড়ষ্টতায় আমি তেমন বলতে পারতাম না। কিন্তু আমি জানি, তিনি জানতেন, আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি। আর আজ যখন সবাই তার জন্য কাঁদছে, তখন তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

 

—প্রভাষ আমিন

অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

 

শাকিল ছিল জাতপ্রেমিক

শাকিল ছিল জাতপ্রেমিক। ক্ষমতার প্রাসাদে জীবিকাবাস করলেও ঐ প্রাসাদ ওর প্রেমিক-মনে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি। প্রেমের কারণে একবার সাময়িক চাকরিচ্যুতও হয়েছিল। তখন রোজ মধ্যরাতে ফোন করে সদ্যলেখা কবিতা শোনাত। ক্ষমতাকালেও একাধিকবার এমন হয়েছে। কবিতাগুলোকে কখনো আমার শিল্পোত্তীর্ণ মনে হয়নি। কিন্তু, শাকিলের নির্মল আবেগকে কোনো দিন এড়াতে পারিনি।

ভাবতে বড় কষ্ট হচ্ছে, মধ্যরাতে শাকিলের গলায় আর আবেগের কথাগুলো শুনব না।

 

—আবু হাসান শাহরিয়ার, কবি

 

তার ছিল খরচের হাত

তার ছিল খরচের হাত। দুহাতে উড়িয়ে গেলেন তাই জীবন দেদার

—মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা

 

আমার সারা জীবনের শোক

বিজয়ের মাসে আমার সারা জীবনের শোক। দীর্ঘ ১৯ বছরের সুখ-দুঃখের ভাই যেখানেই থাকেন ভালো থাকেন...

—আশরাফুল আলম খোকন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি

 

সেই ছাড়লেন সবকিছু একসাথে

বলেছিলেন, রাজনীতি ছেড়ে দেব। হাসতাম আমরা আপনার কথা শুনে। বলতেন, এখন তো আমার তেমন কোনো কাজ নাই। দলের বিপদের দিনে অনেক কাজ থাকে আমার। এখন বরং পড়াশোনা আর লেখালেখি নিয়ে থাকি, সেটাই ভালো। সেই ছাড়লেন সবকিছু একসাথে, একেবারে।

 

— জুলহাস আলম, ব্যুরো চিফ, এপি

 

অসময়ে চলে গেলি

অবেলায়-অসময়ে চলে গেলি। খুব বেশি বিষণ্ন ছিলি বুঝি। মন বেশি খারাপ করিস না।

পপি, ক্ষমা করো বোনটি আমার, মামণি-র ক্ষমা পাব না জানি।

তিন দশকের স্মৃতি

উজ্জ্বল-প্রাণবন্ত-হাসিমাখা ছবিটা-ই চির-জাগরুক থাক

নিথর-নীরব তোকে দেখব কেমন করে

না, ওভাবে তোকে আমি দেখবই না।

খালাম্মা-খালু-বাবু সবাই ভালো থাকুক

—লিয়াকত শিকদার, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

 

উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন

মাহবুবুল হক শাকিল তার গন্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মৃত্যুর পর উনার প্রতি সর্বসাধারণের জানানো ভালোবাসার জবাবও তিনি আগেভাগেই রেখে গেছেন। পতন হলো ‘আওয়ামী লীগ’ নামক আকাশের আরও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের।

—মাহবুব রাজীব, কুমিল্লা

 

গভীর রাতেও ফোন করে কবিতা শোনাতেন

আমি রাতের বেলা মোবাইল ফোন পাশে রেখে ঘুমাই না। রিংগারও অফ থাকে। কিন্তু কী কারণে সে রাতে আমার মোবাইলটা খুব কাছে বেজে উঠেছিল। নাম দেখি, মাহবুবুল হক শাকিল। আমি উদ্বিগ্নস্বরে জিগ্যেস করলাম, শাকিল ভাই, কী হয়েছে। তিনি বললেন, এখনই একটা কবিতা লিখলাম। শোনেন...

