রবিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্বকাঁপানো অফিসগুলোর অন্দরমহল

তানভীর আহমেদ ও তানিয়া জামান

বিশ্বকাঁপানো অফিসগুলোর অন্দরমহল

বিলাসবহুল হোটেল রুম কিংবা প্রাসাদতুল্য বাড়ির ড্রয়িং রুমে আয়েশ, আড্ডা নয়। বুদাপেস্টের গুগল অফিসে কর্মীদের কর্মব্যস্ততার প্রতিদিনের দৃশ্য এটি

কাজের তাগিদে শহরে ছুটছে মানুষ। বড় বড় ইট-পাথর আর কাচের দালানের গুমোট পরিবেশকে বিদায় দিয়েছে বিশ্বসেরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রথম সারির প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বেছে নিয়েছে খোলামেলা পরিবেশ। অফিস বলতেই যে চার দেয়ালে বন্দী-গুমোট পরিবেশ সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে গুগল, ফেসবুক, দেশে দেশে ডাটা সেন্টার, গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অফিসকর্মীদের কাজের একঘেয়েমি কাটাতে এই অফিসগুলোতে রয়েছে বিলাসবহুল ব্যবস্থা। অফিসেই মিলছে বিনামূল্যে খাবার, রয়েছে ঘুমানোর সুবিধা। বিনোদন পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে অফিসের ভিতরেই। কাজের ফাঁকে আড্ডা দিতে, গান শুনতেও রয়েছে নিরিবিলি বসার জায়গা। যে অফিসগুলোতেই বিনোদনের এত ব্যবস্থা— সেসব নিয়ে আজকের রকমারি।

 

অফিস যেন বিনোদন পার্ক

অফিসে ঘুমানোর সুযোগ খুঁজছেন? তাহলে গুগল হতে পারে আপনার আদর্শ কর্মস্থল। এখানে কর্মীরা চাইলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারেন আয়েশে। ঘুমানোর যে আয়োজন গুগল অফিসে রয়েছে অনেক ভালো মানের হোটেলেও সে বিলাসী আয়োজন নেই। আর এতো সব আয়োজনের সমাহার ঘটিয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রিয় গুগল। গুগল অফিসটি পুরোটাই ফান ফ্রেশ কোম্পানি বলা যায়। এখানে যেমন বেশি বেতনের সুযোগ আছে তেমনি অফিসের জন্যও আছে উদার কর্মচারী। গুগল ইনকরপোরেশনের প্রধান কার্যালয় গুগলপ্লেক্সটি অবস্থিত ৪৭ হাজার ৩৮ স্কয়ার মিটার জুড়ে। ২৬ একর জমির ওপর অবস্থিত অফিসের প্রধান অংশ ও ক্যাম্পাস। অফিসটির আশপাশ জুড়ে বিস্তৃত জায়গায় রয়েছে অসংখ্য গাছ-পালা। তা ছাড়া ২টি সুইমিংপুল ১টি বাস্কেটবল খেলার জন্য কোর্ট। মূলত গুগল অফিস সজ্জায় বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক থিমের সমম্বয় সাধন করা হয়েছে। অফিস লবিটিও গাছ. লতা-পাতায় মোড়ানো। কর্মীদের কাজের স্থান যেভাবে সাজানো তাতে মনে হবে কেউ খোলা স্থানে, কেউ গাছের নিচে, কেউ লাইটিং কারুকারে কাজ করছেন। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য প্রত্যেকের আলাদা এরিয়া নির্ধারিত। এখানে কাজের ফাঁকে বিনোদনের জন্য রয়েছে হোম থিয়েটার। গুগলের কর্মচারীদের অবসরটা আয়েশি কাটাতে রয়েছে কফিসপ। এ ছাড়াও রয়েছে বিনামূল্যে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনারের সুব্যবস্থা। কাজের সুবিধার জন্য ১ জন কর্মচারীর হাতে ৫-৬টি কম্পিউটারও থাকে। তা ছাড়া এই গুগলপ্লেক্স এরিয়াতে থাকা ২টি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে মাঝে মাঝেই নেমে পড়েন আইটি বসরা।

