শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব - ২৫

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব - ২৫

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমন পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। এই শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে।

সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান।

 এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। হেরেমের অভ্যন্তরীণ নানা দিক ছাপিয়ে রোডস অভিমুখে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সুলেমান। গল্পের এই পর্যায়ে এসেও চলছে যুদ্ধ প্রস্তুতি। অনেক পাঠকই

সব খণ্ড একত্রে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আগামী একুশে বইমেলায় পুরো উপন্যাসটি বাজারে আসবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতি শনিবারের এই বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ২৫তম পর্ব।

 

 [ পূর্ব প্রকাশের পর]

            যুদ্ধযাত্রার দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে অগ্রগতি খারাপ না। সব পরিকল্পনা মতোই এগোচ্ছে।

পরিকল্পনা ছিল প্রথমে শাবাতাস দুর্গ দখল করা। এরপর স্রেম এলাকা জয় করে বুদিনের দিকে রওনা করা। আর নৌবহর এসে পৌঁছালেই বেলগ্রেড শিকারে যাবে ওরা। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই শাবাতাস দুর্গ দখলে চলে এলো। অটোমান সৈন্যদের সামনে শাবাতাসের প্রতিরক্ষা বাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।

বিস্তীর্ণ মাঠে সুলতানের সেনাবাহিনী যখন শেষ বিকালের ক্লান্তি ভুলতে যাচ্ছিল তখনই মাতরাকচির চর এসে শিহরণ জাগানিয়া খবর দিল। সুলতানের শত্রু হাঙ্গেরির রাজা লুই এদিকেই অবস্থান করছেন। এখান থেকে বিশ বাইশ মাইল দূরে জেমুন দুর্গে অবস্থান করছেন লুই।  সেখানে একটি অনুষ্ঠানে রাতেই লুই-এর সম্মানে একটি জলসার আয়োজন করার কথা। মাতরাকচি এও নিশ্চিত করলেন যে, সেখানে ইতিমধ্যেই সুলতানের চর পৌঁছে গেছে। মিশে গেছে জেমুনের লোকজনের সঙ্গে।

এই খবর পেয়ে দ্রুত পরিকল্পনা পাল্টে ফেললেন সুলেমান। সিদ্ধান্ত হলো কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতের বেলায় আক্রমণ চালানো হবে জেমুন দুর্গে। সৈন্যরা সবাই আবার জেগে উঠল। সুলতানের গুপ্তচর বাহিনীর আনুকূল্য বেশ কাজে দিল। ওরা দারুণভাবে সাহায্য করল অটোমান বাহিনীকে। এবারও সহজেই দুর্গ দখল করে নিল সুলতান বাহিনী। কিন্তু গোপন পথে পালিয়ে গেলেন হাঙ্গেরির রাজা লুই।

‘শয়তানটাকে পেলে তলোয়ারের এক ঘায়ে শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলতাম।’

সুলতানের তলোয়ারের রক্ত তখনো তাজা। লুই-এর পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মানতে পারছেন না কিছুতেই।

‘হুজুর কামানের শব্দ পেয়ে আমরা পৌঁছার আগেই পালিয়েছে ব্যাটা।’

পারগালি ইব্রাহিম যোগ করলেন।

‘মাফ করবেন জাঁহাপনা। লুই একটা কাপুরুষ। তলোয়ারের সামনে না এসে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে। এখন ওর কথা ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। আমরা আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য যেন ভুলে না যাই।’

পীরে মেহমুদ পাশার কথায় যেন একটু স্বস্তি এলো সুলতানের মনে।

‘হুমম। ইব্রাহিম পীরে পাশা, মাতরাকচি আর অন্যদের নিয়ে সব রসদ আর অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নাও। লক্ষ্য এবার বেলগ্রেড।’

‘হুজুর এখানেও প্রচুর রসদ মিলেছে। আর অস্ত্রশস্ত্রের মজুদও ভালো। এখানকার সৈন্যদের একটা বড় অংশ আমাদের বশ্যতা মেনে যুদ্ধ করতে রাজি হয়েছে।’

‘কিন্তু তাদের দলে ভেড়ানো কি ঠিক হবে?’