রাত সাড়ে তিনটা। আমি আধো ঘুমে আধো জাগরণে। আমি কবিতা শুনছি...

আমি এই রকম ফুলটাইম কবি আর দ্বিতীয়টা দেখিনি।

কিন্তু কোনোদিন শোনাতেন সকালবেলাতেও। ফোনে কাঁদতেন। আমি বলি, শাকিল ভাই, সকালবেলাতেই শুরু করেছেন। তিনি বলতেন, আপনি আমার মায়ের মতো বলছেন...

 

মেয়ে মৌপিকে তিনি ডাকতেন... বাপ। মেয়ের সাথে কী কী কথা হয়েছে, সংলাপ দিয়ে দিয়ে বলতেন। বাপ, তুই এটা কর ত। বাপ...

এর আগেও এমনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করলাম, হয়েছেটা কী। তিনি হাসতেন। যেন হাসপাতালে যাওয়া একটা মজার ঘটনা। গল্প লিখতে শুরু করেছেন। আনিস ভাই, গল্প লিখেছি, আপনাকে পাঠাচ্ছি, পড়ে বলেন।

একদিন ভোরে ফোন। এখনি লিখেছি। পড়েন।  ছোট আপাকে নিয়ে লেখা তার অপরূপ কবিতাটা শোনালেন। আরেকদিন শোনালেন মাকে নিয়ে লেখা বড় আপার সেই বিখ্যাত স্মৃতিকথাটা লেখার পেছনের কাহিনি। আমি সংসারি মানুষ। নিয়ম মেনে রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া মানুষ। আড্ডা ভয় পাই। কিন্তু এই রকম বেহিসাবি কবি জীবন আমার ভালো লাগে। যেমন আমার ভালো লাগে নির্মলেন্দু গুণকে। যা করেন, তা বলতে লজ্জা পান না। অকপট। মাহবুবুল হক শাকিলেরও কোনো লুকোছাপার প্রয়াস ছিল না। তবে তিনি কবিই হতে চেয়েছিলেন। এটা বিস্ময়কর লাগে। সৈয়দ শামসুল হকের চিকিৎসার খরচের ভার প্রধানমন্ত্রী নিলেন, শহীদ কাদরীকে দেশে আনালেন প্রধানমন্ত্রী, এসবের  পেছনে ছিল এই একটাই মানুষ। কবি মাহবুবুল হক শাকিল।

 

—আনিসুল হক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

 

‘‘ মূলত আমি কেউ না, না রাজনীতিবিদ, না কবি, না গল্পকার, এমনকি নই তুমুল সংসারী। এক অভিশপ্ত চরিত্র যার কিছুই থাকতে নেই। সাধু কিংবা সন্ত নই, চোখ জ্বলজ্বল করে জীবনের লোভে। চন্দ্রাহত, বিষাদ এবং ভূতগ্রস্ত, বসে থাকি ব্রহ্মপুত্র ঘাটে, শেষ খেয়ার অপেক্ষায়...

----------------------মাহবুবুল হক শাকিল

শান্ত জলের কোমলতা আর গভীরতা নিয়ে কবি বিদায় নিয়েছে। জীবনকে সাহস আর সততার সাথে ভোগ করতে চেয়েছে। সবসময় মানুষের মাঝেই ছিল। কত বৈচিত্র্যময় সেসসব সম্পর্ক! কিন্তু আসলে কবি ছিল নিভৃতে নিজের মতো একাকী। ভালোবাসার সৈনিক নিজেকে প্রকাশ করেছেন সব প্রিয়জনের কাছে উচ্চকিত আড়ম্বর ছাড়াই। আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি বহুদিন তাদের মাঝে থাকবে শাকিল, যেন আকাশজুড়ে চাঁদের আলো রুপার জলে আঁকা

—সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

 

৫ লাখ টাকার প্যাকেটটা আমাকে দিলেন

২০০৯ সাল। পাবনা থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে ঢাকাতে এসেছি।