 

বিলাসী আয়োজনে চমকে দেয় ফেসবুক

বিলাসী আয়োজনে চমকে দেবে ফেসবুক। ফেসবুক অফিসে ঢুকলেই চোখে পড়বে রিসিপশনে নানা খাবার ও পানীয়র বাহার। এর সবই ফ্রি, চাইলে একটি স্যান্ডউইচ ও এক মগ কফি নিয়ে যে কোনো ফেসবুক কর্মী বসতে পারেন নিজের ডেস্কে। মার্ক জাকারবার্গ ও ডাস্টিন মস্কোভিেসর উদ্যোগে গড়া বিশ্ব-সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ফেসবুক যেমন সবার পছন্দের, অফিস আয়োজনের এসব উপকরণও পছন্দ কর্মীদের। ৭৫০ মিলিয়ন অ্যাকটিভ আইডির বিশাল এই কমিউনিটির অফিসটি না জানি কেমন? ফেসবুক তাদের অফিসের ডিজাইন করেছেন আর দশটি করপোরেট অফিস থেকে ভিন্ন। মূলত সব কাজেই তারা ব্যবহার করেছেন নিজস্ব সফটওয়ার। প্রত্যেকেই বিশাল স্পেসে কাজের সুযোগ পান। অফিসটিতে বিশ্রাম,  স্কেটিং প্লেস এমনকি ডিজে পর্যন্ত করার সুযোগ আছে। এক কথায় ফেসবুক এমন একটি কর্মস্থল যেখানে কাজ করা এবং খেলাধুলার অপার সুযোগ রয়েছে।

 

রেড বুল অফিসে সময় কাটে নিমিষে

অফিস যদি কর্মীদের জন্য এনার্জি ড্রিংস বা বারের ব্যবস্থা করে তবে কেমন হয়? এমন অফিসে কাজের ফাঁকে দোলনায় দোল খাওয়াটাও হয়তো বিস্ময়কর কিছু হবে না। কথাটি উদ্ভট মনে হলেও লন্ডনের রেড বুল অফিসে কর্মীরা মন চাইলে পান দোলনা চড়ার অপূর্ব সুযোগ। অফিসের ভবনটি নির্মিত একদমই আলাদা বৈশিষ্ট্যে। ভবনটি রূপান্তর করা হয়েছে পাঁচটি প্রাচীন আইসক্রিমের আদলে। অথচ একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ভবনগুলোর মেঝের উচ্চতাও সমান নয়। ভিন্নতা নিয়ে এটি দিনে দিনে অপরের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বিচিত্র অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো দোলনায় চড়ার সুযোগ। রাতে বারের ব্যবস্থাও আছে। রেড বুল অফিসটি তরুণ লন্ডনীদের জন্য বেশি পছন্দের জায়গা। তাদের বেশির ভাগই লুফে নিচ্ছেন রেড বুলের চাকরি।

 

অ্যাপলের বিলাসবহুল বিশ্রামাগার

সৃজনশীল কাজের জন্য দরকার মানসিক প্রশান্তি। আর সে সুযোগ দিতে একটু কার্পণ্য করেনি অ্যাপল। কাজের ফাঁকে মনোরম পরিবেশে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে পারে অ্যাপল কর্মীরা। প্রতিটি কর্মীর জন্য রয়েছে খাবার দাবার ও কাজের জন্য বিশাল স্পেসের ব্যবস্থা। অ্যাপল ইনকর্পোরেটেডের সদর দফতর ক্যালির্ফোনিয়ার মধ্য সিলিকন ভ্যালিতে। ১৯৯৩ সালে ৮৫ হাজার বর্গফুট জায়গাতে ৬টি বিল্ডিংয়ে অ্যাপলের বর্তমান সদর দফতর নির্মাণ করা হয়। সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে অ্যাপল তাই অনেকটাই এগিয়ে। অ্যাপল ক্যাম্পাস-২ এর মূল ভবনটির আয়তন ২৮ লাখ বর্গফুট। এটি হবে চার তলাবিশিষ্ট এবং মাটির নিচেও তিনটি তলা থাকবে। বড় বাঁকানো কাচের প্যানেল দিয়ে তৈরি অ্যাপলের ভবনটি দেখতে অনেকটা  উড়ন্ত চাকতির মতো। ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুটের ভূগর্ভস্থ মিলনায়তন থাকবে।

 

অফিসেই সব বিনোদন সুবিধা

বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্টের ব্রাজিলের অফিসে যত বিনোদন সুবিধা আছে বহু নামি-দামি শপিংমলেও বুঝি তত সুবিধা নেই। ব্রাজিলের উৎসবনগরী সাও পাওলো মানেই রঙের মেলা। ওয়ালমার্টের এই অফিসটিতেও তাই রঙের ছড়াছড়ি। অফিসের কর্মযজ্ঞের বাইরে কর্মীদের বিনোদন দিতে এখানে রয়েছে আধুনিক সব আয়োজন। অনেকেই এই অফিসের ছাদের কথা বলেন। এখানকার কর্মীরা সুযোগ পেলে ছুটে যান ছাদে। সেখান থেকে পুরো শহর দেখতে দেখতে চুমুক বসাতে পারবেন বিনামূল্যের কোল্ড ড্রিংকসে। এ ছাড়া অফিসের বাইরে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ মাঠ। সবুজ এই পার্কটিতে দোলনা থেকে শুরু করে সুইমিংপুল সবই রয়েছে। চাইলে অফিসের বিশ্রামাগারে বসে গান শুনতে পারেন কর্মীরা। আড্ডা দিতে পারেন রেস্টুরেন্টের পছন্দের খাবার খেতে খেতে। অফিসের কর্মঘণ্টাতেই বিনামূল্যে মিলবে সব।

 

বিএমডব্লিউ সেন্ট্রাল বিল্ডিং

বিখ্যাত আর্কিটেক্ট জাহা হাদিদের নকশায় তৈরি করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বিএমডব্লিউর কেন্দ্রীয় দালান। এর ভিতরের নান্দনিক কাঠামো যে কাউকে বিস্মিত করবে। জার্মানির লেপজিগে অবস্থিত এই অফিসটির ভিতরে রয়েছে আধুনিক সব বিনোদন সুবিধা। প্রথম যাত্রায় কেউ এটিকে অফিস বিল্ডিং না বলে বিনোদন কেন্দ্র ভেবে বসলে ভুল হবে না। সুউচ্চ ছাদের পুরো দালানটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিএমডব্লিউর তৈরি করা দুর্দান্ত মডেলের সব গাড়ি। এটি বিএমডব্লিউর গাড়ির মিউজিয়াম বলেও জানা অনেকের। তিনটি ভাগে ভাগ করা দালানটিতে নীল, সাদা ও সবুজ আলোতে পূর্ণ ভিতরে অফিস কক্ষগুলো ছাড়াও রাখা হয়েছে বিস্তৃত হাঁটা পথ। ৫ হাজার পাঁচশ কর্মী কাজ করে এখানে। তাদের জন্য রয়েছে সুবিশাল পার্ক ও আধুনিক রেস্টুরেন্ট সুবিধা।

 

পার্ক ভেবে ভুল বুঝবেন না

প্রথম দেখাতে মনে হবে কোনো অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমার সেটে এসে পৌঁছেছেন। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা হবে জেমস বন্ড সিনেমার কুখ্যাত ভিলেনের সঙ্গে। মোটেই তা নয়। সুইডেনের অন্যতম প্রধান ডাটা সেন্টারের অফিস এটি। মাটির নিচে অবস্থিত অফিসটিতে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি জার্মান সাবমেরিনের ইঞ্জিন থেকে। এই বাতিগুলোও দিনের আলো, গহিন অরণ্যের আবছা আলোর পরিবেশ ফুটিয়ে তুলেছে। পুরো অফিসে এত বেশি খোলা জায়গা রাখা হয়েছে দেখে মনে হবে— এখানে আদৌ অফিস নেই বরং সবুজ গাছপালা ঘেরা কোনো বনে বেড়াতে এসেছেন। এ ছাড়া কর্মীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে বিলাসী রেস্টুরেন্ট ও শোবার জায়গা।

 

অফিস যেন আড্ডাখানা

অফিসকে নিজের ঘর ভাবুন— এটাই হটসুইট অফিস নির্মাণশৈলীর প্রেরণা। মূলত টেকনোলজি উন্নয়নে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানের অফিসটি রয়েছে কানাডার ভেনকুভারে। রংবেরঙের ম্যুরাল দিয়ে সাজানো অফিসটিতে রয়েছে বিশ্রামের জন্য কেবিন সুবিধা। গান শোনার জন্য পাওয়া যাবে নিরিবিলি পরিবেশ। এ ছাড়া চাইলে কর্মীরা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবে পোষা কুকুর, বিড়াল। কর্মীদের একটি দল হিসেবে কাজ শেষ করার কথা মনে করিয়ে দিতে পুরো অফিস কক্ষটি করা হয়েছে একটি ছাদের নিচে, এখানে আলাদা দেয়াল তুলে কারও জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়নি। শরীর সচেতনদের জন্য অফিসের ভিতরেই ব্যায়াম করার সুবিধাও রয়েছে এখানে।

 

অফিস তো নয় বই প্রেমীদের স্বর্গ

থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় অফিস বিল্ডিং ডিটিএসি হেডকোয়ার্টার। টেলিনরের এই অফিসটি একটি বিশাল ডাটা সেন্টার হিসেবেও পরিচিত। নান্দনিক ও বিলাসী নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি অফিসের ভিতরে কর্মীদের জন্য নানা সুবিধা যোগ করার কারণে এটি বেশ আলোচিত। বিশাল অফিস দালানের সুউচ্চ বারান্দা রাখা হয়েছে কর্মীরা যেন কাজের চাপে থমকে না যান, চাইলেই এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে সতেজ বাতাস টানতে পারবেন। এ ছাড়া সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য, ব্যায়াম করার জন্য এই বারান্দায় অতুলনীয়। ৪ হাজার তিনশরও বেশি কর্মী এখানে কাজ করেন। তাদের জন্য ব্যায়ামাগার, বিশ্রামাগার, আধুনিক ক্যান্টিন ও বই পড়ার সুবিধাও রয়েছে।

 

সত্যিকারের লেগো অফিস

এ তো ডিজনি থেকেও কম নয়! প্রথম দেখায় এমনটি ভেবে বসলে ভুল হবে না। অনেকেই লেগোর ডেনমার্কের অফিসটিকে ডেকে থাকেন লেগোল্যান্ড বলেই। পুরো অফিস সাজানো হয়েছে লাল, নীল, হলুদ  লেগো দিয়ে। অতিকায় পুতুলের অবয়ব ছাড়াও ইন্টেরিওয়ের বড় অংশেই লেগো জুড়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্দান্ত সব নকশাওয়ালা কাজ। এখানে প্রায় ৪ হাজার কর্মী কাজ করেন। ভিতরেই রয়েছে দুটি সুবিশাল অডিটোরিয়াম। একাধিক তলার পুরো অফিসের মধ্যভাগ খোলা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বিশাল পার্ক। পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতেই এই সবুজ ঘাসের মেলা। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন আর খোলা আকাশে মেঘের ছোটাছুটি সবই মিলবে কর্মীদের কাজের একঘেয়েমী কাটাতে।

সর্বশেষ খবর