বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

একাত্তরের বন্ধু মার্ক টালি

সাইফ ইমন

একাত্তরের বন্ধু মার্ক টালি

পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার খবর, আবার যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার খবর। পাশাপাশি টিক্কা খান আর ইয়াহিয়ার গদিতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর। কৌতূহল আর উৎকণ্ঠার, একাত্তরের সেই দিনগুলোতে বিবিসি রেডিওতে হাজির হতেন মার্ক টালি।  একাত্তরে বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাকে নিয়েই আজকের রকমারি—  

 

একাত্তরের বিবিসি বলতে তৎকালীন সবাই মার্ক টালিকেই জানত। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছিলেন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশার আলো। যুদ্ধ চলাকালীন হারিকেন বা কুপির মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে রেডিওর এরিয়াল তুলে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে মার্ক টালির কথা শোনার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকত পুরো দেশ। তিনি যখন কথা বলতেন পিনপতন নীরবতা সবদিকে। কী বলছেন তিনি! মুক্তিযোদ্ধারা নাকি একে একে নাজেহাল করে চলেছে পাকবাহিনীকে। তার কণ্ঠের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি বাঙালির বুকে। ১৯৭১-এ মার্ক টালির বয়স ছিল ৩৫ বছর। জীবনের ১০টি বছর বাঙালি পরিবেষ্টিত আঙিনায় কাটলেও পড়াশোনা করেন মার্লবরো ও ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। পাদ্রি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভর্তি হলেন লিঙ্কন থিওলজিক্যাল কলেজে, কিছু দূর এগোলেনও। তারপর বুঝতে পারলেন তার চাই গতিময় ও অনুসন্ধিত্সু জীবন। জীবনে চাই পদে পদে চ্যালেঞ্জ! তাই ১৯৬৪-তে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিবিসি রেডিওতে যোগ দেন মার্ক টালি। ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৫-তে চলে এলেন দিল্লিতে। তখন থেকেই শুরু হলো তার পূর্ব পাকিস্তান পর্যবেক্ষণ। 

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিবিসি টিমে যারা কাজ করতেন তাদের অগ্রনায়কের আসনে ছিলেন এই মার্ক টালি। প্রতি মুহূর্তে বাঙালিদের চাঙ্গা করতে তার কণ্ঠের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রতি মুহূর্তে নিয়ে আসতেন তাত্ক্ষণিক উত্তেজনা ভরপুর খবরাখবর।

তার দাবি, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর হামলা চালানোর আগে হিসাবে ভুল করেছিল। এ প্রসঙ্গে মার্ক টালি বলেন, একাত্তরে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশাল ভুল করেছিল।  আমি রাজশাহী গিয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম সব গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো দেশকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করেছিল।

পুরোদেশ যেন ভূতের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখছিলাম মানুষের সেই নিদারুণ কষ্ট।  দগদগে ক্ষতগুলো! বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু স্যার উইলিয়াম মার্ক টালিকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে বাংলাদেশের মানুষ।

 

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা

‘সত্যিই অবিশ্বাস্য! চমৎকার লাগছে! বাংলাদেশের মানুষ আমাকে এই বিরল সম্মানে ভূষিত করেছে। আমি আমার সাধ্যমতো শিশু বাংলাদেশকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এই সম্মাননা আমাকে আমার অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! এক কথায় বলতে গেলে অনেক উত্তেজনাকর মুহূর্ত ছিল সেই দিনগুলো।’ এভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অকৃতিম এই বন্ধু।  ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা’ নিতে ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় আসেন স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি। এ ছাড়াও তিনি আরও কিছু সম্মাননায় ভূষিত হন। মার্ক টালি ১৯৮৫ সালে ওবিই পদবিতে ভূষিত হন। এরপর ১৯৯২ সালে পদ্মশ্রী পদক লাভ করেন। ২০০২ সালে নতুন বছরের সম্মাননা স্বরূপ নাইট উপাধি লাভ করেন। ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ পদক লাভ করেন। ভারতে অবস্থান করে তিনি ১৯৮৫ সালে তার প্রথম গ্রন্থ ‘অমৃতসর : মিসেস গান্ধীজ লাস্ট ব্যাটেল’ প্রকাশ করেন। এতে তিনি তার সহকর্মী ও বিবিসি দিল্লির প্রতিনিধি সতীশ জ্যাকবকে নিয়ে এ গ্রন্থটি রচনা করেন।  এ ছাড়াও ১৯৯২ সালে টালির অন্যতম সেরা গ্রন্থ ‘নো ফুল স্টপস ইন ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়।  

 

বাঙালি মায়ের সন্তান

মার্ক টালির জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৫ অক্টোবর ধনাঢ্য ইংরেজ পরিবারে হলেও জন্মস্থান কিন্তু কলকাতায়। মার্ক টালির কেন এই বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির বাঁধন অনেকেই হয়তো জানেন না।  মার্ক টালির মা ছিলেন বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মেয়ে।

বাবা ব্রিটিশ রাজত্বে ব্যবসার সুবাদে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে পাট কিনতে আসতেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়িত্ব বেড়ে যায় তার মা বাঙালি বলে।

তার পিতা ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন শীর্ষস্থানীয় অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ছিলেন। শৈশবের প্রথম দশকে ভারতে অবস্থান করেন। কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে সামাজিকভাবে মেলামেশার সুযোগ পাননি তিনি।

ইংল্যান্ডের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

টাইফোর্ড স্কুলে পড়ার পর ভর্তি হন মার্লবোরো কলেজে। এরপর ট্রিনিটি হলে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বেশ কিছু দিন পড়াশোনা করেছেন তিনি।

এরপর তিনি ক্যামব্রিজের চার্চ অব ইংল্যান্ডে পাদ্রি হতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু লিঙ্কন থিওলজিক্যাল কলেজে দুই মেয়াদে পড়াশোনার পর এ চিন্তাধারা স্থগিত করেন। এখানে ভর্তি হয়ে খ্রিস্টান পাদ্রিদের আচরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন।

ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা বিবিসির নয়া দিল্লি ব্যুরোর সাবেক প্রধান। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে প্রধান পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এর আগে বিবিসিতে প্রায় ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন।  দিল্লি ব্যুরোর প্রধান পদে ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন মার্ক টালি।

এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। মার্ক টালি লন্ডনের ওরিয়েন্টাল ক্লাবের সদস্য।

সর্বশেষ খবর