সুলতানের সন্দেহ।

‘আমি সেনাপতি মুসাল্লিমকে বুঝিয়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত তার। তবে সে বলেছে, এদের দলে পেলে মন্দ হবে না। আর এই সৈন্যরা একসঙ্গে নয়, প্রতি পাঁচজন তুর্কি সেনার মাঝখানে একজন করে বন্দী সেনা থাকবে। শাবাতাসের শ-পাঁচেক যোদ্ধা কিন্তু একই পদ্ধতিতে এখানে আমাদের হয়ে লড়েছে।’

‘ঠিক আছে। প্রস্তুতি নাও। লক্ষ্য এবার বেলগ্রেড।

 

            সুলতানের অনুপস্থিতিতে একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে হেরেমে। হুররেম খাতুনের খাবারের সঙ্গে কে যেন বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। ইসাবেলার চিৎকারে গোটা হেরেম কেঁপে উঠেছে। প্রথমে কেউ তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। দানা হালিলের কাছে যখন শুনলেন হুররেম খাতুনের কথা, তখন চমকে উঠলেন কাশেম পাশা! দ্রুত হেকিম ডাকলেন। তখনই বিষের ব্যাপারটা জানা গেল। কয়েকবার আঙ্গুলি করে বমি করানো হলো হুররেমকে। হলদেটে চোখ দুটো যেন রক্তে লাল হয়ে গেছে হুররেমের। আগুনরঙা চুলগুলো উসকো খুসকো। কথা বলতে গেলে কাশি চলে আসছে। আরও কয়েকবার বমি করানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু আর বমি আসছে না। হালিমের নেসা দানা হালিলকে কী যেন আনতে বললেন। দানা হালিল ছুটলেন ওষুধের সন্ধানে। কাশেম পাশা তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।

‘হুজুর কিছু মনে না করলে আপনি এখন যেতে পারেন। আমি দেখছি। ঘটনা তেমন গুরুতর নয়।’

‘কী বলছো? হুররেমের কিছু হলে আমি সুলতানকে কী জবাব দেব? উনি তো আমার গর্দান কেটে নেবেন।’

হালিমের নেসার চোখে প্রশ্নাতুর অসহায় দৃষ্টি।

‘তাহলে বরং আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। একটু মেয়েলি কাজ। পরীক্ষা করব।’

‘উহ!’

একটু যেন বিব্রত হলেন কাশেম পাশা। দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুলতান চলে যাওয়ার পর তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। টুকটাক যা ঘটেছে সেটা তিনি নিজে আর আয়েশা হাফসা সুলতান মিলে ভালোই সামলে নিয়েছেন। আয়েশা হাফসার সঙ্গে তার বোঝাপড়াটা ভালো বলেই কাজটা সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু হুররেম বিষয়ে তিনি কিছুই শুনতে পারেন না। কাশেম পাশাও বুঝে গেছেন একে বেগম সুলতানা খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু কিছু করার নেই। এই বিষয়টি জেনেই হয়তো সুলতান তাকে আলাদা করে বলে গেছেন। আর সবকিছুর মতো এটাও তার পরম দায়িত্ব। দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে এসব ভাবছিলেন কাশেম পাশা। ততক্ষণে দানা হালিল ওষুধ হাতে ছুটে এসেছে। কাশেম পাশা ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বললেন।

‘পাশা!’

অনেকটা চিৎকার করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হেকিম হালিমের নেসা।

‘কী হয়েছে?’

কাশেম পাশার কণ্ঠে আতঙ্ক।

‘হুররেম সন্তানসম্ভবা।’

কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইলেন কাশেম পাশা।

‘সত্যি?’

‘শতভাগ।’

দানা হালিলের হাত থেকে ওষুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন হালিমের নেসা।

কাশেম পাশা বেগম সুলতানার কক্ষের দিকে হাঁটা দিলেন। যদিও এটা সুলতানার বিশ্রামের সময়, কিন্তু খবরটা অনেক বড়। তাকে জানাতেই হবে এবং সেটা এখনই। কাশেম পাশা ঠিক বুঝতে পারছেন না খবরটা আনন্দের নাকি চিন্তার। মাঝে মাঝে বেগম সুলতানাকে চেনা বড় দায় হয়ে ওঠে!

 

            অটোমানদের জয়রথ যেন থামতেই চাচ্ছে না। প্রথম অভিযানেই একের পর এক সাফল্যের দেখা পাচ্ছেন সুলতান সুলেমান খান। আশপাশের রাজ্যের রাজাদের কাছে আস্তে আস্তে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠছেন তিনি। বাদ পড়ল না বেলগ্রেডও। এত সহজে বেলগ্রেড অধিকারে চলে আসবে কল্পনা করেননি সুলতান নিজেও। তবে মনের ভিতর ওতপেতে থাকা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মতো দিগ্বিজয়ী বীর হয়ে ওঠার বাসনাটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নিজে নিজে দারুণ পুলক অনুভব করছেন সুলতান।

বেলগ্রেড প্রাসাদে অটোমানদের পতাকা উড়িয়ে নিজের স্বপ্নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলেন অটোমান অধিপতি। এখন সুদূর বেলগ্রেডও অটোমান শাসনের অন্তর্ভুক্ত হলো। তবে এখানে এসে সুলতান তার মহানুভবতার অনন্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করলেন। বেলগ্রেড অধিবাসীদের জন্য পরবর্তী এক বছর সব ধরনের কর মওকুফ করে দেওয়ার ঘোষণা করলেন। শুধু তাই নয়, রাজকোষ থেকে বিশ লাখ মুদ্রা বিতরণ করা হলো এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে। তিনি ঘোষণা দিলেন অটোমান শাসনের অধীনে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। হুকুম জারি হলো এখানকার রাস্তাঘাটসহ সব ধরনের অবকাঠামো বিনির্মাণের। চারদিকে মসজিদ মক্তব নির্মাণেরও উদ্যোগ নিলেন। এত দিন পর্যন্ত বেলগ্রেড ছিল হাঙ্গেরির রাজা লুই-এর শাসনাধীন। বলাবাহুল্য, লুই ছিলেন আপাদমস্তক স্বার্থপর এবং অত্যাচারী একজন শাসক। সেই তুলনায় সুলতান সুলেমান খান যেন বেলগ্রেডবাসীর কাছে আশীর্বাদরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। অটোমান পতাকাতলে এসে বেলগ্রেডের লোকজন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। চারদিকে সুলেমানের জয়ধ্বনি উঠল। সেই জয়ধ্বনি গিয়ে পৌঁছাল সম্রাট লুই-এর কানেও। কিন্তু লুই তখনো আত্মগরিমায় উচ্ছন্ন। এখনো তার দম্ভোক্তি তলোয়ারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করবেন সুলেমানের দেহ। অটোমানদের বিতারিত করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন তার রাজ্য। কিন্তু চতুর সুলেমান এর মধ্যেই বেলগ্রেডবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছেন। বেলগ্রেডের বাতাসে এখন সুলেমানের জন্য ভালোবাসা আর লুই-এর জন্য ভাসছে অবারিত ঘৃণা।

 

            হুররেমের মা হওয়ার খবরে অনেকটা অবাক হয়েছেন আয়েশা হাফসা সুলতান। সাদা পর্দার ফাঁক গলিয়ে স্পষ্ট সেটা টের পেয়েছেন কাশেম পাশা। অন্দরের নারী হওয়ার কারণে কাশেম পাশার সামনে বেপর্দা অবস্থায় কখনই দেখা দেন না আয়েশা। অবাক হলেও মুহূর্তের মধ্যে সেটা কাটিয়ে নিয়ে জানতে চাইলেন ঘটনা নিশ্চিত কিনা। কাশেম পাশা বেগম সুলতানাকে নিশ্চিত করলেন। এবার পাল্টে গেল বেগম সুলতানার চেহারা। আনন্দিত দেখাল তাকে। আনন্দে যেন চিকচিক করে উঠলেন তিনি। সে আনন্দ কৃত্রিম নাকি অকৃত্রিম বোঝা যাচ্ছে না। মিষ্টি বিতরণের নির্দেশ এলো। সব দিকে এলান পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এলো। নতুন শাহজাদা আসছে! হেরেমে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে। হুররেম খাতুনের জন্য নতুন কামরার বন্দোবস্ত হলো। আর তাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন হেরেম নন্দিনী। কাশেম পাশাকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলো। সুলেমানকেও খবর পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে বিষ খাওয়ানোর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন কাশেম পাশা। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো কথা বললেন না বেগম সুলতানা। বরং থামিয়ে দিলেন কাশেম পাশাকে। বললেন, ওটা তিনি নিজেই দেখবেন। কাশেম পাশা আর কথা বাড়ালেন না। হাতে অনেক কাজ। দ্রুত খবর চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।  হেরেমের ভিতরেও অনেক কিছু করার আছে। মনজিলাকে পেয়েই খানিকটা বুঝিয়ে দিলেন পাশা। এবার অন্যদিকে মন দেওয়া যাবে।

------------[চলবে]

সর্বশেষ খবর