দেনার দায়ে আমার দুটো গাড়িই বিক্রি করেছি। আমার ২৮ হাজার টাকা বেতন- গীতিরও তেমনই। অনটনের ভরসা মাস শেষে ডিম। অনেক বিষণ্ন দুপুরে অর্থকষ্টে ভাত না খেয়ে কারওয়ান বাজারে ৫ টাকার শসা-গাজর খাই। তেমনই এক  বিকালে মাহবুবুল হক শাকিল ফোন দিলেন।

সামদাদোতে গেলাম। বিষণ্ন বসে আছি। বললেন, তোমার মন খারাপ কেন দাদা? বললাম, বাজেটে গাড়ির দাম বাড়লো। আর কেনা হবে না। আদৃতা জয়িতার স্কুলটা ভয় লাগে। কয়েক মিনিট নীরবতা। হেলাল ভাইকে ফোনে চাপা স্বরে কি যেন বললেন। হেলাল একটা প্যাকেট হাতে এলেন। শাকিল ভাই কোনো কথা না বলে প্যাকেটটা আমাকে দিলেন। ৫ লাখ টাকা। বললেন, শেয়ারের ব্যবসার লাভ আর পুঁজি—কাল অ্যাডভান্স দাও। আমার দুটো মেয়ে গাড়িতে স্কুলে যাবে।

আমি হতভম্ব—তিনি কড়া ধমক দিলেন। অঞ্জন যা বলছি কর। আমি সেখানে বসেই চট্টগ্রামে বাবর ভাইকে ফোন দিলাম। নীল ফিল্ডার এলো—গীতা চাকরি থেকে লোন করে গাড়ির বাঁকি টাকা কিস্তিতে শোধ করল। আমি আমাদের সেই অন্ধকারকালে ধার করে আর পাবনার এক টুকরো ছাদ বেচে টুকরো টুকরো করে শোধ দিলাম সেই ৫ লাখ। আজও ১২ হাজার শোধ হয়নি। বলতো- আমার কাছে ঋণী থাকো।

গত ৩ মাস আগে গাড়িটা বাসের ধাক্কা খেয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে। অর্থের টানাটানিতে তুলতে পারিনি। ভেবেছিলাম থাকুক। না হয় ওভাবেই বিক্রি করে দেব। কিন্তু আজ সিদ্ধান্ত নিলাম—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যেভাবে পারি, ধার দেনা করে হলেও, গাড়িটা সারানোর কাজ শেষ করব। যতদিন বাঁচব ও থাকবে আমার ভালোবাসার স্মৃতির গাড়ি হয়েই। সত্যিই ও তো গাড়ি না—ভালোবাসা। টাকার ঋণ শোধ হয় বোকা অঞ্জন রায়— ভালোবাসার ঋণ শোধ হবে না। অন্তত আমার এই একজীবনে না। লাভ ইউ মাহবুবুল হক শাকিল— আমাকে শাসনের শেষ মানুষ।

—অঞ্জন রায়, ডেপুটি হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, একুশে টেলিভিশন।

 

 

প্রস্থান নয় শাকিল...

স্মৃতিগুলো ছবির মতো চোখের সামনে ভাসছে। সেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, ঝকঝকে এক তরুণ। মিছিলের সাথি, মধুর ক্যান্টিনের প্রিয় মুখ। ডাকসুর ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন ভাই তখন ঢাকা  মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী হোস্টেলে আমার রুমে থাকতেন। ছাত্রলীগের শাকিল আর আনিস প্রায়ই সুলতান ভাইয়ের কাছে আসতেন। সুলতান ভাই শাকিলকে খুব পছন্দ করতেন, আমাদের সামনেই ওর খুব প্রশংসা করতেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নিবেদিত সৈনিক, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি খুবই বিশ্বস্ত ছিল আমাদের সময়ের মেধাবী সহযোদ্ধা শাকিল। ছাত্রজীবন থেকেই শিল্প-সাহিত্যানুরাগী ছিল, পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভরসার স্থল। শিল্প কিংবা মিডিয়া জগতের যে কারও বিপদে সবসময় পাশে থেকেছে শাকিল।

অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার পরে হঠাৎ হঠাৎ যোগাযোগ হতো। ওয়ান ইলেভেনের পরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন গ্রেফতার হলেন, তখন অজ্ঞাতস্থান থেকে একদিন শাকিল ই-মেইল করল। জানালো ভালো  নেই। আমরা তো পরস্পরের আত্মার স্বজন ছিলাম। আর এখন তাতে আঁচ ফেলবে সে সাধ্য কি আছে সামান্য মৃত্যুর? মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফেসবুকে জানতে চাইল, আমি ঢাকায় কিনা? একটা জরুরি বিষয় শুনে বলল, ‘দেখি কী করা যায়? তখনো কি ঘুণাক্ষরেও  ভেবেছি, এই আমাদের শেষ কথোপকথন!’ আমাদের হূদয়ে বসত করে যে মাহবুবুল হক শাকিল, তার তো মৃত্যু নাই। সাময়িক বিদায় শাকিল!

—ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

 

ভাইটি বড় অভিমানী

১৭ জানুয়ারি ২০১৬। গণভবন। দুপুর। গল্প করছিলাম রেহানা আপার সাথে। হঠাৎ শাকিল ভাই ঢুকলেন, কয়েকটা কাগজ রেখে চলে যাচ্ছিলেন। ছোট আপা পেছন থেকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন আমার সাথে পরিচয় আছে কিনা। শাকিল ভাই হ্যাঁ-না কিছু না বলে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে কেমন আছিস, কখন আসছিস?

শাকিল ভাই চলে যেতে না যেতেই রান্নাঘর থেকে অনেকটা দৌড়ে বেরিয়ে এলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকতার সুবাদে, দীর্ঘদিন পলিটিক্যাল বিট কাভার করার সুবাদে যিনি ঘরোয়া পরিবেশে আমাদের আপা। আর স্নেহ-মমতায় পরিপুষ্ট এই মানুষটি, যিনি নিজগুণে কাউকে কাউকে নিজের সন্তানের মতো কাছের করে নেন। শাকিল ভাই হয়তো সেই আশীবার্দপ্রাপ্তদের একজন। তাই রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে, বলতে বলতে এলেন। শাকিল চলে গেল, চলে গেল কেন, আমি ইলিশ পোলাও রাঁধলাম। তারপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অথবা একজন মা বা বড়বোন। ফোনে, তার সহকর্মী বা ভাই বা সন্তানতুল্য কাউকে নিজ হাতে রাঁধা ইলিশ পোলাও খাওয়ানোর জন্য আদরমাখা মিনতি করছেন...

সে এক অপূর্ব দৃশ্য, অদ্ভুত কনভার্সেশন। তিন হাত দূরে বসে আমি পুরো বিষয়ের সাক্ষী। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে একটু মনখারাপ সামলে নিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। রেহানা আপা আর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাহ ও একটু দূরে চলে গেছে, আসো তোমাদের দুজনের কপালেই আছে, গরম গরম খাও! তার আন্তরিকতা, সারল্য, ভালোবাসা আর স্বাভাবিক খুনসুটিতে মুগ্ধ আমি শাকিল ভাইকে ফোন করলাম, গণভবন থেকে বেরিয়েই। ২/১ লাইন বলতেই, শাকিলের কান্না! আহারে, আমার বস, আমার আপা, বঙ্গবন্ধুর কন্যা...

পরের দিন সকালে একগল্প ভাঙা রেকর্ডের মতো শোনাতে হলো অনেকবার। যতবার থেমেছি, দাঁড়ি দিয়েছি, শাকিল বলেছে... We are blessed...! তুমি ভালোবাসা পেয়েছ শাকিল ভাই, you are blessed! আমি তোমার আবদার রাখলাম, কিন্তু its too much.. is that a viable die able time? RIP          (ফেসবুক স্ট্যাটাসের চুম্বকাংশ)

—মুন্নী সাহা, বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর