বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জেল পালাতে কত কাহিনী

সাইফ ইমন

জেল পালাতে কত কাহিনী

অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই জেলখানার উত্পত্তি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই কয়েদিদের আটকে রাখার জন্য জেলখানা ব্যবহৃত হতো। কত রকমের কয়েদির বসবাস এই অন্ধকার চার দেয়ালের ভিতরে। অনেকের রয়েছে অসংখ্য হত্যা আর জঘন্য সব অপরাধের অভিজ্ঞতা। অনেক কয়েদি আবার জেলের ভিতরেই সৃষ্টি করেছিল রক্তাক্ত দাঙ্গা। এত সব সত্ত্বেও আইন মেনে কয়েদিদের জেলখানায় আটকে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে যতদিন জেলখানা আছে তত দিনই ঘটবে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। আর এজন্য কয়েদিদের তীক্ষ বুদ্ধি আর জন্ম হয় একের পর এক ঘটনা।

 

গ্লাইডারে চড়ে পালানো

জার্মানির জিকাও মুল্ড নদীর তীরে অবস্থিত এক শহরের নাম কোল্ডিত্জ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ শহরেরই কোল্ডিত্জ দুর্গে যুদ্ধবন্দী অফিসারদের রাখা হতো।  বেশ উঁচু এক পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে ছিল ক্যাম্পটির অবস্থান। আর এখান থেকেই গ্লাইডারে চড়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন দুই ব্রিটিশ পাইলট জ্যাক বেস্ট ও বিল গোল্ডফিঞ্চ। গ্লাইডারের বিভিন্ন অংশগুলো তারা জোড়া লাগিয়েছিলেন ক্যাম্পেরই চ্যাপেলের চিলেকুঠুরিতে। গ্লাইডারের ডানা বানানো হয়েছিল মেঝে তৈরিতে ব্যবহৃত বোর্ডগুলোর সাহায্যে। তবে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই হোক না কেন, বেস্ট এবং গোল্ডফিঞ্চ তাদের গ্লাইডারে চড়ে কোল্ডিত্জ দুর্গ থেকে পালাতে পারেননি। কারণ তাদের কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই মিত্রবাহিনী দুর্গের দখল নিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

 

ডিলিঞ্জারের কাঠের পিস্তল

জন ডিলিঞ্জার আমেরিকার ইতিহাসের কুখ্যাত সন্ত্রাসী। তিনি ছিলেন ডিলিঞ্জার গ্যাঙের সদস্য যেটি ২৪টি ব্যাংক ডাকাতি, চারটি পুলিশ স্টেশনে হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য পরিচিত। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে অ্যারিজোনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তার স্থান হয় ইন্ডিয়ানার লেক কাউন্টি জেলে। সামান্য কাঠ কেটে তিনি বানিয়েছিলেন এক খেলনা পিস্তল। তারপর সেটিকে আরও আসলের মতো দেখাতে ব্যবহার করেন জুতার কালি। সেই খেলনা পিস্তল দিয়ে প্রহরীদের ভয় দেখিয়েই পালিয়ে যান জন ডিলিঞ্জার। আর পালানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন শেরিফের নতুন কেনা একটি ফোর্ড গাড়ি। অবশ্য পালিয়ে খুব সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

ওই বছরেরই ২২ জুলাই পুলিশের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

 

আলকাত্রাজ থেকে পালানো

যুক্তরাষ্ট্রের আলকাত্রাজ দ্বীপে অবস্থিত আলকাত্রাজ জেলখানা থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল তিন অপরাধী—ফ্রাঙ্ক মরিস, জন অ্যাংলিন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন। ১৯৬২ সালের ১১ জুন, সাবান আর টয়লেট টিস্যু দিয়ে তারা প্রথমে তৈরি করেন মানুষের মাথা। এরপর মাথায় আসল চুল লাগিয়ে সেই কৃত্রিম মাথাগুলোকে কাঁথা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিলেন যাতে রাতের বেলায় প্রহরীরা ধোঁকা খায়। এর এক বছর আগে থেকেই তারা তাদের জেলখানার দেয়ালে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে গর্ত খুঁড়ছিলেন। যা গিয়ে শেষ হয় এক অব্যবহৃত সার্ভিস করিডোরে। সেই সার্ভিস করিডোর থেকে ভেন্টিলেশন শ্যাফট দিয়ে তিনি অপরাধী পালাতে সক্ষম হয়। এরপর রাত ১০টার দিকে তারা আলকাত্রাজ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

 

আলফ্রেড ওয়েটজলার

জেল পালানো আলফ্রেড ওয়েটজলার এবং তার সঙ্গে পালানো রুডলফ ভ্রবা বিখ্যাত হয়ে আছে এল ক্যাম্পের সর্বপ্রথম বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার জন্য। ভ্রবা-ওয়েটজলার দেওয়া তথ্য ফাইলটি মোট ৩২ পৃষ্ঠার। এই থেকেই জানা যায় ডেথ ক্যাম্পের গ্রাউন্ড প্ল্যান, গ্যাস চেম্বারের কন্সট্রাকশন প্ল্যান, মানবদেহ পোড়ানোর চুল্লির ভয়াবহ সব বর্ণনা। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী নািস বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়, রক্ষা পায় ১ লাখ ২০ হাজার হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি।

ঘটনা ঘটে ১৯৪৪ সালের ৭ এপ্রিল। আনুমানিক দুপুর দুইটার দিকে ওয়েটজলার এবং ভ্রবা পালিয়ে এক কাঠের স্তূপের আড়ালে আশ্রয় নেন। এসময় ক্যাম্পের অন্য বন্দীরা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটির চারদিকে কাঠের বোর্ড জমা করে রেখেছিলেন যাতে তারা ধরা না পড়েন। সেই জায়গাটিতে তারা তামাক পাতা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিলেন যাতে কুকুরেরা গন্ধ শুঁকেও তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে না পেতে পারে, সেজন্যই পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে সেখানে ৪টি রাত কাটিয়ে দেন পলাতক দুই বন্দী। ১০ এপ্রিল ডাচ স্যুট, ওভারকোট ও বুট গায়ে জড়িয়ে দুজন ১৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন। তাদের কাছে দিক-নির্দেশক বলতে কেবল ছিল বাচ্চাদের মানচিত্রের বইয়ের একটি পৃষ্ঠা।

 

হেলিকপ্টারে পালায় পায়েট

জেল পালানো কয়েদি নিয়ে কথা হচ্ছে আর পেসকেল পায়েটের নাম আসবে না, তা কি হয়? এই পেসকেল শুধু একবারই পালায়নি সে দুই দুইবার ফ্রাসের অত্যাধুনিক কারাগার থেকে পালিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয় এবং অদ্ভুত ব্যাপার প্রতিবারই সে হেলিকপ্টার নিয়ে পালায়। পেসকেল হত্যা মামলায় ৩০ বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়। 

পেসকেল প্রথমবার পালায় ২০০১ সালে। কিন্তু প্রথমবার তেমন সুবিধা করতে পারেননি। শিগগিরই ধরা পড়ে যায় পেসকেল। এরপর তার কারাদণ্ড আরও সাত বছর বৃদ্ধি করে আদালত। চেন্নাস-মান্দেডেলিও এয়ারপোর্ট থেকে চার মুখোশধারী একটি হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করে। এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করেই পেসকেল পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পেসকেল আবারও ধরা পড়ে ২০০৭ সালে।

এখনো পর্যন্ত পেসকেল পায়েটকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

 

ধোঁয়াশার ৩৪ বছর

১৯৭৫ সালে ২২ বছর বয়সী নারী ক্যারোলকে চুরির দায়ে ৫ বছরের জন্যে ফ্লোরিডার ওকালার কারাগারে পাঠানো হয়। এর ৪৭ দিনের মাথায় জেল থেকে পালিয়ে যায় ক্যারোল।

তবে তার পালানোর ব্যাপারটি পুরোটাই ধোঁয়াশা তৈরি করে সবার কাছে। কারণ প্রহরীর ভাষ্যমতে, ক্যারোলার পালানোর এক ঘণ্টা আগেও তাকে তার জায়গাতেই ঘুমাতে দেখা গেছে বলে জানায় সে। জেল থেকে পালিয়েই নিজের নাম পাল্টিয়ে শ্যারন অ্যাডওয়ার্ডস রাখে ক্যারোল। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার শ্যারন নামের এক নারীর নিরাপত্তা কার্ডের নম্বরও ব্যবহার করা শুরু করে। এরপর কেটে যায় ৩৪ বছর! ২০১০ সালে পুলিশের কাছে আবার ধরা পড়ে ক্যারোল। যদিও তখন তার দাবি, সে আর আগের ক্যারোল নেই। কিন্তু পুলিশ তাকে এত সহজে ছাড়েনি। জেলে ঢুকতে হয় আবার তাকে। আর সেখানেই ১১ মাস কাটিয়ে ২০১১ সালে বাইরে বের হয় ক্যারোল।

 

