বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

২০১৭ সালের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য

সাইফ ইমন

২০১৭ সালের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য

২০১৭ শুরু হয়ে গেছে। প্রতি বছরের মতো নতুনের ধারাবাহিকতায় অনেক কিছুই যুক্ত হতে যাচ্ছে এ বছর। প্রযুক্তি, অর্থনীতি, শিল্পকলা ইত্যাদি নানা মেটারিয়াল এবং ইমমেটারিয়াল অনেক কিছুই আছে এ তালিকায়। বিশ্বজুড়ে নামকরা সব কনস্ট্রাকশন হাউসগুলোর বেশ কিছু অসাপ্ত কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে। যেগুলো উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এ বছরই। নিজ নিজ স্থাপত্যশিল্পের চমৎকার সব উদাহরণ নিয়ে চমক দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব স্থাপত্যশিল্পে ব্যবহার হচ্ছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। স্থাপনার বিশেষত্বেও রয়েছে বৈচিত্র্য। এসব স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে বিনোদন পার্ক, বিলাসবহুল কমিউনিটি সেন্টার, অরণ্যের মাঝে সর্বাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, সর্পিল রেল স্টেশন, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মাটির নিচে জাদুঘরসহ আরও অনেক কিছু। এসব নিয়ে আজকের রকমারি—

 

নেপোলি আফ্রাগোলা [ইতালি]

নেপোলি আফ্রাগোলা হাইস্পিড রেলস্টেশন হতে যাচ্ছে স্থাপত্যশিল্পের নতুন চমক। চমৎকার এই রেলস্টেশনটি ইতালির আগামীর প্রযুক্তির সেরা আকর্ষণ হতে চলেছে। বৃহত্তম এই ভবনটিকে দেখলে প্রথমেই মনে হবে সাপের অবয়ব। এর সর্পিল গতি প্রায় সাপের মতোই। ইতালির নেপোলির আফ্রাগোলা শহরে এই স্টেশনটি তৈরি হচ্ছে। এখান থেকে ট্রেন চলবে নেপোলি ও রোমের মধ্যে। যে কেউই এই স্টেশনের স্থাপত্য সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবেন। গোটাবিশ্বে এত চমৎকার স্থাপত্য নকশার রেলস্টেশন খুব কমই আছে। এই অনিন্দ্য সুন্দর রেলস্টেশনের স্থপতি জাহা হাদিদ। প্রায় ১৩ বছর আগে তিনি এই স্টেশনের নকশা তৈরি করেন। সময়টা ছিল ২০০৩ সালের নভেম্বর। শুরু থেকেই ভেবে নেওয়া হয়েছিল রেল ট্র্যাকের ওপর দিয়ে একটি ব্রিজের মতো করেই এই স্টেশন ভবন গড়ে উঠবে। চার তলাবিশিষ্ট হবে ভবনটি। ২০০৯ সালে উদ্বোধনের পরিকল্পনা থাকলেও নানা জটিলতায় এর নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লেগে যায়। বর্তমানে এটির দীর্ঘ নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ বছরই এই স্টেশন আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে। চার তলাবিশিষ্ট ভবনটির ভিতরে প্রবেশ করলে আপনি স্বাদ পাবেন আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের এক বিপুল সমারোহের।

 

লুভ জাদুঘর [আরব আমিরাত]

আরব আমিরাতের নতুন দৃষ্টিনন্দন ভবন লুভ জাদুঘর। এটি শুধু জাদুঘরই নয়, স্থাপত্যশিল্পে ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণকে। প্যারিসের বিশ্বখ্যাত লুভ জাদুঘরের ইউএই শাখা এই ভবন। এটি নির্মাণের দায়িত্বে আছেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি আতেলি জঁ নুভেল। এটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালেই। তবে এই লুভ জাদুঘরের ভবনটির কাজ প্রায় শেষ। এ বছরই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে জাদুঘরটি। স্থপতি আতেলি জঁ নুভেল এটি নির্মাণে ৬৫৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।

প্যারিসে বিশ্বখ্যাত লুভ জাদুঘরের এই ইউএই শাখার কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ। আর এই ভবনটির স্ট্রাকচারাল প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন ব্যুরু হ্যাপল্ড। ভবনটি আয়তনের দিক দিয়ে বিশাল যা প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার স্কয়ার ফিট এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে। লুভ জাদুঘরের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ভবনে পূর্ব এবং পশ্চিমা শিল্পের এক সেতুবন্ধন তৈরি হতে যাচ্ছে।

 

লেগো হাউস [ডেনমার্ক]

উদ্বোধনের অপেক্ষায় ডেনমার্কের বিলুন্ডে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ভবন লেগো হাউস। অনন্য সাধারণ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হতে যাচ্ছে এ ভবনটি। মূলত কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেই ব্যবহূত হতে যাচ্ছে লেগো হাউস। নানা রকম সেমিনার, কনফারেন্স ও আয়োজনের এই ভবনটি ভবিষ্যতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাও বটে। এখানে আসা দর্শনার্থীরা উপভোগ করতে পারবেন চমৎকার ক্যাফের স্বাদ। অফিস শেষে কিংবা বন্ধুদের আড্ডা জমিয়ে তুলতে ডেনমার্কের ভবনটি হয়ে উঠবে আদর্শ জায়গা। এ ছাড়াও পারিবারিক পরিবেশে দারুণ বিনোদন আর সব খেলাধুলার সুযোগ তো থাকছেই। যে কোনো অনুষ্ঠানে প্রচুর জনসমাগমও সম্ভব হবে এই হাউসে। সর্বোপরি একটি লেগো স্টোর তো থাকবেই এই হাউসে। মাত্র আড়াই বছর আগে ২০১৪ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৬ এর মাঝামাঝিতে তা শেষ হয়। প্রায় ৮২ হাজার বর্গফুটের ওপর নির্মিত হয়েছে এই লেগো হাউস। আর এই ভবনের উচ্চতা ১০০ ফুট। ডেনমার্কের বিলুন্ড লেগোর নগরী হিসেবেই সুপরিচিত বিশ্বজুড়ে। এখানে এলে দর্শনার্থীরা নানা রকম অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে পারবেন। ধারণা করা হচ্ছে, দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটিতে বছরে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার লোকের সমাগম ঘটবে।

 

জিৎস মিউজিয়াম [দক্ষিণ আফ্রিকা]

কেপটাউনের ঐতিহাসিক শস্যভাণ্ডার কমপ্লেক্সটিই পরিণত হচ্ছে জিৎস মিউজিয়ামে। এই মিউজিয়াম গড়ে উঠছে প্রায় এক লাখ বর্গফুটের বিশাল এলাকাজুড়ে। এটির পুরো নাম জিৎস মিউজিয়াম অব কনটেম্পরারি আর্ট। আর সংক্ষেপে এই মিউজিয়ামকে বলা হয় জিৎস মকা। নকশা অনুযায়ী এখানে ৪২টি ভার্টিক্যাল টিউব স্থাপিত হয়েছে। আরও থাকছে দর্শনার্থীদের জন্য প্রায় ৮০টিরও বেশি গ্যালারি। নিঃসন্দেহে এই ওয়াটার ফ্রন্ট কমপ্লেক্স সংযুক্ত ভবনটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আফ্রিকার সমসাময়িক চিত্রকর্মের সমাহার থাকবে এই জিৎস মকা বা জিৎস মিউজিয়ামে। এটিই ২০১৭ সালের অন্যতম প্রধান জাদুঘর প্রকল্পগুলোর একটি। আর নির্মিতব্য এই ভবনই হতে যাচ্ছে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জাদুঘর। আশা করা হচ্ছে, জাদুঘরটিতে ইতিহাসের বিরল সব সংগ্রহ সংরক্ষিত থাকবে।

 

হুয়াংশিয়ান মাউন্টেইন ভিলেজ  [চীন]

চীনের আনুহি প্রদেশে অবস্থিত হুয়াংশিয়ান মাউন্টেইনস বা হলুদ পর্বতমালা। আর এই পর্বতমালার ভিতরে গড়ে ওঠা ভবনের সমারোহই হলো হুয়াংশিয়ান মাউন্টেন ভিলেজ। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন তৈরিতেই এই ভবনগুলোর নকশা তৈরি করা হয়েছে। কারণ চা বাগান ঘেরা এই পার্বত্য এলাকায় চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় হুয়াংশিয়ান মাউন্টেইন ভিলেজ। এখানের ভবনগুলো উচ্চতায় ২০০ ফুট। যেগুলো ব্যবহার করা হবে সরকারি ও বেসরকারি উভয় কাজেই। পাশাপাশি আবাসন, হোটেল, নানা ধরনের কর্মসূচি আয়োজনের ব্যবস্থাও থাকছে এখানে। ভবনগুলোর আকৃতি ও রং এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে।

 

ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার [ডেনমার্ক]

ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার মিউজিয়াম ডেনমার্কের ভার্ডেতে অবস্থিত। সবুজ পাহাড় ঘেরা ভার্ডেতে গড়ে ওঠা নতুন এই ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার মিউজিয়ামটি। এর নির্মাতা বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বিজার্ক ইঙ্গলস গ্রুপ। কোম্পানিটি শুরু থেকেই অভিনব কিছু করতে অভ্যস্ত। এ প্রতিষ্ঠানের তৈরি অন্যান্য ভবনগুলোও অন্য সবার থেকে আলাদা স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে এই ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার মিউজিয়ামেও। আর কোম্পানিটি ঘোষণা দিয়েছে, তাদের এই ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার মিউজিয়াম ভবনটিই চলতি বছরের নতুন চমক হতে যাচ্ছে। এই মিউজিয়ামের বাঙ্কার নামের সঙ্গেও রয়েছে নকশার দারুণ মিল। অদ্ভুত নামকরণের পেছনে রয়েছে একটা ইতিহাসও। অনেক আগে ডেনমার্কের পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চলটিতে জার্মান মিলিটারি তাদের আস্তানা গেড়েছিল। এখানে তারা মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন বাঙ্কার স্থাপন করেছিল। সেখানে যে বাঙ্কারগুলো তৈরি হয় তার আদলেই তৈরি করা হয়েছে এই জাদুঘরের নকশা। জাদুঘরে প্রবেশ করলে আপনার মনে হতে পারে আপনি মাটির নিচের কোনো তলদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কনসেপ্টে তৈরি হতে যাচ্ছে ব্ল্যাভান্ড বাঙ্কার মিউজিয়াম।

 

সেন্ট্রো বোটিন [স্পেন]

নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর কৃষ্টিকলার জন্য স্পেন অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত। এখানে বিশুদ্ধ সংস্কৃৃতিচর্চার ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি। ফলে স্পেনের নিজস্ব সংস্কৃতির সুনামও ছড়িয়ে আছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেন্ট্রো বোটিন স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়ার একটি সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও কলা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। আবার অবসর-যাপনের জন্যও ব্যবহার হতে পারে এই সেন্ট্রো বোটিন। রেনজো পিয়ানি বিল্ডিং ওয়ার্কশপের নতুন প্রকল্প এটি। রেনজো পিয়ানির অন্যান্য প্রকল্পগুলোও ইতিমধ্যে বিশ্ব দরবারে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। তারা ইতিমধ্যে স্থাপত্যশিল্পে বিশ্ব দরবারে সুনাম অর্জন করেছে। নতুন এই সেন্ট্রো বোটিন তৈরি হচ্ছে মাদ্রিদভিত্তিক লুই ভিদালের স্থপতিদের হাতে। মজার ব্যাপার হলো, এই ভবনের অর্ধেকটা মাটির ও অর্ধেকটা পানির ওপর তৈরি। এর ঠিক পাশেই রয়েছে নয়নাভিরাম সবুজ মাঠ। এখানে আসা দর্শনার্থীরা এই মাঠে এসেও সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন অনায়াসেই।

 

গার্ডিয়ান আর্ট সেন্টার [চীন]

চীনে এক সময় বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক কলোনি গড়ে উঠেছিল। সেসব কলোনিতে নানা ধরনের মানুষ বাস করত। তখন কলোনিগুলোতে ছিল প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা। মূলত এ শতাব্দীর গোড়া থেকেই এসব কলোনি ভাঙতে শুরু করে। তৈরি হতে থাকে বড় বড় দালান। আর শহরটি হয়ে ওঠে আধুনিক প্রযুক্তির শহর। এরই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল পুরো শতাব্দীজুড়েই। দি গার্ডিয়ান আর্ট সেন্টার হতে যাচ্ছে চীনের নগরায়ণের নতুন সংযোজন। এই আর্ট সেন্টার চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত। তবে মূলত চীনের সবচেয়ে পুরনো নিলাম ঘর ছিল গার্ডিয়ান আর্ট সেন্টার। এ ভবনের একটি বিশেষত্ব রয়েছে। আর তা হলো এখানে পুরনো ধাঁচকে সম্পূর্ণ ঠিক রেখে সংযোজন করা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার সব কলাকৌশল। আর পুরনো ধাঁচের সঙ্গে নতুন উপকরণ যোগ করে তৈরি করা হয়েছে ভবনটি। ফলে অসাধারণ এক নতুন-পুরনোর সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে এখানে। আর ৬৪ হাজার ২৭ বর্গফুটের এই ভবন প্রাঙ্গণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে এর চমৎকার স্থাপত্যশিল্পের কারণে। তবে এই আর্ট শুধু শিল্পকর্মের জন্যই নয়, এখানে ১২০টি হোটেল রুমের পাশাপাশি থাকছে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট।

সর্বশেষ খবর