বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ তাদের হাতে

তানভীর আহমেদ

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দাতা সংস্থা অক্সফাম সম্প্রতি একটি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭২০ কোটি ধরে তার অর্ধেক ৩৬০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরেন, মাত্র আটজন মানুষের হাতে রয়েছে বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ! যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন, স্পেনের একজন ও মেক্সিকোর একজন বিলিয়নিয়র হলেন সেই আট ব্যক্তি যারা বিশ্বের দরিদ্র অর্ধ জনসংখ্যার সমান সম্পদের মালিক। এই আটজনই প্রযুক্তিবিদ বা প্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের আয়ের পরিমাণ ও অর্থসাম্রাজ্যের নানা কাহিনী নিয়ে আজকের রকমারি—

 

বিল গেটস [ যুক্তরাষ্ট্র ]

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্বসেরা ধনীদের তালিকায় তিনি বরাবরই শীর্ষে নাম লেখান। তার মোট সম্পদ ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কম্পিউটিং জগতের চেহারাটাই বদলে দিয়েছেন তিনি। বিল গেটস উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জনক। ১৯৫৫ সালে তিনি ওয়াশিংটনের এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে নিয়ে বলা হয়, কোনো একটি বিষয় তার মাথায় ঢুকলে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ করতেন না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি তিনি। তার আয়ের প্রধান উৎস মাইক্রোসফট। সফটওয়্যার তৈরি ও বাজারজাতকরণের বড় বাজারও তার দখলে। ডেক্সটপ কম্পিউটারের সবচেয়ে জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম তিনি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে অর্থসাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক এই প্রযুক্তিবিদ সামাজিক কাজেও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। তার প্রতিষ্ঠিত বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন মানবকল্যাণে।

 

আমানসিও ওর্তেগা [ স্পেন ]

এখন বয়স ৮০ বছর। থাকেন স্পেনের লা করুনায়। স্পেনের ব্যবসায়ী ইন্ডিটেক্স ফ্যাশন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমানসিও ওর্তেগা। তার মোট সম্পদ ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফ্যাশন হাউসকে ঘিরে যারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন সবাই আমানসিও ওর্তেগাকে গুরু মানেন। কারণ রীতিমতো ফ্যাশন বিপ্লব ঘটিয়েছেন এই স্প্যানিশ ধনকুবের। ২০১১ সালে তিনি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন হাউস ইন্ডিট্যাক্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি স্পেনের জারা ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার। বর্তমানে ফ্যাশনের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে পা দিচ্ছেন তিনি। তার মালিকানায় রয়েছে এপিক হোটেল, একটি ৫৪তলার বিলাসবহুল ভবনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। ওর্তেগার বাবা ছিলেন রেল কর্মচারী। তাই এক শহরে বেশিদিন থাকা হতো না। ১৯৭২ সালে ওর্তেগা প্রথম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। চালু করেন একটি ফ্যাশন হাউস। যেখানে শুধু বিভিন্ন ধরনের শার্ট বিক্রি হতো। যা পরবর্তী সময়ে ‘জারা’ ব্র্যান্ড নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এখান থেকেই গড়েন টাকার পাহাড়।

 

ওয়ারেন বাফেট [ যুক্তরাষ্ট্র ]

যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট। বর্তমানে তার হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ ৭১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্যবসা জগতে ‘ওমাহার বিচক্ষণজন’ বলে পরিচিত ওয়ারেন বাফেট। তাকে বিংশ শতকের সবচেয়ে সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মাল্টি-বিলিয়ন ডলার কনগ্লোমারেট ‘বার্কশায়ার হ্যাথাও’-এর মালিক এবং চেয়ারম্যান। তিনি তার সম্পদের ৯৯ ভাগ জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য দান করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। তিনি জীবনে প্রথম শেয়ার কিনেছিলেন মাত্র ১১ বছর বয়সে। ছোটবেলায় তিনি প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পেপার বিলি করতেন। তা থেকে যা সঞ্চয় হতো, মাত্র ১৪ বছর বয়সে তা দিয়ে তিনি একটি ছোট্ট খামার কিনেছিলেন। বর্তমানে ৮৬ বছর বয়স্ক বাফেট একজন অত্যন্ত উৎসাহী কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলোয়াড়। বিল গেটসের সঙ্গে তিনি প্রায়ই ব্রিজ খেলেন। বিপুল ধনসম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারেন বাফেট অত্যন্ত মিতব্যয়ী। ১৯৫৮ সালে বাফেট যে বাড়িটি কিনেছিলেন, এখনো তিনি ওমাহার সেই বাড়িতেই বাস করেন।

 

কার্লোস স্লিম হেলু [ মেক্সিকো ]

মেক্সিকান ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিম হেলু। তার মোট সম্পদ ৪৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৪০ সালে মেক্সিকোতে জন্ম নেওয়া এই টেলিকম ব্যবসায়ী হোটেল ব্যবসা ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা দিয়ে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন। মূলত ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল তার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন ফ্রান্স টেলিকম এবং সাউথ ওয়েস্টার্ন বেল করপোরেশনের সঙ্গে। এখান থেকেই সফলতার সিঁড়ির দেখা পান। এরপর বেসরকারি টেলিফোন সংস্থার দিকে হাত বাড়ান তিনি। ধীরে ধীরে তার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে গোটা লাতিন আমেরিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ব্যক্তি জীবনে ছয় সন্তানের জনক কার্লোস ছোটবড় দু-একটা ঘটনা ছাড়া খুব একটা সমালোচিত হননি। টেলিকম ব্যবসা দিয়ে তার উত্থান ঘটলেও এখনো ধরে রেখেছেন সেসব ব্যবসা। এখনো মেক্সিকোতে রয়েছে তার হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বেশ কয়েকটি হাউসিং কোম্পানি। ৭৬ বছর বয়সেও দক্ষ হাতে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন, আরও উঁচু করছেন টাকার পাহাড়।

 

জেফ বেজোস [ যুক্তরাষ্ট্র ]

আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাজন ও জেফ বেজোস একে অন্যের পরিপূরক নাম। ইন্টারনেটেও যে বেচাকেনা হতে পারে এই ধ্যান-ধারণা সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা পায় আমাজনের মাধ্যমে। আর আমাজন গড়ে ওঠে জেফ বেজোসের হাতে। এই সফল প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন। আমাজনে কর্মরত আছেন এমন কর্মীর সংখ্যা ৫৬ হাজারেরও বেশি। সফটওয়্যার ডেভেলপিং নিয়ে আগ্রহ থেকেই আমাজনের যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে ই-কমার্স সাইট আমাজনের যাত্রা শুরু করেন। এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে প্রতিষ্ঠানটির ওপর। কিন্তু ধৈর্য ধরে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন তিনি। দীর্ঘ সময় সাহসী উদ্যোক্তার মতোই প্রতিষ্ঠানটিকে টেনে নিয়ে যান জেফ। একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরির চেয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান তৈরির ব্যাপারেই মনোযোগী ছিলেন এই উদ্যোক্তা। বিশ্বকে সেটাই করে দেখিয়েছেন তিনি।

 


মার্ক জুকারবার্গ [ যুক্তরাষ্ট্র ]

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ। তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৫৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার তৈরি ফেসবুক গোটা দুনিয়াকে একসুতোয় বেঁধেছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, উদ্যোক্তা ও তরুণ ব্যবসায়ীদের তালিকাতেও রয়েছেন মার্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের মুখের ছবি এঁকে অ্যালবাম তৈরির পর মার্কের মাথায় এসেছিল একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইট তৈরির। সেই স্বপ্নের জগত্টাই ফেসবুক। এখন তিনি একই সঙ্গে কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং ইন্টারনেট উদ্যোক্তা। শিক্ষার্থীথাকাকালীন শখের বশে সফটওয়্যার লেখা শুরু করেন। ২০০২ সালে পিল্লিপ্স এক্সেটার একাডেমি থেকে পাস করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০০৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হল থেকে ফেসবুকের সূচনা করেন জুকারবার্গ। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সাল থেকে মার্ক জুকারবার্গ ফেসবুক নিয়ে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে প্রযুক্তি বিষয়ে একাধিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন তিনি। আর এ সূত্র ধরেই টাকার স্রোতে ভাসছেন মার্ক।

 

ল্যারি এলিসন [ যুক্তরাষ্ট্র ]

মার্কিন ব্যবসায়ী ল্যারি এলিসন। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ল্যারি এলিসন ওরাকল করপোরেশনের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী। ১৯৪৪ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করা ল্যারি তার শিক্ষাজীবনে ছিলেন অত্যন্ত অমনোযোগী। বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত সফলভাবে তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। এর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে পড়ার সময়ে তিনি প্রথম পরিচিত হন কম্পিউটার ডিজাইনের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে তিনি স্থায়ীভাবে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসেন। সত্তরের দশকে তিনি এমডাল করপোরেশনে কাজ শুরু করেন। এখানে তার একটি কাজ ছিল সিআইএর জন্য ডাটাবেজ তৈরি করা। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন ডাটাবেজ নিয়ে কাজ করতে। ১৯৭৭ সালে তিনি গড়ে তোলেন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরিজ। পরে ১৯৭৯ সালে এরই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওরাকল।

 

মাইকেল ব্লুমবার্গ [ যুক্তরাষ্ট্র ]

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক মাইকেল ব্লুমবার্গ। ৪০ বিলিয়ন সম্পদের মালিক তিনি, অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার তার। এই ডেমোক্রেটিক রাজনৈতিক সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেননি। ৭৪ বছর বয়সী এই ধনকুবেরের অর্থ সাম্রাজ্যের পেছনে রয়েছে ব্লুমবার্গ এলপি নামের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্লমবার্গ এলপি। সফটওয়্যার ও তথ্য ভাণ্ডারের ব্যবসায় তিনি অসামান্য সাফল্যের দেখা পান। বর্তমানে এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ১৯ হাজার মানুষ কাজ করছে। তবে ২০১৪ সালের পর থেকেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। অবশ্য সেটি ভালোভাবেই সামলেছেন তিনি। যার প্রমাণ মেলে তার ব্যক্তিগত আয়ের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ দেখে। ১৯৬৬ সালে ওয়ালস্ট্রিটে শেয়ার ব্যবসার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিলেন ব্লুমবার্গ। শুধু ধনকুবের হিসেবেই নন, ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তিনি ফোর্বসের তালিকায় রয়েছেন ৫৫ নম্বরে।

সর্বশেষ খবর