অপ্রতিরোধ্য ডোনাল্ড জনসন

দীর্ঘ একুশ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের চোখে ধুলো দেন ডোনাল্ড জনসন। এর আগে ডাকাতির দায়ে ১৯৬৬ সালে ১৫ বছরের সাজা হয়েছিল ডোনাল্ডের। ক্যালিফোর্নিয়ার জেমসটাউনে পাঠানো হয় তাকে। তবে ছয় মাস যেতে না যেতেই ডোনাল্ড নানা ফন্দি-ফিকির শুরু করে জেল থেকে পালানোর। একসময় সফল হয় ডোনাল্ড। জেল থেকে পালিয়ে যায়। এরপর তিন মাস কেটে যায়। ১৯৬৯ সালে আবার ফ্লোরিডায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেখানে ৫ বছরের সাজা হয় তার। কথা ছিল সেখান থেকে বেরোলেই ক্যালিফোর্নিয়ার জেলে ফেরত যেতে হবে তাকে। কিন্তু সেটা আর হয়নি। মাত্র সাড়ে তিন মাস জেলে কাটিয়েই বেরিয়ে আসে জনসন আর ফ্লোরিডা থেকে চলে যায় সোজা আরকানসাসে। সেখানে বিয়ে করে নিজের আসল পরিচয় ব্যবহার করেই টেক্সাসের টমবলে পাড়ি জমায় ডোনাল্ড। পরিবারকে কিছু না জানিয়েই নিজের জীবন শুরু করে সে। একটি রাসায়নিক সংস্থায় যোগ দেয় এবং পরবর্তী ২১ বছর বেশ ভালোভাবেই কাটে তার। তবে ২০০৪ সালে আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। অতিরিক্ত সাজাসহ পূর্বের সাজা ভোগের জন্যে ক্যালিফোর্নিয়ার জেলে পাঠানো হয় তাকে।

 

সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালানো কয়েদিরা

দ্য গ্রেট এস্কেপ ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত একটি ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় ‘স্টালাগ লাফট-৩’ ছিল জার্মানদের বানানো আরেকটি যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্প যেখানে বিমান বাহিনীর লোকদের বন্দী হিসেবে রাখা হতো। এখানকার বন্দীদের মাঝেই একজন ছিলেন অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার রজার জয়েস বুশেল। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে বুশেল এখান থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালানোর পরিকল্পনা করলেন, তবে একটি নয়, তিনটি; একা নয়, সবাইকে নিয়ে। এগুলোর সাংকেতিক নাম ছিল টম, ডিক ও হ্যারি। সুড়ঙ্গগুলো তৈরিতে প্রায় ১৩০ টন মাটি সরানোর কাজ করা হয়েছিল! সুড়ঙ্গপথে এক এক করে পালায় ৭৬ জন। ৭৭তম বন্দী সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়া মাত্রই ধরা পড়ে যান এক প্রহরীর নজরে। এরপর ৭৬ জনের মধ্যে ৭৩ জনই ধরা পড়েছিলেন।

 

পালিয়ে কুখ্যাত

দ্য টেক্সাস সেভেন হলো এক দল জেলবন্দী যারা টেক্সাসে জন কোনালি ইউনিট থেকে পালিয়ে যায়। ঘটনাটি ২০০০ সালের ১৩ ডিসেম্বরের। এর ঠিক এক মাসের মাথায় ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি দ্য টেক্সাস সেভেন দলটি আবার ধরা পড়ে একটি টেলিভিশন প্রোগ্রামের কল্যাণে। আমেরিকাস মোস্ট ওয়ান্টেড নামের অনুষ্ঠানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। এই সাত কয়েদি পালানোর জন্য অত্যন্ত সুচারু পরিকল্পনা করে দক্ষিণ টেক্সাস টাউনের স্টেট সিকিউরিটি কারাগার ‘জন কোনালি ইউনিট’ থেকে পালিয়ে যাবার। পালানোর সময় তারা চারজন বেসামরিক রক্ষণাবেক্ষণ সুপারভাইজার, চারজন শাস্তিবিষয়ক কর্মকর্তাকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করতে সক্ষম হয়। দ্য টেক্সাস সেভেন দলটি কারাগার থেকে পালানোর জন্য কারাগারেরই একটি পিকআপ ব্যবহার করে।

 

জিম্মি করে পালায় তারা

ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত জেল থেকে পালানোর ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। এদিন জেল থেকে ৩৮ জন বন্দী পালাতে সক্ষম হয়। এদের সবাই ছিল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি। যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল। এ ঘটনার আকস্মিকতায় তত্ক্ষণাৎ এক জেল কর্মকর্তা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, আরও বিশজন আহত হয়। অথচ এই এইচ এম মেইজ জেলখানাটি গোটা ইউরোপে সবচেয়ে সুরক্ষিত জেলখানা হিসেবে পরিচিত ছিল। জেলখানাটির চারপাশ জুড়ে ছিল ১৮ ফুট উচ্চতার কনক্রিটের দেয়াল এবং এর প্রতিটি স্টিলের তৈরি গেট সম্পূর্ণ উপায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো। পালানোর আগে বন্দীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জেলখানাটির একটি ব্লক দখলে নিয়ে নেয়। তারপর খাদ্য বহনকারী গাড়িটি পালানোর কাজে ব্যবহার করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর